কথায় বলে, আপনি আচরি ধর্ম পরেরে শিখাও। তা সে কাজটি আমরা আদৌ করি নাকি? আমরা চাই, অন্যেরা সৎ হোক, পরিশ্রমী হোক, দেশ-সময়-সমাজের মঙ্গলচিন্তা করুক। সেখানে তেলের শিশি ভাঙলেই রাগারাগি। কিন্তু নিজের বেলা? অন্যের ঘাড়ে দোষের ঘড়া চাপিয়ে দিব্যি কাটানো যায়, তবু কিছু প্রশ্ন নিজের জন্যও তোলা থাকে। নতুন বছরে তাই নতুন করে ফিরে তাকানো যাক নিজের দিকেই। লিখছেন বিনোদ ঘোষাল।
অলংকরণে: দীপঙ্কর ভৌমিক।
বেশি নয় এই দিন কয়েক আগের কথা আমার জুতোর সোল খুলে গিয়েছিল। স্টেশনের কাছে এক মুচির দোকানে সারাতে দিয়ে এসেছিলাম। পরদিন গিয়েছিলাম ফেরত নিতে। বটগাছের নিচে গুমটি দোকান। বয়স্ক মানুষ। সারাই করা জুতোটা হাতে নিয়ে দেখছি এক ভদ্রলোক এলেন, মুখটা চেনা। ক’দিন আগেই একসঙ্গে মশাল-মিছিলে পাশাপাশি হেঁটেছি। চায়ের দোকানে সমাজবিপ্লব, শ্রেণিবৈষম্য ইত্যাদি বিষয়ে চমৎকার জ্ঞানগর্ভ এবং যুক্তিযুক্ত বক্তব্য রাখেন। তিনি মুচিকে জিজ্ঞাসা করলেন,
– কী রে আমার চটিটা করেছিস?
– হ্যাঁ হয়ে গেছে। বলে মুচি লোকটি প্লাস্টিকে জড়ানো একজোড়া স্যান্ডেল ওই লোকটির দিকে বাড়িয়ে দিলেন।
– কত নিবি?
আমি এবার বিনীতভাবে মৃদু হেসে জিজ্ঞাসা করলাম, উনি আপনার স্কুলের বন্ধু?
ভদ্রলোক হতবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, বন্ধু! ধুর! বন্ধু কেন হবে?
– ওহ, না আসলে ‘তুই’ করে বলছেন। সেইজন্য ভাবলাম…
লোকটি আমার দিকে কটমট করে তাকালেন, তারপর মুচির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, কত টাকা নেবে বলো?
– কুড়ি টাকা দিন।
আমি মনে মনে ভাবলাম যাক অন্তত ‘তুই’ থেকে ‘তুমি’ তে এসেছেন। একদিন নিশ্চয়ই ‘আপনি’তেও ফিরবেন।
আসলে এমন উদাহরণ রয়েছে প্রচুর। আমাদের বেশিরভাগেরই মনের ভেতরে রয়েছে একটি ভূত, যে চায় পৃথিবীর সবকিছু ভাল হোক, সুন্দর হোক। যেমন নেতা-মন্ত্রীরা সৎ হোক, আমলা, কর্মচারীরা, পুলিশরা ঘুষ নেওয়া বন্ধ করুক। রাস্তাঘাট সবসময় বিলিতি দেশগুলোর মতো ঝকঝকে থাকুক, খাবারে ভেজাল না-থাকুক। মাতৃভাষায় শিক্ষা দেওয়া হোক… ইত্যাদি ইত্যাদি। সত্যি বলতে প্রতিটি চাওয়াই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, এবং সৎ। এই চাওয়াগুলি পূরণ হলে পৃথিবীর ভোল বদলে যাবে। কিন্তু সমস্যা হল, যে-ভূতটি এমনটি চায়, সে চায় এসবই হোক অন্যের দ্বারা। অর্থাৎ প্রতিবেশীর ছেলে বিপ্লব করে মরুক, আমার ছেলে স্বাধীনতার ফল খাবে। মন্ত্রীরা সৎ হয়ে দুর্নীতি করা বন্ধ করুক কিন্তু আমি তাই বলে নিজের কাজের জায়গায় ফাঁকি দেওয়া বন্ধ করব না। পুলিশ, ঘুষ নেওয়া ছেড়ে দিক কিন্তু আমি ঘুষ খাওয়ার সুযোগ ছাড়ব না। রাস্তাঘাট সব ঝকঝকে করে রাখুক মিউনিসিপ্যালিটির লোকজন তবে আমি আমার বাড়ির বাইরে ময়লা ফেলেই যাব, রাস্তার ধারে অম্লানবদনে প্রস্রাব করে, থুতু অথবা গুটখার পিক ফেলে বলব রাজ্যটা একেবারে নোংরার হদ্দ! আজকাল বই পড়ার চল পুরো উঠেই গেছে বলে নিজে মোবাইলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা রিলস দেখতে থাকব। লাইব্রেরিগুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে বলে আফশোস করব কিন্তু কখনও নিজের পাড়ার লাইব্রেরিটিতে একবারের জন্যও ঢুঁ মারব না।অর্থাৎ আমার একমাত্র পবিত্র কর্তব্য হল ঠোঁট উলটে শুধু কিস্যু হসসে না, সব কিছু গোল্লায় গেছে বলে যাওয়া এবং নিজে ঠিক সেই কাজগুলোই করে যাব।
আমি নিজে ক্রমাগত সকলকে দোষারোপ করে যাব পরিবেশ দূষণ নিয়ে কিন্তু নিজের গাড়িতে ক্রমাগত অকারণ হর্ন বাজিয়ে শব্দদূষণ বাড়িয়ে যাব, কথা বলব পানীয় জলের সমস্যা নিয়ে অথচ নিজের বাথরুমের কল থেকে জল পড়েই চলবে। বলব নতুন প্রজন্ম পুরো উচ্ছন্নে গেছে, তারা অগ্রজদের সম্মান দিতে জানে না, অথচ প্রতিদিন আমরা এমন কিছু আচরণ করতে থাকব যা কোনোভাবেই সম্মান, সম্ভ্রমের যোগ্য নয়। আর যদি কেউ আমার দিকে আঙুল তুলে বলে, আপনি নিজে কী করছেন? আপনি নিজে কতটুকু সচেতন? তখন উত্তর দেব– আরে আমি একজন মানুষ কতটাই বা ময়লা করতে পারি! কতটুকুই বা আমার ক্ষতি করার সামর্থ্য! তখন ভুলে যাই আমার মতয় এক একটি বিন্দু দিয়েই তো সিন্ধু তৈরি হয়। আমার মতো এক একজন মানুষ দিয়েই তো সমাজ তৈরি হয়।
কথায় বলে, আপনি আচরি ধর্ম পরেরে শিখাও। এই প্রসঙ্গে একটি গল্পের কথা মনে পড়ে গেল। মোল্লা নাসিরুদ্দিনের কাছে এক ব্যক্তি এলেন নিজের ছেলেকে নিয়ে। বললেন, মোল্লাসাহেব, আমার ছেলে বড় বেশি চিনি খায়, এত মিষ্টি খাওয়া ওর শরীরের পক্ষে ক্ষতিকারক, আমরা বারণ করলে শোনে না, আপনি মুরুব্বি মানুষ, আপনি যদি দয়া করে একটু ওকে বারণ করেন, আপনার কথা ও শুনবে। নাসিরুদ্দিন শুনলেন, তারপর ভদ্রলোককে বললেন, বেশ আপনি দিন পনেরো পরে ছেলেকে নিয়ে আসুন, তখন বলব। ভদ্রলোক ভাবলেন নিশ্চয়ই বিশেষ কোনও কারণে মোল্লাসাহেব আজ বললেন না, তিনি ছেলেকে নিয়ে ফিরে গেলেন। পনেরো দিন পর আবারও সপুত্র এলেন, তখন নাসিরুদ্দিন বললেন, উঁহু, আজও বারণ করব না, আপনি আরও পনেরো দিন পর ছেলেকে নিয়ে আসুন। ভদ্রলোক অবাক হলেন, কিন্তু মুখে কিছু বললেন না, ফিরে গেলেন। ভাবলেন, মোল্লাসাহেব নিশ্চয়ই ছেলেকে বারণ করার কোনও মোক্ষম উপায় তৈরি করছেন তাই সময় লাগছে। পনেরো দিন পর আবারও এলেন ছেলেকে নিয়ে। তখন নাসিরুদ্দিন ছেলেটিকে বললেন, শোনো বাব্ মিষ্টি খাওয়া মোটে ভালো নয়, অত চিনি তুমি খেও না।
ভদ্রলোক বেজায় অবাক। খানিক বিরক্ত হয়েই বললেন এই সামান্য কথাটা বলার জন্য আপনি আমাকে তিনবার ঘোরালেন! প্রথমদিনই তো এই কথা বলে দিতে পারতেন?
নাসিরুদ্দিন মৃদু হেসে বললেন, প্রথমদিন কী করে বলতাম? আমি নিজেই তো মিষ্টিতে আসক্ত। গত একমাসে চেষ্টা করে নিজে চিনি খাওয়া বন্ধ করেছি তারপর আজ আপনার ছেলেকে বারণ করার যোগ্যতা অর্জন করলাম।
গল্পটা এইটুকুই আর প্রশ্নটা ঠিক এখানেই। অন্যকে বারণ করে চলেছি প্রতিদিন নিজেকে বারণ করছি কি? নিজেকে যোগ্য করে তুলছি কি? সচেতন, সাবধান করছি কি? নাকি শুধুই অন্যকে দোষ দিয়ে নিজের দায়িত্ব সেরে ফেলছি।
এই লেখাটি লেখার সময় শুনতে পাচ্ছি, হয়তো আপনারাও পাবেন, বাইরে কোথাও পান্নালাল গাইছেন– দোষ কারও নয় গো মা, আমি স্বখাত সলিলে ডুবে মরি শ্যামা…