তাঁদের কাছে প্রতিটা দিনই পরিবেশ দিবস। পরিবেশের প্রতি এই দায়বদ্ধতা থেকেই রোজ দিন শুরু করেন এই বাবা-মেয়ের জুটি। পরিবেশকে বাঁচানোই লক্ষ্য। তাই সমুদ্রের অতলে ঝাঁপ দিয়ে খুঁজে বের করে আনেন প্লাস্টিকের মতো ক্ষতিকারক পদার্থ। শুনে নিন, আট বছরের খুদে এই স্কুবা ডাইভারের গল্প।
সমুদ্রের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল মাত্র তিন বছর বয়সে। জলের সঙ্গে পরিচয় আরও আগে। ফলে সমুদ্রের বিশাল বিশাল ঢেউ ভয় দেখাতে পারেনি কোনওদিনই। ঠিক যেভাবে সমুদ্র বন্ধু হয়ে উঠেছিল ‘মোয়ানা’ ছবির সেই ছোট্ট মেয়েটির, তেমন ভাবেই এই খুদে কন্যার সঙ্গেও বন্ধুত্ব পাতিয়েছিল নীল জল।
জলে হাতে খড়ি হয়েছিল বাবার হাত ধরেই। বাবা অরবিন্দ ঠরুনশ্রী চেন্নাইয়ের করপ্পকাম এলাকার নাম করা স্কুবা ডাইভার। ২০০৭ সাল থেকে স্কুবা ডাইভিং করে আসছেন অরবিন্দ। বাবার ছায়াতেই বড় হয়েছে ঠাগরাই আরাথনা। আর রক্তই বা যাবে কোথায়! ছ-সাত মাস বয়সেই জলে হাত-পা ছুড়তে শিখে গিয়েছিল সে। প্রথমে গামলায়, পরে ছোট সুইমিং পুলে, আর একটু বড় হয়ে সমুদ্রে দাপাদাপি। বাবার প্রশিক্ষণে মাত্র আট বছরেই রীতিমত পাকা স্কুবা ডাইভার হয়ে উঠেছে ঠাগরাই। না, তাঁদের কাছে স্কুবা ডাইভিং শুধুমাত্র অ্যাডভেঞ্চার স্পোর্টস নয়। তার বাইরেও আরও অনেক বড় দায়িত্ব পালনে ব্রতী এই বাবা-মেয়ে জুটি।
আরও শুনুন: প্লাস্টিকের বিকল্প, কমলালেবুর খোসা দিয়ে গিফট ব়্যাপার বানিয়ে তাক লাগালেন ছাত্রী
পৃথিবীতে দূষণ যে ভাবে বেড়েই চলেছে, তা নিয়ে যথেষ্ট উদ্বিগ্ন পরিবেশবিদেরা। তার মধ্য সবচেয়ে বেশি যেটা চিন্তার, সেটা প্লাস্টিক দূষণ। সমুদ্রে প্লাস্টিক দূষণ বর্তমানে একটা জ্বলন্ত সমস্যা। প্রতিদিন প্লাস্টিকের কারণে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে হাজার হাজার সামুদ্রিক প্রাণী। বেশ কিছু সামুদ্রিক গাছ ও প্রাণী ইতিমধ্যেই বিলুপ্তির পথে। এই পরিস্থিতি থেকে পরিবেশকে বাঁচাতে নিজের কাঁধে দায়িত্ব তুলে নিয়েছেন অরবিন্দ আর ঠাগরাই।
মাঝেসাঝেই সমুদ্রের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়েন তাঁরা। সমুদ্রের তলা থেকে কুড়িয়ে আনেন প্লাস্টিক। গত ২৪ জানুয়ারি, জাতীয় কন্যা দিবসের দিনটা ছিল তেমনই একটা দিন। সমুদ্র বাঁচাতে সেদিনও জলে নেমেছিল আট বছরের ছোট্ট ঠাগরাই। কোভলং থেকে নীলাঙ্করী পর্যন্ত ১৮ কিলোমিটার এলাকা সাঁতার কেটে অ্যাসিস্ট ওয়ার্ল্ড রেকর্ডে নাম তুলেছে সে।
সমুদ্র দূষণ নিয়ে মানুষকে সচেতন করতে ইতিমধ্যে একটি তথ্যচিত্রও তৈরি করে ফেলেছে ছোট্ট ঠাগরাই। সেই কাজে তাঁকে সাহায্য করেছেন বাবা। সেই ভিডিওটি নিজের স্কুলে উপস্থাপনও করেছে সে। ঠাগরাই জানিয়েছে, বাবা ও তার সঙ্গে সমুদ্রের সম্পর্কটাই এক্কেবারে অন্যরকম। সৈকতে সময় কাটাতে ভালবাসে সে। তবে সমুদ্রসৈকত থেকে প্লাস্টিক সংগ্রহ না করে কখনও বাড়ি ফেরে না ছোট্ট ঠাগরাই।
আরও শুনুন: ঘন বনাঞ্চল থেকে রুক্ষ মরুভূমি, কীভাবে বদলে গেল সাহারা?
২০ বছরেরও বেশি সময় ধরে স্কুবা ডাইভিং প্রশিক্ষক হিসাবে কাজ করে আসছেন অরবিন্দ। চেন্নাই ও পুদুচেরিতে একটি স্কুবা ডাইভিং প্রশিক্ষণকেন্দ্রও চালান তিনি। ১৭ বছর ধরে এ ভাবেই সমুদ্রের ভিতরে ও বাইরে প্লাস্টিক পরিষ্কার করার কাজ করে আসছেন তিনি। দশ হাজার কেজিরও বেশি প্লাস্টিকজাত বর্জ্য সংগ্রহ করেছেন তিনি। এতদিনে পাশে পেয়েছেন নিজের আত্মজাকেও। যে-ও একই রকম ভাবে পরিবেশ বাঁচাতে আগ্রহী। নিজের আট বছরের জন্মদিনটাও সে পালন করেছে সমুদ্রের ভিতরেই। জেলিফিশ দেখেছে, রংবেরঙের মাছ-পাথর-প্রবালের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে তাঁর। সে সব কীভাবে প্লাস্টিক দূষণের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, সেসবও দেখেছে নিজের চোখে। নিজেদের এই সমুদ্র বাঁচাও অভিযানকে কীভাবে আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়, সে নিয়ে রীতিমতো চিন্তাভাবনা করে খুদে মেয়েটি। পাশাপাশি সচেতনতা বাড়াতে প্রচার চালানোর কথাও মাথায় রয়েছে তার। উদ্ধার হওয়া প্লাস্টিকজাত বর্জ্য ভাঙা জিনিসপত্রের দোকানে বিক্রি করে দেন অরবিন্দরা। সেখান থেকে সেসব যায় রিসাইকেল হওয়ার কাজে। সেখান থেকে পাওয়া অর্থ তামিলনাড়ুর পরিবেশ দপ্তরের কাজে দান করতে চান তাঁরা।
ছোট্ট ঠাগরাইয়ের বার্তা, পরিবেশের জন্য ভাল কিছু করার জন্য দিনক্ষণ ঠিক করার দরকার নেই। প্রয়োজন শুধু সদিচ্ছার। আর তা থাকলে যে কোনও দিনই পরিবেশ কিংবা সমুদ্র দিবস, যে কোনও মুহূর্তই হতে পারে আর্থ আওয়ার। পরিবেশ বাঁচানোর এই লড়াইয়ে সহযোদ্ধা হওয়ার জন্য তাই প্রত্যেকটি সময়ই আদর্শ। সহনাগরিক ও বন্ধুবান্ধবদের কাছে এমনই বার্তা পৌঁছে দিতে চায় বাবা-মেয়ের এই মিষ্টি জুটি।