নব্বইয়ের মফস্বল কিন্তু এই স্মার্টফোনের যুগের মতো এতটা স্মার্ট হতে পারেনি। এমন অনেক বোকা অমলকান্তির দেখা মিলত যারা ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার নয়, রোদ্দুর হতে চাইত। প্রেমের জন্য, সম্পর্কের জন্য নিজের স্বপ্ন বিসর্জন দিয়েছে এমন অনেককেই চেনা যেত। তবে, সেই বোকা হওয়া মোটেও সহজ কাজ নয়। লিখছেন জয়াশিস ঘোষ।
পাঠ: শঙ্খ বিশ্বাস
প্রচ্ছদ: অর্ঘ্য চৌধুরী
আমাদের নিমু হদ্দ বোকা ছিল। আমরা যখন অঙ্ক পরীক্ষায় পরিমিতির সঙ্গে যুদ্ধ করে যেতাম, নিমু ক্লাসঘরের জানালা দিয়ে কেটে যাওয়া ঘুড়ির দিকে তাকিয়ে থাকত। বলত, “কেমন বিনে পয়সায় এদিক ওদিক চলে যাচ্ছে। আচ্ছা, ওর মনখারাপ হবে না লাটাইয়ের জন্য?”
স্যার বলত– ‘হাঁদা’।
আমরা বলতাম – ‘ক্যালানে’।
বাড়ির লোক বলত– ‘ক্যাবলা’।
নিমু খাতায় বটগাছের ছবি এঁকে আসত। যথারীতি, খাতা দেখানোর সময় ওকে ‘মুরগি’ হয়ে থাকতে হত ক্লাসঘরের বাইরে। আমরাও ওকে মুরগি বানাতাম। রবিনদার চপের দোকানে সবাই মিলে ভেজিটেবল চপ খেয়ে দাম দেওয়ার সময় ওকে দেখিয়ে পালিয়ে এসেছিলাম। নিমুর কারখানায় কাজ করা বাবা হাতখরচ দেবে কোথা থেকে? যথারীতি পয়সা মেটাতে না পেরে নিমুকে বাসন মাজতে হয়েছিল।
বুদ্ধি না-থাকার জন্য নিমু ছিল সবার মজা করার পাত্র। রাখাল স্যার বলতেন–“তোর মগজের গোবর দিয়ে ভালো ঘুঁটে হবে।” সবাই হাসত। শুধু চিন্তায় থাকত ওর মা। হাবাগোবা ছেলেকে নিয়ে কী করবে!
নিমুর গুণ বলতে একটাই– ভালো ছবি আঁকত। একবার জিজ্ঞাসা করেছিলাম– ”এই যে তোকে সবাই বোকা বলে, রাগ হয় না?” নিমু বলেছিল, “রাগ কেন হবে? আমি তো চালাক হতে চাই না।” আমাদের সেই বোকা নিমু একবার ভরা বর্ষায় লক্ষ্মীর বিলে ঝাঁপ দিয়ে উলটে যাওয়া নৌকার প্রায় দশ জনকে একা বাঁচিয়েছিল। আমরা ভয় পেয়ে পাড়ে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম। নিমু নিজের প্রাণের পরোয়া করেনি।
সেইদিন বুঝেছিলাম বোকা হওয়া সহজ কাজ নয়।
নব্বইয়ের মফস্বল কিন্তু এই স্মার্টফোনের যুগের মতো এতটা স্মার্ট হতে পারেনি। এমন অনেক বোকা অমলকান্তির দেখা মিলত যারা ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার নয়, রোদ্দুর হতে চাইত। প্রেমের জন্য, সম্পর্কের জন্য নিজের স্বপ্ন বিসর্জন দিয়েছে এমন অনেককেই চিনতাম। তুহিনদা ছিল পড়াশোনায় তুখোড়। বিদেশ থেকে গবেষণার ডাক পেয়েছিল। প্লেনের টিকিট, ভিসা সব হয়ে গেছে। যাওয়ার আগের দিন ভুলুর পা ম্যাটাডোরের চাকায় পিষে গেল। তারপর ভুলুকে নিয়ে দৌড়াদৌড়ি, সারিয়ে তোলার চেষ্টায় তুহিনদার আর যাওয়া হল না। সবাই বলল–তুহিনটা কী বোকা! একটা রাস্তার কুকুরের জন্য কেউ এভাবে নিজের জীবন নষ্ট করে!
এমনকি, এই বোকামির জন্য তুহিনদার অনেক দিনের প্রেমিকা ইভাদিও ছেড়ে চলে গেল। তুহিনদা কিন্তু যায়নি। পরের বছর ইভাদির বিয়ে হয়ে যায়। তুহিনদা প্রাইমারি স্কুলে পড়ানোর চাকরি পায়। কিন্তু সেই বোকামির জন্য কখনও পস্তাতে দেখিনি। সেই সময়টা এমনই ছিল। প্রেমও ছিল বাঁধভাঙা। শুধু একবার প্রিয় মানুষের দেখা পাওয়ার আশায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা রোদে পুড়ে, জলে ভিজে দাঁড়িয়ে থাকত নব্বইয়ের মফস্বল। সেই সব অপেক্ষার শেষে প্রাপ্তির ঝুলি ফাঁকাই থাকত। কিন্তু প্রেমে কে আর কবে লাভ-ক্ষতির হিসেব করে! কথায় আছে, বোকারাই প্রেমে পড়ে। বোকারাই প্রেমে আঘাত পায়।
একতরফা প্রেমের আঁতুড়ঘর ছিল নব্বইয়ের মফস্বল। রোগা ভোগা চেহারায় বড় ঝুলপি আর ব্যাগি প্যান্ট পরে যতই শাহরুখ খান সাজার চেষ্টা করুক না কেন, আদতে ভাস্কর ছিল চরম বোকা। ইতুদির প্রেমে সে তখন এতটাই অন্ধ যে ওদের বাড়ির জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ করে দিত। টিভি কাজ করছে না, ভাস্কর অ্যান্টেনা ঘুরিয়ে ঠিক করে দিত। শান্তিপুর থেকে ব্যাগে করে হিমসাগর আম নিয়ে আসত। নিজের পড়াশোনা বাদ দিয়ে কলকাতায় বান্ধবীর বাড়ি থেকে অনার্সের নোট এনে দিত। আমরা বুঝিয়েছিলাম, “দ্যাখ, ইতুদিরা অনেক বড়লোক। তার ওপর তোর দিদির বয়সি। ইতুদির বাবা বড় সরকারি অফিসার। আর তোর বাবার মুদির দোকান। এমন কেস খাবি, হাড়গোড় ভেঙে পড়ে থাকবি।”
প্রেম কি আর কেসের ভয় পায়? ভাস্কর বিশ্বাস করত সমস্ত সামাজিক প্রতিবন্ধকতা ঝেড়ে ফেলে ইতুদি একদিন ঠিকই চিনে নেবে ওর ভালোবাসার জোর।
সে-বছর বেশ কিছুদিন ইতুদির দেখা নেই। ভাস্কর হাঁ করে তাকিয়ে থাকে দোতলার জানালার দিকে। কিন্তু জানালা আর খোলে না। বাড়ির সবার মুখ কেমন থমথমে। তারপর মালতীমাসির হাত দিয়ে এল বহু প্রতীক্ষিত চিঠি। ভাস্কর যেন মাঝরাতে এসে ইতুদিকে বাড়ি থেকে নিয়ে যায়। এমনিতেই বসন্তকাল। দখিনা বাতাসে টালমাটাল মফস্বলের হৃদয়।
বন্ধুর থেকে ধার করা পাঞ্জাবি, জিনস পরে সাহসিকতার সব সীমা পার করে যক্ষপুরী থেকে
রাজকন্যেকে উদ্ধার করল ভাস্কর। বাড়ির পেছনে ঘেঁটুর জঙ্গলে দাঁড় করানো ছিল জয়দীপের মপেড।
হাওয়ার উড়ে আসা ইতুদির চুল এসে পড়ছিল ওর চোখে মুখে। কাঁধে ইতুদির হাত। শরীর থেকে ভেসে আসছিল আশ্চর্য গন্ধ।
হাইওয়ের মোড়ে এসে মপেড দাঁড় করাতে বলল ইতুদি। ব্যাগ কাঁধে একজন যুবক বাইক নিয়ে তার জন্য অপেক্ষা করছে সেখানে। একমুখ দাড়ি। ইতুদি পরিচয় করিয়ে দিল, “আমার ভাই। আমাকে খুব ভালোবাসে। ও না থাকলে তোমার সাথে সংসার করা হত না। বাড়ির পছন্দ করা ছেলের সাথে এই মাসেই বিয়ে দিয়ে দিত বাবা। বড্ড ভালো ছেলে।”
ভাস্করকে জড়িয়ে ধরল ইতুদি। তখন দূর থেকে শিলিগুড়ির নাইট সুপারের আলো দেখা যাচ্ছে। ইতুদি চলে যাওয়ার পর ভাস্কর সারা রাত দাঁড়িয়ে ছিল ওখানে। বোকা ভাস্কর কাঁদেনি। সাক্ষী ছিল হাইওয়ের জোনাকিরা।
দিনটা ছিল ১ এপ্রিল…