সাম্প্রতিক অতীতে এ দেশে বারবার ঘনিয়েছে সাম্প্রদায়িক অশান্তি। কখনও ধর্মীয় মিছিলকে কেন্দ্র করে তো কখনও কারওর উস্কানিমূলক মন্তব্য। বারবার দানা বেঁধেছে বিদ্বেষের বীজ। ছড়িয়েছে হিংসা। তবে শিকড়ের দিকে হাঁটলে দেখা যায় এ দেশের মাটির সঙ্গে পরতে পরতে জড়িয়ে রয়েছে মিলেমিশে থাকার ইতিহাস। হিন্দুদের পবিত্র তীর্থক্ষেত্র অমরনাথও সেই ইতিহাসের বাইরে নয়। কাশ্মীরের বাটাকোটের বাসিন্দা মালিক পরিবারের সঙ্গে এই অমরনাথের সম্পর্ক শতাব্দীপ্রাচীন। আজও সেই স্মৃতি বুকে আগলে বসে থাকেন ৯৫ বছরের এক মুসলিম বৃদ্ধ। গত ষাট বছর ধরে অমরনাথ দর্শনের আয়োজনে হাত লাগিয়েছেন তিনি। মন্ত্রোচ্চারণ করেছেন। অমরনাথ দর্শন সেরে তাই আজও তাঁর কাছে ভিড় জমান অসংখ্য যাত্রী। জানতে পারেন অন্য তীর্থের গল্প। আসুন, শুনে নেওয়া যাক মালিক পরিবারের সেই কাহিনি।
করোনা আবহে বছর দু’য়েক ভক্তসমাগম হয়নি। সেই খরা কাটিয়ে এ বছর ফের চালু হয়েছে অমরনাথ যাত্রা। কথিত আছে, সৃষ্টিরহস্য বোঝাতে পার্বতীকে নিয়ে এই গুহায় এসেছিলেন স্বয়ং শিব। বরফ নির্মীত শিবলিঙ্গ দেখতে এখানে ঢল নামে পুণ্যার্থীদের। প্রতিবছর প্রকৃতির খেয়ালে এ গুহার মুখে তৈরি হয় বরফের শিবলিঙ্গ। যা চাঁদের অবস্থানের সঙ্গে দৈর্ঘ্য বদলায়। আর সেই বরফানি বাবার দর্শন পেতে ছুটে আসেন পুণ্যার্থীরা। এ জায়গা আবার অন্যতম সতীপীঠও বটে। সতীর গলা ও গোড়ালি পড়েছিল এই স্থানে। প্রতিবছরই শ্রী অমরনাথ শ্রাইন বোর্ডের কাছে জমা পড়ে দিস্তে দিস্তে দরখাস্ত। দর্শনের শিকে ছেঁড়ে হাতে গোনা ক’জনের। সাধারণ ভাবে, জুন-জুলাই মাসে শ্রাবণী পূর্ণিমা থেকেই শুরু হয় যাত্রা। এ বছর ইতিমধ্যেই শুরু গিয়েছে অমরনাথের উদ্দেশে যাত্রা।
অমরনাথ ধাম হিন্দুদের পবিত্র ধর্মস্থান তো বটেই, কিন্তু তার সঙ্গে বছরের পর বছর ধরে দুই ধর্মের মিলনক্ষেত্র হিসেবেও স্মৃতিচিহ্ন বয়ে নিয়ে চলেছে এই অমরনাথ। শ্রীনগর থেকে ১৪১ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই তীর্থের সঙ্গে জড়িয়ে অসংখ্য মুসলিম মানুষ। অন্তত ৩৫ হাজার কাশ্মীরি মুসলিম কোনও না কোনও ভাবে এই যাত্রার বিভিন্ন রকম আয়োজনে লেগে থাকেন। কেউ চালান ঘোড়া, কেউ ব্যবস্থা করেন যানবাহনের, তো কেউ দোকানে বিভিন্ন জিনিসপত্র বিক্রি করেন। তাঁদের পরশ ছাড়া এই পবিত্র তীর্থযাত্রা সম্পূর্ণ হয় না।
আরও শুনুন: ঘরছাড়া করেছে যুদ্ধ, নির্জন দ্বীপের হরে কৃষ্ণ মন্দিরই এখন আশ্রয় ইউক্রেনের উদ্বাস্তুদের
এ অমরনাথ যাত্রার সঙ্গে গোড়ার দিন থেকে রয়েছেন কাশ্মীরের পহেলগাঁওয়ের বাটাকোট গ্রামের মালিক পরিবার। গত ষাট বছর ধরে এই যাত্রার সঙ্গে জড়িত ৯৫ বছরের গুলাম নবি মালিক যেন জীবন্ত কিংবদন্তি। অমরনাথের গুহামুখে ওই বরফের শিবলিঙ্গ খুঁজে পেয়েছিলেন মেষপালক ব্যক্তি, সেই বুটা মালিকেরই বংশধর এই মালিক পরিবার। সেই ঐতিহ্য বজায় থেকেছে পরিবারেও। এককালে পুণ্যার্থীদের অমরনাথের গুহা দর্শন করাতেন গুলাম নবি। দৃপ্ত গলায় বলে চলতেন মন্ত্র। কোনওদিন সেই কাজের মাঝখানে এসে দাঁড়ায়নি ধর্ম। বরং তাঁকে পুজারীর মতোই সম্মান দিয়ে এসেছেন পুণ্যার্থীরা।
যাত্রার মরসুমে প্রতিবছর সে সব কথা মনে পড়ে যায় বৃদ্ধ গুলাম নবির। ১৯৪৭ সালে মহারাজা হরি সিং ও তাঁর স্ত্রী তারা দেবী এসেছিলেন অমরনাথ দর্শনে। সে সময় গুলাম নবিকে একটি তামার প্লেটে ভর্তি করে খেজুর উপহার দিয়েছিলেন তারা দেবী। সেই তামার প্লেটটি আজও রয়েছে তাঁর কাছে স্মৃতি চিহ্ন হিসেবে। ৭০ বছর আগে সেই প্রথম অমরনাথ যাত্রার সঙ্গী হন গুলাম।
আরও শুনুন: ৬৫ বছরের কর্মজীবন এনে দিল বিশ্বসম্মান, পৃথিবীর প্রবীণতম বিমানসেবিকা এই মহিলা
১৮৫০ সালের কথা। পেশায় মেষপালক বুটা মালিক ঘুরতে ঘুরতে সন্ধান পান ওই গুহাটির। যেখানে বরফ জমে প্রাকৃতিক ভাবে তৈরি হয়েছিল শিব লিঙ্গ। তখন থেকে শুরু করে ২০০৫ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর অমরনাথ যাত্রার ব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িত থেকেছেন মালিক পরিবার। আজও বহু পুণ্যার্থীর কাছে মালিক পরিবারের দর্শন তীর্থেরই অঙ্গ। তাঁরা আসেন, বৃদ্ধ গুলাম নবি তাঁদের শোনান অমরনাথ যাত্রার সঙ্গে জড়িয়ে থাকা নানা কাহিনি। বুটার সমাধির পাশ দিয়েই বয়ে গিয়েছে ছোট্ট একটি ঝরনা। বহু দিন পর্যন্ত সেখান থেকেই পানীয় জল সরবরাহ হত। সেটিও হয়ে উঠেছিল একটি দর্শনীয় স্থান।
তবে ইদানীং নিরাপত্তার পাশাপাশি বেড়েছে অন্যান্য বিধিনিষেধও। ফলে অনেকে চেয়েও সেই সব শিকড়ের খোঁজ করতে পারছেন না। তাতে পুণ্যার্থীদের পাশাপাশি সমস্যা বেড়েছে স্থানীয়দের। সে ব্যাপারটি নিয়ে একটু ক্ষোভও রয়েছে মালিক পরিবারের। তাঁদের পূর্বপুরুষের কথা জানুক অমরনাথ দর্শন করতে আসা পুণ্যার্থীরা, এটুকুই চাওয়া তাদের। অমরনাথকে কেন্দ্র করে এই যে সম্প্রীতির আবহ এত বছর ধরে চলে আসছে, তা অক্ষুন্ন থাকুক সারাজীবন, এটুকুই আশা বৃদ্ধ গুলাম নবির।