ইদানীং সোশাল মিডিয়া তার নিজস্ব বর্ণমালা তৈরি করেই ফেলেছে, যা ছুঁয়ে ছুঁয়ে বলে ফেলা যায় একজন ঠিক কেমন আছেন। মানুষের সোশাল মিডিয়া ব্যবহারের গড় নকশাই সেই ভাষার জন্ম দিয়েছে। কিন্তু সেই ভাষার দৌড় ঠিক কতখানি? তলিয়ে দেখলেন চৈতালী বক্সী।
সবার উপর সোশাল মিডিয়া সত্যি! যেন তাহার উপর নাই! সত্যি বলতে কি, বহুদিন হল কেউ আর কাউকেই জিজ্ঞাসাও করেন না যে, কেমন আছেন? কেননা সোশাল মিডিয়াই আজকাল মানুষের হয়ে সব কথা বলে দেয়। সে কেমন আছে, কোথায় যাচ্ছে, কাদের সঙ্গে সময় কাটাচ্ছে, সবকিছুই যেন সকলের নখদর্পণে। ব্যাপারটা এরকম জায়গায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে, মানুষটা আছে না উবে গিয়েছে তা নিয়েও ভাবার দরকার নেই। শুধু তার সোশাল মিডিয়া প্রোফাইলটি সজাগ থাকলেই হল। মানুষ বুদ্ধিমান প্রাণী, অতএব এক ঝলক চোখ বুলিয়েই সব বুঝে যায়।
-: আরও শুনুন :-
অনুরাগে যত রাগ! যেন সোশ্যাল মিডিয়া ছাড়া হারানোর কিছুই নেই
এ নিয়ে আর কোনও দ্বিধা নেই যে দিনে দিনে আমরা একটা ভাষায় অভ্যস্ত হয়ে উঠেছি। তা হল সোশাল মিডিয়ার ভাষা। ব্যাপারটিকে দু-ভাবে দেখা যায়। এক হল, সোশাল মিডিয়ায় ব্যবহৃত ভাষা। সে নিয়ে ভাষাবিদরা আলোচনা করে থাকেন। আমাদের চেনা-জানা ভাষার সে এক ধরনের সম্প্রসারণ বটে। আর-একটি হল, সোশাল মিডিয়ার নিজেরই ভাষা হয়ে ওঠা। ভাষা তো যোগাযোগের সেতু। ইদানীং সোশাল মিডিয়া তার নিজস্ব বর্ণমালা তৈরি করেই ফেলেছে, যা ছুঁয়ে ছুঁয়ে বলে ফেলা যায় একজন ঠিক কেমন আছেন। মানুষের সোশাল মিডিয়া ব্যবহারের গড় নকশাই সেই ভাষার জন্ম দিয়েছে।
অতএব আমরা ধরেই নিয়েছি যে, সোশালে যা হয়, সব সত্যি, সব-ই সত্যি। কারও প্রোফাইলে ডিপি অর্থাৎ ডিসপ্লে পিকচার নেই মানে, সাধারণত, তাঁর মন খারাপ বা তিনি কারণে বিরক্ত। আর ডিপি যদি কালো হয়? ধরে নিতে হবে যে, ওক্ কালচারের যুগে সেই ব্যক্তি এভাবেই তাঁর প্রতিবাদ জানাচ্ছেন। কিন্তু কী নিয়ে প্রতিবাদ? খুঁজুন মশাই, খুঁজুন। খুঁজেপেতে একটা বিষয়ে থিতু হতে হবে যে, কী কারণে তিনি প্রতিবাদী। তারও ইঙ্গিত মেলে তার সোশাল গেরস্থালি ভালোমতো তল্লাশি করলেই। এবার, খুঁজে পেলে ভালো। না পেলেও চিন্তা নেই। এখন, একজন প্রতিবাদ করলে কি চুপ করে বসে থাকা যায়! অতএব প্রতিবাদের সমর্থনে নিজের প্রোফাইলেও চলে এল কালো ডিপি। কেউ যদি জিজ্ঞেস করে তো তুরন্ত জবাব রেডি, ‘কী মশাই! কিছুই জানেন না দেখছি। এই হল আজকালকার বাঙালি!’ সেই নিয়ে চলল চাপানউতোর। কে কতখানি ‘ওক্’ তাই নিয়ে বিস্তর বিতণ্ডা। এর মাঝে তলিয়ে গেল আসল ইস্যুটাই। জানা গেল না– ঠিক কী ঘটেছে? কীই-বা ঘটার কথা ছিল? কী ঘটলে ভালো হত? ঘটে যাওয়ার পক্ষে-বিপক্ষে কিছুই স্পষ্ট হল না। আর যিনি এই পদ্ধতির সঙ্গে তালমিল রাখতে পারলেন না? তিনি মনে মনে পিছিয়ে পড়েছেন ভেবে মানে মানে সরে গেলেন। এই যে এত কিছু হতেই থাকল, আর হতেই চলল, এতে আসল জিনিসটার কী হল! অর্থাৎ সেই প্রতিবাদ। সে বেচারি এসবের চাপে একেবারে কোণঠাসা। আমরা নিজেদের ভাবলাম দারুণ সচেতন। একটা হেস্তনেস্ত বেশ হল। তবে, আদতে হল কী? ডিপি কালো আর তর্কবিতর্কে কি প্রতিবাদটা আসলে দানা বাঁধল? সোশাল তার খবর রাখে না। আসলে সোশালের আড়ালে থাকা মানুষগুলোও সম্ভবত সেই খবর রাখতে চান না।
তবে, তাই বলে কি আন্দোলন হবে না? সোশাল আপনাকে দিচ্ছে নির্ভেজাল নিরুপদ্রব আন্দোলনের অবসর। দিব্যি মিম বানাতে পারেন। বা অন্যের মুখের কথা মর্ফ করে কথা বসিয়ে ভিডিও বানিয়ে ছুড়ে মারতে পারেন মুখের উপর। সোশাল মিডিয়ায় দেখবেন, সবাই লুফে নিচ্ছে আর ছড়িয়ে যাচ্ছে। এছাড়াও ভদ্রোচিত লেখা লিখে আপনি প্রতিবাদ করতে পারেন সোশাল মিডিয়ায়। কিন্তু ঘুণাক্ষরেও জিজ্ঞেস করবেন না, এসবে হবেটা কী? অবশ্য একেবারেই কিছু হবে না তো নয়, লাইক হবে, শেয়ার হবে, ফলোয়ার বাড়বে। এটুকুই যদি আপনার উদ্দেশ্য থাকে তো ল্যাটা চুকেই গেল। কিন্তু যদি কাজের কাজ আশা করে বসে থাকেন, তাহলে আপনারও একসময় অনুরাগ কাশ্যপ-সিনড্রোম হতে বাধ্য। তখন আপনাকে সমক্ষে বলতেই হবে যে, ‘তরুণ প্রজন্ম যতক্ষণ না তাঁদের হাতের ফোন, ট্যাব প্রভৃতি জ্বালিয়ে দিচ্ছে ততদিন, শাসকের বিরুদ্ধে কোনও আন্দোলনই দানা বাঁধবে না।’ মুশকিল হল, সে-কথায় আপনি হয়তো সহমত হলেন। তবে সেই সমর্থনটা প্রকাশ করতেও আবার দৌড়ে আসতে হচ্ছে সেই সোশাল মিডিয়ায়। অর্থাৎ একেবারে আধুনিক অভিমন্যু, পালাবার পথ নাই!
-: আরও শুনুন :-
‘যাঃ’ মানেই ‘হ্যাঁ’! প্রেমে ডুবে মরা বাঙালির আজব কিস্সা
অতএব আমাদের ধ্যানজ্ঞানের নৌকাখানা এসে ঠেকেছে সেই সোশাল মিডিয়াতেই। বিদ্যের দৌড় হোয়াটস-অ্যাপ ইউনিভার্সিটিতেই আটকে। আপনি ফোন করে কাউকে হয়তো বলবেন আপনার পারিবারিক সমস্যার কথা। অতটা গুরুত্ব পাবে না, যদি আপনার সোশাল অ্যাকাউন্ট অন্য কথা বলে। আবার উলটোটাও সত্যি। আপনার সোশাল সিলেবাস যা বলছে, তা যে আপনি বাস্তবে হবেনই, তার কোনও মানে নেই। অর্থাৎ আপনি যা নয়, অথচ নিজেকে যেভাবে দেখাতে ছান, তার একতা রেপ্লিকা বাজারে ছড়িয়ে দিতে পারেন। আসল-নকল মুড়ি-মিছরি মিলেমিশে তখন এক জগাখিচুড়ি। এ যেন প্রতিদিন ঘটে চলা ‘দৃশ্যম’ সিনেমা। যা দেখছেন তা সত্যি না-ও হতে পারে! অথচ এইসব মুখর দৃশ্যাবলিকে যে অগ্রাহ্য করবেন তারও উপায় নেই। অতএব সোশাল হল সেই শাঁখের করাত, যা আমরা নিজেদের জীবনশৈলীতে তুলে রেখেছি আদর-যত্ন করেই।
তবে আদর-যত্ন সত্যিই দরকার। সোশাল ইমেজের নয়, নিজের, নিজের সত্তার। কেউ প্রতিবাদী হতে পারেন, না-ও হতে পারেন। কেউ বিলাসে আনন্দ খুঁজে পেতে পারেন, না পেলেও সমস্যা নেই। ঝকঝকে ক্যামেরার তকতকে ছবি কারও থাকতে পারে, না-ও থাকতে পারে। ফাল্গুন যে সকলের কাছেই পলাশের মাস হয়ে উঠবে, তার তো কোনও মানে নেই। এই মানে যে নেই সেটাই যেন আমরা আর ভাবতে পারি না। যে যেমন আছি, তা নিয়ে খুশি নই কিছুতেই। সোশাল মিডিয়া আমাদের কেমন রাখছে বা কেমন থাকতে বলছে, সেই চাপ যেন ক্রমাগত আমাদের পেড়ে ফেলেছে।
সত্যি বলতে, নিজেদের অভিমন্যু ভাবলেও, আমরা তা নই। চাইলে এই চক্রব্যূহ ভেঙে বেরিয়েও আসতে পারি। বাহিরপানে চোখ মেলার থেকে ভিতরপানে তাকাতেই পারি। সোশাল মিডিয়া আমাদের অনেক কিছুই দিয়েছে। তবু,’বড় একা লাগে’ এ-কথা বলার কোনও ইমোজি সে আমাদের হাতে আজও তুলে দিতে পারেনি, তুলে দেওয়া যায় না বলেই।