শীতের চাদরে স্মৃতির ওম। কথায় কথায় দশকাহন, বাঙালির নির্ভেজাল শীতযাপন সংবাদ প্রতিদিন শোনো-য়। শীত মানেই মখমলি রোদ্দুরে স্মৃতির আনাগোনা। ‘শীতকাতুরে’ বাঙালিকে নরম রোদ পোহানো সেইসব মফসসলের দিনকালের গল্প শোনালেন জয়াশিস ঘোষ।
অলংকরণ: অর্ঘ্য চৌধুরী
আমি তখন কালিম্পং-এ। বাবাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, “তোমার জন্য কী নিয়ে আসব?” বাবা বলেছিলেন, “তোর বারান্দা থেকে একটু রোদ নিয়ে আসতে পারিস?” আনতে পারিনি। মফস্সলের ছাদ তখন উঁচু হতে শুরু করেছে। একের পর এক বাড়ি ভেঙে উঠছে হাই-রাইজ। আটকে দিচ্ছে শীতের মখমলি রোদ।
ওই রোদের লোভে বসে থাকত মফসসল। হেমন্তের শেষ থেকেই বাতাসে ভাসত কড়াইশুঁটির ঘ্রাণ। বের করা হত তোরঙ্গ খুলে শীতের চাদর, সোয়েটার, লেপ, কম্বল। দুধের সরের মতো কুয়াশার জাল ছিঁড়ে উঁকি দিত রোদ। রেডিওতে ভেসে আসতেন মান্না দে ‘ওই মহাসিন্ধুর ওপার থেকে…’। মফসসলের ছাদ, উঠোনগুলো সোয়েটার, চাদরের রঙে রঙিন হয়ে যেত। আর মরশুমি ফুলের মত টাটকা হয়ে উঠত স্মৃতি। সমরেশ জ্যেঠু মারা গিয়েছেন, কতদিন হল– কিন্তু প্রতি শীতে জেঠিমা তার প্রিয় চাদরটি বের করে রোদে দিতেন। মাঝে মাঝে হাত বোলাতেন। শীতের রোদের নরম উষ্ণতায় মিশে যেত জ্যেঠুর স্পর্শ।
এমনই ম্যাজিক নিয়ে আসত শীতকাল। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ‘একটি শীতের দৃশ্য’ কবিতায় বলেছেন– ‘মায়া-মমতার মতো এখন শীতের রোদ/ মাঠে শুয়ে আছে/ আর কেউ নেই।’ তখন অবশ্য শীত আসত উৎসবের মেজাজে। ভোর ভোর জিরেন কাঠের রস নিয়ে আসত ইসমাইল চাচা। বাবাও বলত চাচা, আমরাও। চাচাদের বয়স বাড়ে না। এক-দু গ্লাসে মন ভরত না। ভেতর থেকে মা চেঁচাত– ‘পেট ছাড়বে’। বাবা বলতেন– ‘শীতের প্রথম রস অমৃত। শরীরের জন্য উপকারি’।
তবে অমৃতের গন্ধ পাওয়া যেত বেলা বাড়লে। সে যে কত রকমের পিঠে! চিতই পিঠে, গোকুল পিঠে, দুধ-পুলি, পাটিসাপটার গন্ধ পাওয়া যেত পাড়ার গলি, মাঠ, পুকুরের পাড় ঘিরে। রোদ ওঠার সঙ্গে সঙ্গে আমরা শতরঞ্চি আর বই-খাতা নিয়ে চলে যেতাম ছাদে। পড়াশোনা আর রোদ পোহানো চলত একসঙ্গে। তার সঙ্গে রোদ পোহাত অনেক রকম আচারের বয়াম। মা কলাইয়ের ডালের বড়ি দিতেন। পড়ার ফাঁকে ফাঁকে পাখি তাড়ানোও কাজ ছিল। পড়ার আওয়াজ বন্ধ করলেই নীচ থেকে মায়ের চিৎকার ভেসে আসত।
-: শুনুন শীতকাতুরে অন্যান্য গল্প :-
সোয়েটারের ভাঁজে ন্যাপথালিনের বসতি
শীত শীত স্নানঘর, গ্লিসারিনের খুশবু
মা তখন রোদ পোহাতে পোহাতে উঠোনে কাঠের উনুনে রান্না করতেন পাঁচমেশালি তরকারি। আর আমরা পড়তে পড়তে অপেক্ষা করতাম কখন মায়ের রান্না হবে আর সেই রান্না তোলার পর কড়াই চেঁছে খুন্তির আগায় লেগে থাকা কালোর কাছাকাছি সেই পরম স্বাদের বস্তুটির ভাগ পাব। এই তরকারি হত স্টক ক্লিয়ারেন্স। পালং শাক, কুমড়ো, বেগুন, মুলো, মিষ্টি আলু– যা শুকিয়ে যাচ্ছে বা পেকে যাচ্ছে সেইসব সবজিকে ম্যাজিক লাঠি বুলিয়ে দিতেন মা। শেষে বড়ি ভেঙে দিতেন। কী স্বাদ তার! চাঁছিতে লেগে থাকত শীতের রোদ, মায়ের আঁচলের হলুদের গন্ধ, উনুনের ধোঁয়া আর রেডিওতে ‘শনিবারের বারবেলা…’
রান্না হয়ে গেলে স্নান সেরে বাড়ির মহিলারা সবাই ছাদে চলে আসতেন চাদর গায়ে দিয়ে। বাচ্চাদের তেল মাখিয়ে রোদ খাওয়ানো হত। প্রসেনজিতের বিয়ে হল কি না, অমিতাভ-রেখা থেকে শুরু করে পাড়ায় কে প্রেম করছে– গল্প করত সবাই। ছাদের অন্যদিকে বসত বাবাদের শীতকালীন তাসের আসর। ঠাকুমা কমলালেবুর খোসা ছাড়িয়ে একটা দুটো করে কোয়া দিতেন সবাইকে। অতসী মামি খেত-এর কড়াইশুঁটি নিয়ে আসতেন। ছাড়িয়ে রাখা হত একটি পাত্রে। আমরা মুঠো ভরে তুলে খেতাম মিষ্টি কড়াইশুঁটির দানা। আর রোদ খুঁটে খেত শালিকযুগল। মাঝে মধ্যে তাদেরও কড়াইশুঁটি বা চালভাজা ভাগ্যে জুটে যেত। ঠাকুমা বলতেন, ‘ওরা অতিথি’। বলতে বলতে গল্প বলতেন বরিশালের জমিদারি নিয়ে। শালিকের একটি উড়ে গেলে শিউলিদির মন খারাপ হয়ে যেত। ‘জোড়া শালিক নমষ্কার, এক শালিক উড়ে যা’– আমরা চেঁচাতাম।
শিউলিদির হাঁটু পর্যন্ত চুল ছিল। শ্যামবর্ণ গায়ের রঙের জন্য পাত্রপক্ষ বাতিল করে দিত। রাঙাজ্যেঠি শীতের রোদে বসে চুলে নারকেল তেল লাগাতেন আর বিড়বিড় করতেন– ‘কতবার বলি ছাদে আসবি না। রোদে আরো কালো হয়ে যাবি। এমনিতেই আমার জ্বালা কী কম?’ শীতের নরম রোদে বসে সেইসব জ্বালা, যন্ত্রণা, অভিমান ভাগ হয়ে যেত মফস্সলের ছাদে।
আর এই রোদ পোহানোর আসরে দুই চোখ এক হয়েও যেত। বাবলুদার ইমিটেশনের ব্যবসা ছিল। হার, কানের দুল নিয়ে আসত ছাদে। রোদ পোহাতে পোহাতে মা-মাসিরা সেগুলো নেড়েচেড়ে দেখতেন– “ বাবলু, দিন কে দিন তো ডাকাতি শুরু করেছিস!” রেডিওতে গান গাইতেন আরতি মুখোপাধ্যায়– ‘যদি আকাশ হত আঁখি, তুমি হতে রাতের পাখি/ উড়ে যেতে যেতে আবার কোথাও দেখা হত নাকি’। আমরা জানতাম বাবলুদা শিউলিদিকে ভালোবাসে। শিউলিদিও কি…?
জানতে পারিনি। বাবলুদার বিনে পয়সায় দেওয়া একটি হার একবার রাঙাজ্যেঠি পেয়ে গেছিলেন। বাবলুদার গায়ের ওপর টাকা ছুড়ে দিয়ে বারণ করেছিলেন আর না আসতে। এরকমই এক শীতের দিনে শিউলিদির বিয়ে হয়ে গিয়েছিল বয়সে অনেকটা বড় এক পাত্রের সঙ্গে। বাবলুদার বিয়ে হয়নি।
শীতের রোদ পোহানোর মফসসলে আর নারকেল তেলের গন্ধ পাওয়া যায়নি কখনও। জোড়া ভেঙে একটা শালিক বসে থাকত চুপ করে…