শীতের চাদরে স্মৃতির ওম। কথায় কথায় দশকাহন, বাঙালির নির্ভেজাল শীতযাপন সংবাদ প্রতিদিন শোনো-য়। বাঙালির শীত মানে কুয়াশা জড়ানো সকালে সোয়েটার আর বাঁদরটুপি পরে টিভিতে দেখা টেস্ট ক্রিকেট, আর ইডেনে শীতের দুপুরে খোলা গ্যালারির গায়ে পড়া কমলালেবু রোদ। ফেলে আসা শীতের ময়দানে হেঁটে বেড়ালেন অর্পণ গুপ্ত।
অলংকরণ: অর্ঘ্য চৌধুরী
ঘিঞ্জি ডাইনিং রুমে একটা স্টিলের শো-কেস। তার ওপর কাঠের তক্তা দিয়ে বসানো পেটমোটা সিআরটি টেলিভিশন, সঙ্গে একটা রিমোট, যা সন্তর্পণে টুলের ওপর উঠে নামাতে হবে টিভির মাথা থেকে। তারপর, আধো অন্ধকারে হাতড়ে পাওয়া ‘পাওয়ার বাটন’ চিপে, বিষণ্ণ ঝিরঝির পেরিয়ে, সাউন্ড আসার আগেই মিউট বাটনটা প্রেস করে চালিয়ে দিতে হবে চ্যানেল নাইন। ল্যাঙ্গার আর হেডেনের ওপেনিং জুটি হেঁটে হেঁটে এগোবে সবুজ সাদা কলমকারি করা ব্রিসবেনের আউটফিল্ড দিয়ে। ফার্স্ট সেশন। তখনও আলো ফোটেনি এ দেশে, শীতের সকালে আমরা মায়েরও আগে ঘুম থেকে উঠেছিলাম ওই কটা দিন। চেয়ারে পা তুলে বসে, সোয়েটার আর মাঙ্কি টুপি পরে, মুখ দিয়ে ডেঁপোমির ধোঁয়া ছেড়ে বিজ্ঞের মতো খেলাটা দেখতাম মন দিয়ে… ওই আমাদের চোখেখড়ি টেস্ট ক্রিকেটের সঙ্গে!
শীতকালে মর্নিং স্কুলের আগে, দিন আর রাতের মাঝের কুয়াশা ঘেরা অংশটায় আমাদের শৈশবের বনপাহাড়ের বুক চিরে চলে গিয়েছিল এ সিরিজখানা। বর্ডার গাভাসকর- ২০০৩-০৪। ভারতের উইকেট পড়ে যাবে দ্রুত। কিংবা হেডেন আর ল্যাঙ্গারের পর পন্টিং-মার্টিন এসে খেলে যাবে লাগাতার। বিশ্বাস না করতে চাইলেও যা অবশ্যম্ভাবী তাকে মেনে নেওয়ার জন্য মনকে প্রস্তুত করতে আমাদের শিখিয়েছিল কয়েকমাস আগে হওয়া বিশ্বকাপ ফাইনাল। কিন্তু রঙিন জামার ওয়ান ডে-র থেকে এই খেলা ছিল একেবারে আলাদা। এখানে টেস্ট তো শুধু মাঠে হত না, হত বাবার নোকিয়ার ছোট্ট ফোনে নিখুঁত অ্যালার্ম সেট করে ঘুম থেকে ওঠায়, হত কিশোরবেলার নরম মাটির ওপর পাকাপাকি ভালবাসার ছাপের নিটোলতায়। জীবনে টেস্ট শুরু হল ওই। একটু পর মা উঠে একপ্রস্থ বকুনির পর তৈরি করবে টিফিন, এসে যাবে তেচাকা ভ্যানগাড়ি। স্কুল শুরুর ঘণ্টার পর মন পড়ে থাকবে অজিত আগরকরের রান আপের কাছে… ওই শীতের ভোরে ক্রিকেট ছেড়ে স্কুল যাওয়ার মনকেমনের মধ্যে আমরা শিখেছিলাম, জীবনে ইচ্ছের কাছ থেকে অনিচ্ছের কাছে ছুটে যাওয়ার নাম আসলে দায়িত্ব। শীত তখন ফুলপ্যান্টের লাইসেন্স, সিগারেটবিহীন ধোঁয়া ছাড়ার সলজ্জ পাকামি।
-: শুনুন শীতকাতুরে অন্যান্য গল্প :-
সোয়েটারের ভাঁজে ন্যাপথালিনের বসতি
শীত শীত স্নানঘর, গ্লিসারিনের খুশবু
হাতে তখন অফুরান বেলাবেলি, আজকের জাঁতাকলের মতো জীবন থেকে ফিরে তাকালে কৈশোরকে দেখতে লাগে অনেকটা টেস্ট ম্যাচের মতোই। শীত পড়েছে জাঁকিয়ে। তাড়া নেই। অলস স্কুলফেরত দুপুরে টিভিতে দেখছি থার্ড সেশনের পড়ন্ত রোদ। পেখম মেলে থাকা বিকেলের হাতছানি। কমলালেবু খেতে খেতে বাকিটুকু খেলা দেখে মাঠের দিকে পা বাড়ানো। বেলা পড়ে আসবে দ্রুত। ভারতের হেরে যাবার নিশ্চয়তার মধ্যেই আমার কৈশোর হিরো সৌরভ গাব্বায় সেঞ্চুরি করে শুরুতেই জমিয়ে দিল সিরিজখানা। ব্র্যাকেন- গিলেসপি- স্টুয়ার্ট ম্যাকগিলের সামনে ভারতকে আর বেসামাল লাগল না। গাব্বা টেস্ট ড্র- জাহিরের ফিফার। ক্লাসে সৌমিত প্লেয়ারের নাম ভুল বলত। ম্যাকগিলকে ম্যাক হিল, বিকেলকে বিচেল, ম্যাকগ্রাকে এমসি গ্রাথ আরও কত কী! শীত এলে এই সিরিজের মতোই মনে পড়ে সৌমিতকে। মনে পড়ে রোঁয়া ওঠা সোয়েটার আর তুতলে ভুল নাম বলা সৌমিত শুধু নাম নয়, আরেকটা মারাত্মক ভুল করেছিল ছাদের কার্নিশে বেখেয়াল হয়ে। ওপর থেকে পড়ে থেঁতলে গেছিল মাথাটা। ব্যান্ডেজে মোড়া সৌমিতকে আমরা দেখিনি কেউ। আমাদের সেই শীত ডিঙিয়ে, মখমলের মতো ভেলভেট ফুল আর কৃষ্ণচূড়ার লাল নিয়ে একে একে খান কুড়ি বসন্ত এসে গেছে, সৌমিত এই কর্কটক্রান্তির দেশে শীতকালের ভেতর গুটিসুটি মেরে রইল ঠিক, আর একটা অমীমাংসিত টেস্টের একমাত্র দর্শক হয়ে আজীবন থেকে গেল গ্যালারিতে।
অ্যাডিলেডে দ্রাবিড়-লক্ষ্মণ যেদিন তিনশো রানের পার্টনারশিপ গড়ছে, আমাদের ভেঙে যাওয়া বন্ধুত্বের শেষ স্মৃতিচিহ্ন নিয়ে চলে যাচ্ছে শীতকাল। ডিসেম্বর ফুরিয়ে আসতেই শীতের কামড় কমে গেল সেবার। ভারত জিতলেও আমরা জিততে পারিনি। মেলবোর্নে হেরে যাবার পর মনে হয়েছিল, এটা না হলে অন্যায় হত বোধ হয়। শেষ টেস্ট সিডনিতে। জিততে চেয়েছিলাম খুব। শচীনকে দেখে এমআরএফ স্টিকার লাগিয়ে নতুন ব্যাট কিনেছিল শুভায়ু। আমাদের ক্ষণস্থায়ী দুঃখের পর ওই একটা ব্যাট নিয়ে কাড়াকাড়ি দেখে বুঝেছিলাম শীতের রোদ কত ব্যথার যে উপশম!
ভারত জেতেনি। জিততে জিততেও শেষ বেলায় স্টিভ জীবনের শেষ ম্যাচে হিসেব উলটে দিয়েছিল। সিরিজ ড্র !
অজয় বসুর গলা, ইডেনে শীতের দুপুর, খোলা গ্যালারির গায়ে কমলালেবুর মতো রোদ, গাভাসকরের ব্যাটে লাল কোকাবুরার সম্মোহনী চুম্বন… কোনও কিছুই দেখা হয়নি আমাদের। দ্বাদশ ব্যক্তি আমরা, সবেধন নীলমণি কেবল একটা শীতের টেস্ট সিরিজ। গাব্বায় সৌরভের ১৪৪, আগরকরের অবিশ্বাস্য স্পেল, দ্রাবিড়ের অতিমানবিক ২৩৩, পন্টিং-এর চুম্বক ব্যাটে মেলবোর্নে হার, স্টিভের অস্তরাগে গোলাপি গ্যালারি, আর সেই মঞ্চেই সচিনের কভার ড্রাইভের লোভকে নিয়ন্ত্রণ করে বিশ্বকে চমকে দেওয়া সিডনির ইনিংস… টুকরো টুকরো হাসিকান্নার কোলাজের যোগফলে ড্র হয়ে গিয়েছিল সিরিজটা। সারাজীবনে বহু ঝলমলে জয়, বিষাদমাখা পরাজয়ের পরেও একটা ড্র হয়ে যাওয়া টেস্ট সিরিজ অমোঘ হয়ে থেকে গেল জীবনের কুঠুরিতে। কারণ, সেই ড্রয়ের ভেতর শুভায়ুর তেলতেলে এমআরএফ ব্যাটটা দোলে, আমাদের উচ্ছ্বাস ওড়ে ফানুসের মতো, আর ভাসে সৌমিতের হাসি হাসি মুখ… টেস্ট আমাদের শেখায় এ দুয়েরই কোনও ক্ষয় নেই, লয় নেই। অলস হেঁটে চলে বেড়ানো আছে। থার্ড সেশনে মিড উইকেটে দাঁড়িয়ে থাকা ফিল্ডারের মতো, আবহমান অপেক্ষা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা…
পিছনে ফিরে তাকালে দেখি আমাদের সেই ভোরগুলোয় শীতের রোদ উঠে আনাচেকানাচে ছড়িয়ে দিয়েছে আলো- কুঠুরি কুঠুরি ভরা রাত হয়ে গেছে দিন। সে ফেলে আসা মায়াপুরী, স্মৃতির সাতমহলা বাড়ি, সবকিছু ঝলমল করছে এখন। টক কমলালেবুর কোয়া মুখে পড়ার চেনা বিরক্তি টেনে টেনে বড় হয়ে যাওয়াটা আজকাল ভাল লাগে না। মনে হয়, এখনকার মতো সাবলীল শীত, ডিসেম্বরের আলো-আলো পার্ক স্ট্রিট, জ্যাকেটের ওমের বাইরে শীতের যেসব পুরোনো ফাটাফুটি, রুক্ষ-শুষ্ক ত্বকের ওপর চেসমি গ্লিসারিনের প্রলেপ দেওয়ার দিন, কমলালেবুর খোসা ছাড়াতে ছাড়াতে চোখে ছিটকে লাগার জ্বালা, অ্যানুয়াল পরীক্ষার জন্য তাক থেকে পেড়ে নেওয়া ছাত্রবন্ধু, কুয়াশার মধ্যে দিয়ে ছুটে আসা বন্ধু- যার সঙ্গে হয়তো কোনও দিন আর দেখা হবে না, শীতকাল এলে সেই পাওয়া না-পাওয়া, দেখা না-দেখার ভেতর জোনাকির মতো থাকবে জীবনে দেখা প্রথম টেস্ট সিরিজ। জেতা আর হারার মাঝে যে শীতকাল, যেখানে এখনও কুয়াশার ভেতর এক অনন্ত টেস্ট ম্যাচ হয়ে চলেছে, দর্শকহীন- উচ্ছ্বাসহীন- যার ফলাফল নেই, জয় পরাজয়ের বাইনারি নেই, আছে কেবল মুহূর্ত- শীতকাল এসবটুকু নিয়ে চলে যাবে কদিন পর। আবার ফিরে আসবে। কতজন্মের স্মৃতি নিয়ে শীতকাল ফিরে ফিরে আসে…