তারা ঘটক। প্রেমের ঋত্বিক। দূত কিংবা দূতি। পদাবলি তাঁদের ছাড়া অসম্পূর্ণ। বৃন্দাবন কদমের গন্ধে নেশা-নেশা। তবে যুগলমিলনের পর তাঁদের আর কে মনে রাখে! প্রেমের যাবতীয় স্থানীয় সংবাদে তাঁরাই বিশেষ সংবাদদাতা। চিঠি চালাচালিতে বিশ্বস্ত। কিশোরী ফ্রক কিংবা ডাকাবুকো হাফপ্যান্ট। তারপর একদিন দাদা-দিদি হাত ধরে সিঁড়িতেই বসে পড়ে। আর বেচারা ঘটক কাটা ঘুড়ি। আটকে পড়ে স্মৃতির শুকনো ডালে। আজ প্রেমের দিনে তাদেরই ফিরে দেখার পালা।
প্রেমের ঘটকালি নিয়ে লিখলেন, শাঁওলি দে।
ও বাবা সে কথা আর মনে নেই? ঘটক বলে ঘটক! এই ঘটকগিরি করতে করতেই তো নিজের প্রেমটাও ঠিকঠাক করা হল না। সে আফসোস আমার এ জীবনে আর গেল না। ভাবছিলাম অন্য সবকিছু ছেড়ে সেকাজটাই ঠিকঠাক করতে পারলে এতদিনে একখানা ম্যাট্রিমনি সাইটই খুলে ফেলা যেত!
বন্ধু, বান্ধবী থেকে শুরু করে দিদিভাইয়ের বান্ধবী কার না ঘটক ছিলাম এক্ সময়ে! আশ্চর্য সেসব কথা চিন্তা করলে কেমন যেন স্বপ্ন স্বপ্ন লাগছে! সাইকেলে চেপে এই পড়া, ওই পড়া করতে যেতেই হত এপাড়া থেকে সেপাড়া… সেই সাইকেলের সামনের ঝুরিতে কত যে প্রেম-প্রেম গন্ধ লুকিয়ে আছে! বন্ধুর প্রেম-দশা, চিঠি লিখবে কে? বান্ধবীর আবার প্রেম করার ইচ্ছে কিন্তু বাড়ির কথা ভেবে না করতে হবে, সেই ইচ্ছে কিন্তু অনিচ্ছের কথা জানাতে হবে, কে জানাবে? কেউ টিউশন শেষে দাঁড়িয়ে আছে কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে, সঙ্গে যাবে কে? সেই ছড়াকারের মতো বলতে হয়, ‘ঘরে আছে হুলো বেড়াল, কোমর বেঁধেছে’… কিংবা অনেকটা শাহরুখের স্টাইলে বলে উঠি, ‘ম্যায় হুঁ না!’
এ জন্মে কত যে প্রেম করিয়েছি! দিদির বান্ধবী করবে প্রেম জিজুর বন্ধুর সঙ্গে, ঘটক ও পাহারাদার আমি, দাঁড়িয়ে থাকি অনন্তকাল ধরে, গাছের নীচে, ব্রিজের ধারে, স্কুলের পেছনের মাঠে। মশা কামড়ায়, বাড়ি ফেরার সময় যায় পেরিয়ে, মায়ের ক্রমশ লাল হয়ে যাওয়া চোখ আর খুন্তিটা চোখে ভাসে, তবু দাঁড়িয়েই থাকি! একসময় দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে গলা খ্যাঁখরাই, মিথ্যে হাঁচির শব্দ করি। সংবিৎ ফেরে প্রেমিকযুগলের, হেলেদুলে এসে জানায়, ‘তুই রওনা দে, আমরা আর একটু পরে আসছি।’ লে হালুয়া! এ কথাটাই একটু আগে বলা যেত না! অন্তত মশা কামড়ের হাত থেকে তো বাঁচতাম। খুন্তিটা না হয়… থাক সে গল্প। বান্ধবীর চিঠি পৌঁছে দিতে হবে পাশের পাড়ার এক দাদাকে, সেখানে আমার রোজ টিউশন থাকে, যাওয়া আসার পথে রোজ দেখা হয় হবু বান্ধবীর বরের সঙ্গে, চোখাচোখি, অল্পস্বল্প হাসাহাসি। চিঠি পৌঁছে দিই জায়গামতো, কাঁপা হাতে পকেট থেকে সেও বের করে আনে কুঁকড়ে যাওয়া একটা কাগজ, যেন স্বর্ণখনি থেকে তুলে আনছে মূল্যবান কোনও রত্ন। আনতশিরে জানায়, ‘এই চিঠিটা তোর জন্য লিখেছিলাম, পড়ে উত্তর দিবি?’ ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি করে দৌড়ে পালাই বন্ধুবিচ্ছেদের ভয়ে, না তাদের প্রেমটাও আর হয়নি সত্যি, আমার তো নয়ই তবে বান্ধবী জানে ঘটকের কাজটা আমি নিষ্ঠাসহকারেই করতে চেয়েছিলাম। আবার পাহারাদারি করতে করতে কখন যে দুই পাখি ফুড়ুৎ সেটা টের না পাওয়ার ব্যর্থতাও ঝুলিতে আছে। পাবলিক তো গব্বরকে না পেলে কালিয়াকে ধরবেই, সেই বান্ধবীতুতো কাকু কাকিমা কত বছর যে কথা বলেননি আমার সঙ্গে! আজও একসঙ্গে কোথাও আড্ডা হলে এই নিয়ে খুবই হাসাহাসি হয়! তবে মনে মনে দাঁত কিড়মিড় করে বলি, বছর তো কত হল ‘ঘটক বিদায় আর কবে দিবি?’ বাংলাটা কোনোক্রমে লিখতে পারতাম বলে, চিঠি লেখার ফরমায়েশও কম পেতাম না। ‘ভাণ্ডারে কত বিবিধ রতন’ দিয়ে সাজিয়ে তুলতাম সেসব চিঠি, যেন কোনও এক প্রেমে-বিরহে কাতর প্রেমীর আর্তনাদ, যেন কোনও কবির অসমাপ্ত পাণ্ডুলিপি। তবে চিঠি বেশি লেখাতো ছেলে বন্ধুরা, সেই যে ফ্রিতে লেখা দেওয়ার অভ্যাস হল, আজও তা পিছু ছাড়ল না।
চিঠি দেওয়ার প্রসঙ্গে আরও একটি ঘটনা মনে পড়ে গেল। এক বন্ধুর আরেক বন্ধুকে দেওয়া চিঠি নিয়ে বাড়ি ফিরেছিলাম, অংক বইয়ের ভেতর। সেদিনই যে মাতৃদেবী রাতে অংক বইটাই খুলবেন জানলে রাখি কখনও! ব্যস তারপর নিজের দিকে ছুটে আসা বই, খাতা, হাতা, খুন্তি, চপ্পল আর হাতপাখার ক্যাচ লুফতে লুফতে কখন যে ঘটকগিরি করার ইচ্ছেটা বিদেয় হল টেরই পাইনি।
এখন মনে হয়, ঘটকগিরি না করে প্রেমটা যদি জমিয়ে করতে পারতাম সেসময়, তবে মা বাবাকে ঘটকবিদেয়ের টাকাটা অন্তত দিতে হত না। তবে কিছু সফল ও অনেকগুলো ব্যর্থ কেস মেমোরি ফাইলে বন্দি আছে, তা অবসরে নেড়েচেড়ে দেখতে মন্দ লাগে না কিন্তু!