মনের জোর থাকলে যে কোনও কিছুই অসম্ভব নয়, তা প্রমাণ করে দিতে পারেন কেউ কেউ। তাই কেউ পক্ষাঘাতকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে উঠে যেতে পারেন পাহাড়চুড়োয়, কেউ আবার সমস্ত বাধার পাহাড় পেরিয়ে ছিনিয়ে আনতে পারেন জয়। আর এমন মানুষেরাই তো অনুপ্রেরণা জোগান। আমরা যারা প্রতিদিনের জীবনের জোয়াল টানতে টানতে ক্লান্ত হয়ে পড়ি, ঠিক সেসময় তেমন কোনও জীবনজয়ীই শিখিয়ে দেয় আমাদের, ‘এ ভাবেও ফিরে আসা যায়’। আসুন, শুনে নিই তেমনই এক যুদ্ধজয়ের গল্প। কৃত্রিম হাত নিয়েও যিনি দাপিয়ে বেড়ান জলে, চালান গাড়িও। আসুন, শোনা যাক তাঁর কথা।
তখন তাঁর মাত্র বছর সাতেক বয়স। বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে দুটো হাতই হারিয়ে ফেলেছিলেন ইন্দোরের বাসিন্দা বিক্রম অগ্নিহোত্রী। তবে তাতে হার মানার পাত্র ছিলেন না বিক্রম। পরিবারের কেউই তাঁকে হার মানতে শেখাননি। জীবনের ক্রিজে দাঁত কামড়ে পড়েছিলেন তিনি। হাজার রকম শারীরিক ও মানসিক যন্ত্রণা সত্ত্বেও হাল ছাড়েননি। বরং নিজেকে তৈরি করেছেন। পরিশ্রম আর মনের জোর থাকলে যে সব সম্ভব, তা ফের প্রমাণ করে দিয়েছেন বিক্রম। দু-হাত নিয়েও যা পারেন না অনেকে, তাই অভ্যাস আর অনুশীলনের মাধ্যমে অর্জন করেছেন তিনি। তাই দু-হাত ছাড়াই তিনি আজ একজন দক্ষ সাঁতারু, কার রেসার, ফুটবলার এবং একজন মোটিভেশনাল স্পিকারও। এর পাশাপাশি তিনি ভারতের প্রথম ব্যক্তি, যিনি হাত না থাকা সত্ত্বেও অর্জন করেছেন গাড়ি চালানোর পার্মানেন্ট লাইসেন্স।
আরও শুনুন: রাখে হরি, মারে কে! সমুদ্রে পড়ে গিয়ে হাঙরের মুখে, তবু সাঁতরে প্রাণ বাঁচল যুবকের
না, একেবারেই সহজ ছিল না যুদ্ধটা। গোড়া থেকেই গাড়ির শখ ছিল তাঁর। স্কুলে থাকতে থাকতে গাড়ি চালানো শেখার ইচ্ছে নিয়ে শুরু হয় মোটর ট্রেনিং স্কুলের খোঁজ। তবে তাঁর মতো বিশেষ চাহিদাসম্পন্নদের গাড়ি চালানো শেখাতে পারে এমন স্কুল চৌহদ্দিতে ছিল না। তবে তাতে টান পড়েনি তাঁর শেখার ইচ্ছায়। বরং নিজে নিজেই গাড়ি শেখার চেষ্টা করতে লাগলেন তিনি। প্রথম দিকে এক বন্ধু গিয়ার আর ক্লাচ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করত তাঁকে। আর এক পা দিয়ে স্টিয়ারিং নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করতেন বিক্রম। অন্য পা-টি ব্যবহার করতেন ব্রেক আর অ্যাকসিলেটর নিয়ন্ত্রণের কাজে। এ ভাবেই আস্তে আস্তে হাতে পাকল বিক্রমের।
তবে লাইসেন্স পাওয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল না সেটা। তাঁর মতো বিশেষ সক্ষম ব্যক্তি যে লাইসেন্স পেতে পারেন না, এমনটা অনেকেই বলেছিল তাঁকে। তবে হার মানেননি বিক্রম। বরং মোটর ভেহিক্যাল অ্যাক্টের ব্যাপারে নিজেই পড়াশোনা শুরু করেন। জানতে পারেন শারীরিক অক্ষমতার জন্য গাড়ি চালানোর অনুমতিপত্র খারিজ হওয়ার কোনও কারণ নেই। তবে গিয়ার চেঞ্জ করার জন্য একটা বিকল্প ভাবনা ভাবতে হত তাঁকে।
আর সেই জায়গাতেই তাঁকে সাহায্য করে বিজ্ঞান। ইদানীং বহু গাড়িই চলে স্বয়ংক্রিয় গিয়ারে। ২০১৫ সালে তেমনই একটি গাড়ি কিনলেন বিক্রম। আর সেটা নিয়েই আবেদন করলেন লাইসেন্সের জন্য। তবে খারিজ হয়ে গেল তাঁর সেই আবেদনপত্র। আরটিও-তে গিয়ে বহু অনুরোধ-উপরোধেও লাভ হল না। তবু পিছু হটলেন না বিক্রম। উল্টে দ্বারস্থ হলেন সংবাদ মাধ্যমের। ব্যাপারটি নিয়ে হইচই পড়তেই ঢোক গিললেন কর্তৃপক্ষ। মিলল গাড়ি চালানোর সাময়িক অনুমতিপত্র অর্থাৎ লার্নার লাইসেন্স। সেটি নিয়ে ১৫ মাস ধরে চলে একটানা অভ্যেস করার পরে অবশেষে স্বপ্নপূরণ হয় তাঁর। পাকাপাকি লাইসেন্স হাতে পান বিক্রম। ইতিমধ্যেই ইন্দোরে সাড়ে ১৪ হাজার কিলোমিটার রাস্তা গাড়িও চালিয়ে ফেলেছেন তিনি, কোনও রকম দুর্ঘটনা ছাড়াই।
আরও শুনুন: আশ্চর্য মনের জোর! পক্ষাঘাতকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে হুইলচেয়ারে চড়েই শৃঙ্গজয় ব্যক্তির
বরাবরই পড়াশোনায় ভাল ছিলেন বিক্রম। অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর পাশ করার পাশাপাশি করেছেন এমবিএ-ও। বরাবর সমস্ত রকম পরিস্থিতিতে পাশে পেয়েছেন পরিবারকে। বিশেষ স্কুলের সুবিধা থাকা সত্ত্বেও এক প্রকার জোর করেই ছেলেকে রেগুলার স্কুলে ভর্তি করিয়েছিন বাবা-মা। সেখান থেকেই খেলাধুলার প্রতি আগ্রহের শুরু। খেলেন ফুটবল। পাশাপাশি পেশাদার কার রেসিংয়েও প্রবল আগ্রহ তাঁর। ভারতের প্রথম বিশেষ ভাবে সক্ষম ব্যক্তি হিসেবে সম্প্রতি অংশ নিয়েছিলেন মরুভূমি স্টর্ম মোটর ব়্যালিতেও। সেখানে তৃতীয় হন বিক্রম। ইতিমধ্যেই এরো-মডেলার এবং লিমকা রেকর্ডে নাম রয়েছে তাঁর। পেয়েছেন জাতীয় গৌরব অ্যাওয়ার্ডও। এর পাশাপাশি মোটিভেশনাল স্পিকার হিসেবেও দিব্যি খ্যাতি রয়েছে বিক্রমের। এখনও পর্যন্ত জীবনে যা যা চেয়েছেন, তা অর্জন করেই ছেড়েছেন ৪৫ বছরের এই যুবক। আপাতত গাড়ি চালিয়ে লে-লাদাখে যাওয়ার স্বপ্ন রয়েছে তাঁর। আর আপাতত সেই ইচ্ছাই পূরণেই মন দিতে চান বিক্রম।