যে রামায়ণ নিয়ে দেশজুড়ে এত আলাপ আলোচনা, সেখানেই একাধিক দত্তক সন্তানের দেখা মেলে। সীতা যেমন রাজা জনকের পালিতা কন্যা, তেমনই রামের দিদি শান্তাও বেড়ে উঠেছেন তাঁর পালক পিতার কাছে। মহাভারতেও রাজা শূরের কন্যা কুন্তীকে দত্তক নিয়েছিলেন রাজা কুন্তীভোজ। কিন্তু এত কিছুর পরেও এ দেশে দত্তক নেওয়ার বিষয়টি সুগম নয়। কেবল মানসিক নয়, আইনি বাধা পেরোনোর প্রক্রিয়াও সেখানে দীর্ঘ। এ বিষয়েই সম্প্রতি নয়া নির্দেশ দিল দেশের শীর্ষ আদালত। আসুন, শুনে নেওয়া যাক।
একটি শিশু যদি অনাথ হয় বা অবাঞ্ছিত সন্তান, তাকে নিজস্ব ঘর দিতে পারার মতো সুন্দর ভাবনা আর কী আছে! আবার যে দম্পতি, বা একলা থাকা যে মানুষটি শিশুর সান্নিধ্য চাইছেন, এই কাজের মধ্যে দিয়ে পরিপূর্ণ হয়ে উঠতে পারেন তিনিও। সব মিলিয়ে, মানবিক গুরুত্ব ছাড়াও, সমাজের সার্বিক উন্নয়নের স্বার্থেই দত্তক নেওয়া যে একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু দত্তক নিতে চাই বললেই যে নেওয়া যায়, এমন নয়। সন্তান দত্তক নেওয়ার বিষয়ে ভারতে নির্দিষ্ট কিছু আইন রয়েছে। শিশুর সুরক্ষার খাতিরে ও অপরাধচক্র বন্ধ করার প্রয়োজনেই এই আইনি বন্দোবস্ত। নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে আবেদন করার পর বিভিন্ন ক্ষেত্র খতিয়ে দেখে তবে একটি শিশুকে দত্তক নেওয়ার অনুমতি মেলে। আর এই সমস্ত পদ্ধতিটিই যথেষ্ট দীর্ঘমেয়াদী। আর এই বিষয়েই এবার পদক্ষেপ করল সুপ্রিম কোর্ট।
আরও শুনুন: সদ্যোজাত কন্যাকে জ্যান্ত পুঁতে ফেলা হল মাটিতে , ‘বেটি বঁচাও’-এর উল্টো পথেই কি হাঁটছে দেশ?
এমনিতেই সমাজের একটি বড় অংশের মানুষের মধ্যে এখনও দত্তক নেওয়া নিয়ে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব রয়েছে। তার উপর এই আইনের প্যাঁচ এবং দীর্ঘসূত্রিতার কারণে অনেক সময় পিছিয়ে যান দত্তক নিতে উৎসাহী মানুষও। সম্প্রতিই এক রিপোর্টে ‘সেন্ট্রাল অ্যাডপশন রিসোর্স অথরিটি’ ওরফে সিএআরএ জানিয়েছিল, তিন বছর ধরে অপেক্ষা করছেন দত্তক নিতে চাওয়া প্রায় ১৬ হাজার আবেদনকারী। তাতে জানানো হয়েছিল, দত্তকযোগ্য শিশুর অভাবই অপেক্ষার মূল কারণ। কিন্তু এবার শীর্ষ আদালত সাফ জানাল, এই সংস্থার হিসেবের সঙ্গে বাস্তবে দেশের অনাথ শিশুর সংখ্যার মধ্যে বড় ফারাক রয়েছে। সাধারণত, কয়েক মাস থেকে ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত ছেলেমেয়েদের দত্তক নেওয়া যায়। আর সুপ্রিম কোর্টের বক্তব্য মোতাবেক, দেশে বর্তমানে অনাথ শিশুর সংখ্যা প্রায় ৩ কোটি। এই পরিস্থিতিতে, দত্তক নেওয়ার প্রক্রিয়াটি তুলনামূলক সহজ করার নির্দেশ দিল সুপ্রিম কোর্টে জাস্টিস ডি ওয়াই চন্দ্রচূড় এবং জে বি পার্দিওয়ালার বেঞ্চ।
আরও শুনুন: দুর্ঘটনায় কাজ হারিয়েছেন বাবা, খাবার ডেলিভারি করে সংসার চালাচ্ছে ৭ বছরের খুদে
দেশে দত্তক নেওয়ার প্রক্রিয়াটি সহজ করার দাবি উঠেছে ইতিমধ্যেই। এর আগে বছরে ২০০০টি দত্তক পদ্ধতি সম্পূর্ণ করতে পারত সিএআরএ, বর্তমানে যে সংখ্যাটা বাড়িয়ে ৪০০০ করা হয়েছে। কিন্তু তাতেও অনাথ শিশুদের নতুন পরিবার দেওয়ার কাজটি অনেকটাই পিছিয়ে থাকছে বলে মত প্রকাশ করেছে আদালত। এদিকে করোনার সময় এই পদ্ধতি কিছুটা শিথিল করা হয়েছিল। পরবর্তীকালেও একইভাবে সেই পথ অনুসরণ করা যেতে পারে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। উপরন্তু, কোভিডের প্রথম ২০ মাসে ভারতে অনাথ হয়েছিল ১৯ লাখ শিশু, এমনটাই জানিয়েছে ল্যানসেটের এক সমীক্ষা। সব মিলিয়ে, দেশে অনাথ শিশুর সংখ্যা ক্রমবর্ধমান। এই পরিস্থিতিতে দত্তক নেওয়ার প্রক্রিয়াকে ‘ক্লান্তিকর’ আখ্যা দিয়ে তা সুবিন্যস্ত করার নির্দেশ দিল দেশের শীর্ষ আদালত। সুপ্রিম কোর্টের এই রায়ে এবার আশার আলো দেখছেন দত্তক নিতে আগ্রহী আবেদনকারীরা।