সময়ের আছে কৃষ্ণপক্ষ। শুক্লপক্ষ। পক্ষ নিতে জানতে হয়ে মানুষকেও। চলমান সময় পরীক্ষার মুখে ফেলে। প্রতিবার মানুষ সেখানে আলাদা ভূমিকা নিয়ে হাজির হয়। তাতে সাফল্য আসে, ব্যর্থতাও। সেই রিপোর্ট কার্ড হাতে মূল্যায়ন জরুরি। নইলে সকলই গরল ভেল! লিখছেন অরুন্ধতী দাশ।
অলংকরণ: দীপঙ্কর ভৌমিক।
কয়েক ঘণ্টার মধ্যে উলটে গেল ক্যালেন্ডারের পাতা, তারিখ লেখার সময় প্রথম ক-দিন অজান্তেই পুরোনো বছরের ছাপ চলে আসবে অন্যমনস্ক হাতের ত্বরিত স্বাক্ষরে। আর ছুটতে ছুটতে দম ফেলার অবকাশে আমরা কিছু ঝড়তিপড়তি কুচো ইঁদুরের দল, আমরা আরও একবার লম্বা শ্বাস ফেলব, ফিরতি বছরটার দিকে তাকিয়ে। তারপর পালটা আর-একটা লম্বা শ্বাস নেব, আর-এক দফা দৌড় শুরু করব বলে। বছরের প্রথম দিনটা যদি ‘এবার থেকে’ জাতীয় ঈষৎ ন্যাকামিমিশ্রিত এবং অপরাধবোধজারিত ভঙ্গুর সব শপথবাক্যের দিন হয়ে থাকে, তাহলে শেষ দিনটা অবশ্যই ছিল বেআব্রু হওয়ার দিন। কী করিনি আর কী করেছি-র ফ্ল্যাশব্যাকে আফশোস, লজ্জা আর ব্যর্থ মুহূর্ত মনে পড়ে সবার আগে।
এ বছরটায় যেমন সব হিসেব উলটে দিয়েছে রাজনীতির ছক। আর পোলিটিকাল প্রগ্রেস রিপোর্টের খাতা খুললে এ বছরটা অবশ্যই লিবারালদের অপমৃত্যুর বছর। এমনিতেই, ‘লিবারাল’ শব্দটা আজকাল বেশ গালাগালির মতো শোনায়। লিবারালদের ‘অ্যাপোলিটিকাল’ বা তথাকথিত ‘অরাজনৈতিক’ পক্ষাবলম্বনের হেরে যাওয়ার উত্তুঙ্গ নিদর্শন হয়ে থাকবে এই ২০২৪। আমেরিকার নির্বাচনে ট্রাম্প-এর ফিরে আসা, ইজরায়েলের যুদ্ধ, বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভরাডুবি, আর জি কর কাণ্ডে ফুঁসে-ওঠা তাপিত শোরগোলটির আচমকা কুয়াশাচ্ছন্ন হয়ে পড়া— যে দিকেই তাকাই, একটাই কথা মনে হচ্ছে, সোশাল মিডিয়া থেকে শুরু করে নাগরিক মঞ্চের কোনাখামচি পর্যন্ত টান মারলে যেসব মুখরিত কণ্ঠস্বর প্রতিনিয়ত শোনা যাচ্ছিল, সেসবই মায়াপ্রপঞ্চময়, ফাঁকা আওয়াজ। কোথাও কোনো নেতৃস্থানীয় অবয়ব নেই, যে বা যারা পোলিটিকাল অ্যাকটিভিজমের সামান্যতম ধারাবাহিকতা প্রমাণ করতে পেরেছে। আমরা বিশ্বের সর্বোন্নত সমাজের প্রতিভূ দেশে দেখলাম এত লম্বাচওড়া সাম্যের বুলি কপচে শেষ পর্যন্ত স্বৈরাচারী শক্তিকেন্দ্রটিকেই বিপুল জনসমর্থনে ফিরিয়ে আনা হল, প্রতিবেশী দেশে দেখলাম সেক্যুলার নিরপেক্ষতার ঘাড়ে-রাখা মৌলবাদের বন্দুক, আররাজ্যে দেখলাম মুহুর্মুহু রাজনৈতিক দলবদল ।
অথচ, আজ থেকে ঠিক বছর পনেরো আগে, আমাদের রাজধানী শহরে শেষ একটা লম্বাচওড়া গণ-অভ্যুত্থান দেখা গিয়েছিল নন্দীগ্রাম কাণ্ডকে কেন্দ্র করে। ‘সুশীল নাগরিক’ বা ‘বুদ্ধিজীবী সমাজ’ জাতীয় বেশ কিছু পারিভাষিক শব্দ একেবারে রাজনৈতিক দায়দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে ঢুকে পড়েছিল আমাদের সবার ঘরে ঘরে। জনতার রাজনীতির স্বতস্ফূর্ত অভিমুখের একেবারে গোড়ার সারিতে উঠে এসেছিল চিন্তাশীল বেশ কিছু মুখ, পক্ষাবলম্বন যাঁদের প্রাথমিক নীতি ছিল না কোনোদিনই। অথচ, সময়ের দায় এড়িয়ে না গিয়ে সেদিন ঝোঁকের দিকে তাঁরা ঝুঁকে দাঁড়ালেন। আর শুধু নিজেরা দাঁড়ালেনই না, তাঁদের প্রত্যেকের নিজস্ব খ্যাতি, জনপ্রিয়তা, গ্রহণযোগ্যতা ও জনসমর্থনের বৃত্তটিকে কাজে লাগিয়ে কিছু ম্লান-মূক মুখে ভাষাও দিলেন, নিজেরাই হয়ে উঠলেন জনপ্রতিনিধি। অর্থাৎ, এর আগে আমাদের রাজ্যে ঘটে-যাওয়া শেষতম রাজনৈতিক জন-অভ্যুত্থানেও আমরা দেখেছি, একেবারে ইতিহাসের মাপা নিয়ম মেনে, আন্দোলন থেকেই উঠে এসেছে জননেতাদের মুখ।
ইতিহাস বরাবর সাক্ষ্য দিয়ে এসেছে, প্রাচীনতম শতক পর্যন্ত খুঁড়ে দেখুন, যে-কোনো বিপ্লব নতুন মুখের জন্ম দেয়। এমন কোনও মুখ, যে এই সম্মিলিত জনস্রোতের মুখের ভাষা হয়ে ওঠার মতো সংবেদনায় ভরপুর, আড়ালে রয়ে-যাওয়া প্রতিটি মুখচ্ছবি যে মুখে নিজস্ব প্রতিফলন দেখে। এই বিপুল সমর্থন কখনোই নিরঙ্কুশ হয় না, তাও সত্যি। একদল যাকে ‘নেতা’ বলে, অন্য দল তাকেই বলতে পারে ‘একনায়কতন্ত্রের মুখ’। এক দল যে মুখে আশ্বাসের হৃৎস্পন্দন খুঁজে নেয়, অন্য দল তাকেই চিনে নেয় ‘চক্রান্তকারী’, ‘সুবিধাবাদী’, ‘ছদ্মবেশী ঠগ’ হিসেবে। কিন্তু প্রতিটি পক্ষ অথবা বিপক্ষ মতের একটি করে প্রতিনিধিস্থানীয় মুখ চিরকাল ইতিহাসে থেকেছে। মানুষ বরাবর এমনই নায়ক এবং প্রতিনায়কদের সন্ধান করেছে, যাদের পরস্পর লড়িয়ে দিয়ে নিজের নিজের লড়াইয়ের খাতায় হারজিতের পয়েন্ট তুলে রাখা যায়। দিনবদলের প্রত্যক্ষ ভাঙচুর নিজের গায়ে এসে লাগবে না, অথচ গ্যালারিতে বসে দড়ি-টানাটানির উত্তেজনা চেখে নেওয়া যাবে, সাধারণ মানুষের এটুকুই রোমাঞ্চ। জননেতাদের ব্যক্তিগত উত্থান অথবা ভরাডুবির ঘাড়েই জন-অভ্যুত্থানের দায় চাপিয়ে সমর্থকরা যে যার হাত ঝেড়ে ফেলতে চায় আসলে। মাঝেমাঝে শুধু সমর্থন নিশ্চিত করার জন্য মিছিল বা জনসভা গোছের শক্তিপরীক্ষার কেন্দ্রগুলোতে একটু-আধটু হাজিরা দেওয়া অথবা পাড়ার মোড়ে নিরামিষ, নিরীহ ঠেকগুলোতে বিশেষজ্ঞদের বিতর্কসভা বসিয়ে বিরোধী প্রতিবাদীর তকমা পাওয়া— সাহসের দৌড় ঘেরাটোপ অবধি।
অথচ, এ বছরের যে-কোনো রাজনৈতিক ঘটনা খুঁড়ে দেখুন, আপনি কিছুতেই কোনও একজন সর্বসমর্থিত জননেতার মুখ খুঁজে পাবেন না। এ বছরের যাবতীয় টানাপোড়েন কিছুতেই দানা বাঁধতে পারল না কোথাও,তার সবচেয়ে বড় কারণ, আগাগোড়া ভীষণরকম গণতান্ত্রিক, বহুস্বরপ্রবণ, বহুস্তরীভূত এবং বহুদলীয় হতে গিয়ে বিদ্রোহের নিশানওয়ালারা ভুলে গেলেন, যে-কোনো বিরোধিতা, তা যত অকিঞ্চিৎকরই হোক না কেন, তার গোড়ার কথাটা হচ্ছে পক্ষাবলম্বন।
সশব্দে পক্ষ অবলম্বনের মেরুদণ্ড না থাকলে, হাজারও জ্ঞানগর্ভ তর্কবিতর্কের নিট ফল বিরাট একটি অশ্বডিম্ব। বিদ্রোহ আর বিপ্লবের তফাতটা ঠিক এইখানেই। বিষয়টা স্রেফ একখানা কাচের গ্লাস আর কয়েক আউন্স গরম জল দিয়েই জলবৎ তরল করে বুঝে ফেলা যায়। ব্যাপারটা ঠিক কেমন? ধরা যাক, আপনার হাতে আছে ওই একখান কাচের গ্লাস আর কিছুটা গরম জল। আপনি জল ঢেলে ফেললেন গ্লাসে। গ্লাসটা কি ফাটবে? নির্ভর করছে, দুটো শর্তের ওপরে। এক, গ্লাসের কাচ কতটা পুরু। দুই, জল কতটা গরম। এখন ওই গরম জলটাকে যদি তুলনা করি জন-উত্তেজনার সঙ্গে, আর কাচের গ্লাসটা যদি হয় রাজনৈতিক পরিস্থিতি, তাহলে বুঝতে ভুল হয় না যে, পরিস্থিতি বদলানোর শর্তও ঠিক দুটো। জনতার উত্তেজনার পারদ কতটা চড়েছে, কিংবা রাজনীতির স্থিতাবস্থায় কতটা ভাঙন ধরেছে। গ্লাস যদি না ফাটে, তাহলে খুচরো বিদ্রোহ থেকে বিপ্লবের বদলের পথে যাওয়ার স্বপ্ন অধরাই রয়ে গেল। এ বছরের এত রাজনৈতিক ডামাডোলের পরেও কোনো পরিবর্তনের তুচ্ছতম আভাসও যে কোথাও নেই, তার মূলেও আসলে এই দুটো সম্ভাবনাই রয়ে গেছে। অধিকার বুঝে-নেওয়া প্রখর দাবিতে যারা ‘লিবারাল’ মুখ বজায় রেখে সোচ্চার হচ্ছেন, হয় তাঁদের জোরে বা পক্ষাবলম্বনে খামতি রয়ে গেছে প্রচুর, আর নয়তো, বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যে বৃহত্তর জনতা যে শান্তিময়ী প্রচ্ছায়ার আশ্রয় পেয়েছে, তার খুঁটি নাড়িয়ে দেওয়ার স্পর্ধাঅমূলক। এই বুনিয়াদি অঙ্কের হিসেবটা ‘লিবারাল’রা যত তাড়াতাড়ি বুঝবেন, ততই মঙ্গল। মোদ্দা কথা, এ বছরটা তাঁদের গ্রেস দিয়েও পাস করানো গেল না।