ট্যাবুতে কাবু সমাজ। বছর আসে। বছর যায়। আগাছার মতো ছোট ছোট অকারণ অযৌক্তিক নিষেধের ডোর আমাদের পায়ে পায়ে পিছুটানে টেনে রাখে। এগিয়ে যাওয়া যদি সময়ের ধর্ম হয়, আমরা কি সে ধর্ম পালন করব না! লিখছেন প্রহেলী ধর চৌধুরী।
পড়ে শোনালেন চৈতালী বক্সী, অলংকরণে দীপঙ্কর ভৌমিক।
‘এটাই বুঝি সোনার কেল্লা মাম্মাম?’– ভেলোরের লক্ষ্মী-নারায়ণী স্বর্ণমন্দিরে পৌঁছে জিজ্ঞেস করল জিয়া।
আজ জিয়ার বিশেষ আনন্দের দিন। মাস তিনেক আগে তার গলার কাছের ছোট্ট ফোঁড়ার মতো যে জিনিসটা ক্রমশ বড় হতে শুরু করেছিল আর পাল্লা দিয়ে গম্ভীর হয়ে উঠছিল বাপি-মাম্মামের মুখ, অবশেষে আজ সেই মেঘ ঘুচল। ভেলোরের ডাক্তারকাকু ওটাকে ‘ক্যান্সারাস নয়, পাতি ফাইব্রোমা’ বলে হেসে উড়িয়ে দেওয়ার পর থেকেই। একটা সামান্য ‘ফোঁড়া’ নিয়ে এত আকাশপাতাল চিন্তার যে কি ছিল তা অবশ্য জিয়া এখনও বুঝতে পারেনি। সে শুধু বাপি-মাম্মামের হাসিমুখ দেখেই খুশি। তবে পাশাপাশি এই বিষয়েও সে নিশ্চিত হয়েছে যে, বড়রা সবকিছু বড্ড জটিল করে ভাবে। তার মতো সহজ খেলায় মেতে উঠতে পারে না।
‘সোনার কেল্লা নয় মা, এটা সোনার মন্দির। পাঞ্জাবের স্বর্ণমন্দিরের মত এটাও একটা সোনার মন্দির।’– হেসে বলে মাম্মাম।
আরও একটা সোনার মন্দির! এত্তগুলো সোনার মন্দির তার দেশে! ভেবেই অবাক হয় জিয়া। বলে, ‘আমরা তো তাহলে খুব বড়লোকের দেশে থাকি মাম্মাম! তা এইসব মন্দিরের সোনার মাথাগুলো ভেঙে গরিব লোকেদের দিয়ে দেওয়া যায় না মা? তাহলে ওদের আর কষ্ট করে ভিক্ষা করে খেতে হয় না।’
এমন একটা দিগ্বিজয়ী আইডিয়া দেওয়ার পর বাপি তো কিছু বললই না, যে মাম্মাম জিয়ার সব ভাবনাকে ভরপুর উৎসাহ দেয়, সেও কিনা মুচকি হেসে চুপ করে রইল! নাহ, বড়দের চিন্তাভাবনাগুলোই গোলমেলে। কিছুতেই বুঝে ওঠা যায় না। সেও কি বড় হলে এমনি জটিল মানুষ হয়ে উঠবে? মনে মনে চিন্তিত হয়ে ওঠে জিয়া।
এসব গভীর চিন্তার মধ্যেই বাপি-মাম্মামের সঙ্গে মন্দিরের লাইনে এসে দাঁড়িয়েছে সে। লাইন এগোচ্ছে। অজস্র মানুষের ভিড় চারদিকে। দূর থেকেই প্রণাম করছেন, প্রার্থনা করতে শুরু করেছেন তারা।
এসবের মধ্যেই, জিয়া দেখল, মন্দিরের একজন লোক এসে গম্ভীরমুখে বাপিকে কিছু একটা বললেন। কী বললেন শুনতে না-পেলেও, জিয়া বুঝল, কথাটা তাকে নিয়েই হচ্ছে।
এই রে! মনে মনে ভাবল জিয়া। এরা নির্ঘাত ওর সোনার মন্দিরের মাথাগুলো ভাঙার ফন্দিটা শুনে ফেলেছে। বাপিকে কমপ্লেন করতে এসেছে সেটা নিয়েই।
‘আহা কাকু, ওগুলো তো আমি গরিবদের দেওয়ার জন্য চাইছিলাম, নিজের খেলার জন্য নয়…’ এমনই কিছু একটা বলার জন্য এগিয়ে যেতে গিয়ে জিয়া বুঝল, বিষয়টা আদৌ এই নিয়েই নয়। মন্দিরের কাকুটির বক্তব্য হচ্ছে, জিয়া স্কার্ট পরে মন্দিরে ঢুকতে পারবে না। কারণ তার হাঁটু থেকে নীচের অংশ অনাবৃত। তাই তা ঢাকার জন্য হয় জামা পালটে আসতে হবে, নতুবা মন্দিরের ভেতরেই যে কাপড়ের দোকান আছে, সেখান থেকে ওড়না জাতীয় কিছু কিনে তা-দিয়ে পা ঢেকে ঢুকতে হবে।
‘পর বাচ্চি হ্যায় উয়ো। সির্ফ ক্লাস ফাইভ কি বাচ্চি হ্যায় উয়ো।’– বাপফ তখন প্রাণপণে বোঝানোর চেষ্টা করছে মন্দিরের কর্তাব্যক্তিটিকে।
এভাবে চলল বেশ কিছুক্ষণ। তবু হার মানতেই হল অবশেষে। ওড়না কিনে জড়িয়ে দেওয়া হয় জিয়ার কোমরে, যাতে হাঁটুর নীচ থেকে পা ঢেকে যায়। আর মন্দিরে ঢোকার অনুমতিও পাওয়া যায়।
সেদিন মন্দিরের ভেতরে ঢুকে ঠাকুরের সামনে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকেছিল জিয়া। কী প্রার্থনা করা যায়, ঠাওর করতে পারেনি। শেষে বেরিয়ে আসার আগে ঠাকুরের সামনে হাতজোড় করে বলেছিল, ‘বড় হয়ে গেলে, বড়রা বড় বড় জিনিস বাদ দিয়ে অকারণ ছোট ছোট জিনিস নিয়ে মাথা ঘামাতে শুরু করে। তুমি দেখো ঠাকুর, আমি যেন বড় হয়ে বাচ্চাদের পা-ঢেকে মন্দিরে ঢোকার মত হাবিজাবি বিষয় বাদ দিয়ে, মানুষের দারিদ্র, খেতে না-পাওয়ার মতো পৃথিবীর বড়সড় বিষয়গুলো নিয়ে ভাবতে পারি।’
এই সত্যি ঘটনাটি ঘটেছিল মাত্র ছ-বছর আগে। ২০১৮ সালে। আমারই এক অফিস কলিগের মেয়ের সঙ্গে। তবে শুধু তো লক্ষ্মী-নারায়ণী স্বর্ণমন্দিরে নয়, গোটা ভারতের নানা মন্দিরে নানা অদ্ভুত নিয়ম আজও বর্তমান। কপাল ভালো, শবরীমালা মন্দিরের দ্বার অবশেষে আইন করে উন্মুক্ত হয়েছে মহিলাদের জন্য।
এত কথা বলার কারণ একটাই। আবারও তো একটা নতুন বছর আসছে, আসুন না, এই নতুন বছরে এসব অকারণ পুরনো সামাজিক প্রথাগুলি, যা ধর্মের নামে, ঐতিহ্যের নামে সমাজ জুড়ে বিদ্যমান, তা দূর করার চেষ্টা করি। ঈশ্বরে বিশ্বাস করলে, যে তনু-মন-প্রাণ ঈশ্বরেরই দান, তার স্বতঃস্ফূর্ত আবরণে অসুবিধা কোথায়? বিশেষ করে শিশুদের ক্ষেত্রে, যাদের শরীর কিংবা মন কোথাওই না পরিষ্কার হয়েছে শরীরের ধারণা, না প্রোথিত হয়েছে শারীরিক অঙ্গপ্রত্যঙ্গের সঙ্গে সম্মান-অসম্মান জড়িয়ে ফেলার সামাজিক ধারণাগুলি, তাদের উপর অকারণ আরোপগুলি কি না-করলেই নয়? বিশ্বের অধিকাংশ উন্নত দেশে যে পোশাকের সহজ সমাদর, এদেশে সেটাই ‘ঐতিহ্যবিরোধী’ বলে দাগিয়ে দিয়ে সংস্কৃতির কোন উন্নয়ন সাধিত হয়?
এই অকারণ আয়োজনের সময় বাঁচিয়ে বরং দারিদ্র, অশিক্ষা, বৈষম্যের মতো সামাজিক ব্যাধিগুলো নিরাময়ের পথ কি সকলে মিলে ভাবতে শুরু করতে পারি না নতুন বছরে?