শীতের চাদরে স্মৃতির ওম। কথায় কথায় দশকাহন, বাঙালির নির্ভেজাল শীতযাপন সংবাদ প্রতিদিন শোনো-য়। শীত মানেই গড়িয়ে যাওয়া উলের বলের করিডর। ‘শীতকাতুরে’ বাঙালিকে সেই সোয়েটার-নস্টালজিয়ায় ফেরালেন বিশ্বদীপ দে।
অলংকরণ: অর্ঘ্য চৌধুরী
শীতকাল কবে আসবে? আজকাল একথা সুপর্ণাও জানে না বোধহয়। সারা বছর রোদ-বৃষ্টি-মেঘের রাজত্ব। কিন্তু হেমন্ত পড়ে গেলেও ঠান্ডার যেন আর দেখাই নেই! অপেক্ষা ক্রমে পড়ন্ত বেলার ছায়ার মতো দীর্ঘ হতে থাকে। তাই যখন একবার আসে, তখন শীতের সবটুকু ধরে রাখতে ইচ্ছে করে। সেই সঙ্গে তার সঙ্গে মিশিয়ে দিতে সাধ হয় ফেলে আসা শীত, ফেলে আসা অবসরের দিনকালও। স্মৃতির কুয়াশায় এক দীর্ঘ চরাচর ফুটে উঠতে থাকে স্বপ্নের আবহদৃশ্যের মতো। মনের ভিতর বাতিল রেডিও জ্যান্ত হয়ে গেয়ে ওঠে চিরচেনা জিঙ্গল, এল শীতের শুষ্ক দিন…
আর অমনি গড়িয়ে আসে তারা। সেই যে আমার নানা রঙের উলগুলি। হলুদ, লাল, সবুজ, নীল— রকমারি রঙের উল সব। সত্যি সত্যি নয় স্মৃতিতে। আলমারির ভিতরে লুপ্ত কোনও মহাদেশে ছোটবেলার সোয়েটাররা চুপ করে ঘুমিয়ে আছে ন্যাপথালিনের গন্ধ মেখে। আজও বাড়িতে কোনও ছোট্ট সদস্যের আবির্ভাব হলে যাদের ডাক পড়ে। এখন আর কেউ সোয়েটার বোনে না। কিন্তু কবেকার বুনে রাখা সোয়েটারগুলো? সেগুলি আজও রয়ে গিয়েছে যে! জাফরি কাটা বারান্দায় এসে পড়া কবেকার রোদ এখনও লেগে আছে সেই সব সোয়েটার ও মাফলারে। ন্যাপথালিনের সাধ্য নেই তাকে মলিন করে দেয়। আকাশে এমন অনেক তারা আছে যাদের শেষ আলো এখনও পৃথিবীতে আসছে, কিন্তু সেই তারাগুলো আসলে ‘নেই’ হয়ে গেছে। ঠিক এই সোয়েটারগুলোর মতো। যাঁর বোনা, তিনি আর নেই, কিন্তু তাঁর আঙুলের স্পর্শ রয়ে গিয়েছে।
আরও শুনুন: শীত শীত স্নানঘর, গ্লিসারিনের খুশবু
একটা একটা করে ঘর তোলা। ভুল হলে ঘর ফেলা। নির্মাণ আর বিনির্মাণের মধ্যে দিয়ে শীতের দুপুর কিংবা আবছা সন্ধের নিরলস অবসরে তৈরি হত সোয়েটার, মাফলার। মেশিনের নৈপুণ্য নয়, সেই সব শীতপোশাকের ঘর পড়ে যাওয়া ফাঁকে যেন রাখা আছে লুকনো চিঠি! হারানো দিনের চিঠি সব। হলুদ পোস্টকার্ড আর নীল ইনল্যান্ড লেটারের শরীর জুড়ে পেনের আঁচড়ে লেখা পুরোনো পৃথিবীর গল্পের মতো। চিঠি আর সোয়েটার দুইয়েরই গায়ে লেগে থাকত অপেক্ষার গন্ধ। একটা সোয়েটার বোনা হচ্ছে। সেই নির্মাণের সঙ্গে জড়িয়ে মড়িয়ে থাকত অনেকটা যত্ন আর আদর। কিছুটা বুনেই মেপে দেখা। আবার বোনা। বুনতে বুনতে হয়তো সেবারের শীতই চলে গেল! অর্থাৎ গায়ে উঠতে উঠতে আবার পরের বছরের অপেক্ষা। তা হোক। সেই চিঠি আর রেডিও, বালিশের নিচে রাখা লাইব্রেরির বইয়ের যুগে এত ব্যস্ততার হিড়িক ছিল না মানুষের।
রোদে দেওয়া জমে যাওয়া নারকেল তেলের মতো একটা আশ্চর্য সময় তখন চারদিকে ম ম করছে। হ্যাঁ, অফিসে লেট না হতে চেয়ে ভিড় বাস-ট্রাম-ট্রেনে ঝুলে পড়া ছিল। স্কুলে প্রেয়ার শুরুর আগে ঢুকতে না পারলে মার, তাই ব্যাগ কাঁধে হুড়মুড়িয়ে দৌড়ও ছিল। কিন্তু সেই সব দ্রুততার সমান্তরালে অপেক্ষা আর অবসরও থাকত। অপেক্ষার মুহূর্তগুলোয় নানা সম্ভাবনার তুলোবীজ নিঃশব্দে উড়ে বেড়াত। দৈনন্দিতার ফাঁস গলায় লাগিয়েও সময়ে সময়ে তা খুলে ফেলে মানুষ স্থির হতে জানত। আর বয়স্ক মানুষেরা জানতেন আগামী সময়ের জন্য আদর বুনে রাখতে।
মনে পড়ে ধুনুরিদের? শীত পড়তে শুরু করার আগে আগেই যাদের আশ্চর্য যন্ত্রের আওয়াজ ভেসে আসত রাস্তা থেকে। তাদের ডাক দিলেই তুলতুলে লেপ তৈরি হয়ে যেত খোলা উঠোনে কিংবা ছাদে। পাটালি গুড়, ক্যাম্বিস বলে ক্রিকেটের মতোই শীতের সঙ্গে এই লেপের ওমের বড়ই নিবিরতা। ধুনুরিরা আজও লুপ্ত হননি বটে। তবে দোকানবাজার, শপিং মলের সুদর্শন সম্ভার ছেড়ে তাঁদের খুব বেশি মানুষ ডাকেন কি? উল বোনা দিদা-ঠাকুমাদের মতো ক্রমেই হাওয়ায় মিলিয়ে যাচ্ছে ধুনুরিদের সঙ্গে থাকা যন্ত্রটির টঙ্কারও।
কিন্তু কিছুই হারায় না আসলে। থেকে যায়। পুরনো দিনের লেপ-কম্বল হোক বা যত্নে বোনা সোয়েটার, হাতে একবার তুলে নিলেই নস্টালজিয়া। চোখের সামনে প্রজেক্টর মেশিন চলতে শুরু করে। রোদ পোয়াতে বসে একটা পুরনো পৃথিবী। কেবল বৃদ্ধা কিংবা মধ্যবয়স্কারা নন, বাড়ির অবিবাহিতারাও কৌতূহল আর ভবিষ্যতের গিন্নিবান্নি হওয়ার স্বপ্নে বুঁদ হয়ে আঙুলে জড়াতেন নরম উল। প্রথমে ঘর তোলা শেখা। তারপর ছাদে উঠে একটু একটু করে কিছু একটা বুনে তোলার চেষ্টা। পাশের ছাদের কোনও কৌতূহলী দৃষ্টির সঙ্গেও কি ঘর বোনা শুরু হত? হারানো শীতের আনমনা বাতাস সেসব খবর লুকিয়ে রেখেছে আধবোনা শীতপোশাকে। আজও সেখানে ফুরনো সময়ের জলছাপ জমে আছে।
গবেষকরা বলছেন, উল বুনলে মনের স্বাস্থ্য ভালো থাকে। হতাশা, উদ্বেগ দূর হয়। শারীরিক ব্যথাও নাকি পাত্তা পায় না। আসলে মন ক্রমেই নির্ভার হয়ে উঠতে থাকে। এমনকী স্মৃতিভ্রংশের অসুখেও দারুণ কাজে দেয় ঘর তোলা, ঘর ফেলার অভ্যেস। এক ব্রিটিশ জার্নালে প্রকাশিত এমনই এক গবেষণাপত্রের দাবি, উল বুনতে শুরু করার পর অনেকেই নাকি আগের থেকে ভালো থাকতে শুরু করেছেন! মস্তিষ্কে সেরোটোনিন হরমোনের নিঃসরণ হৃদযন্ত্রকে সুস্থতা দিয়েছে। ভাবতে অবাক লাগলেও গবেষকরা তেমনই বলছেন।
আরও শুনুন: শীতকাল এলেই বোরোলীনের সংসার
কিন্তু আমাদের সময় কোথায়? সময়ের হাতে নিজেকে সঁপে দিয়ে চুপ থাকার দিন শেষ। ব্যস্ততার ফাঁকে মোবাইলের স্ক্রিনে হরেক রকম রিলস আর বিবিধ মশলার পসরা অপেক্ষা করছে যে। উল বোনায় তাই মতি নেই কারও। তবে এটা এআইয়ের যুগ। যেভাবে বাড়ছে তার দৌরাত্ম্য, একদিন সে হয়তো আপনার হয়ে উলও বুনে দেবে। সঙ্গে দেবে দিদা-ঠাকুমার স্নেহের নকল পরশ। কিন্তু সেই ফাঁকির বুননে ঘর পড়া ফাঁক থাকবে তো? যন্ত্রের নিখুঁত চলন পারবে তো সেই ত্রুটিগুলো নির্মাণ করতে? কে জানে, তা হয়তো পেরে যেতেও পারে। তবু কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বোধহয় ফেলে আসা পশমের ওমের ধারেকাছেও কোনওদিন যেতে পারবে না। আমরা পুরোপুরি যন্ত্র হয়ে ওঠার আগে পর্যন্ত তাই শীত মানেই গড়িয়ে যাওয়া উলের বলের করিডর বেয়ে দিগন্তের দিকে পাড়ি দেওয়া।