শীতের চাদরে স্মৃতির ওম। কথায় কথায় দশকাহন, বাঙালির নির্ভেজাল শীতযাপন সংবাদ প্রতিদিন শোনো-য়। আর বাঙালির শীত মানেই মেলার আসর। বঙ্গসংস্কৃতির এই অবিচ্ছেদ্য আয়োজনকে ফিরে দেখলেন সৌভিক রায়।
অলংকরণ: অর্ঘ্য চৌধুরী
আবহমান বঙ্গ সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হল মেলা। কালে কালে এর জনপ্রিয়তা এতটাই বেড়ে গিয়েছে যে, বাঙালির প্রতিটি উৎসব ঘিরেই এখন মেলার আয়োজন করা হয়। মূলত কার্তিক-অগ্রহায়ণ থেকে মাঘ অবধি, এই শীতের সময়টাতেই মেলার আয়োজন বেশি হয়। পল্লিবাংলার অর্থনীতির অন্যতম প্রধান ভিত্তি মেলা, তবে আয়োজনের নেপথ্যে রয়েছে আর্থসামাজিক ও ধর্মীয় কারণ। একেবারে প্রান্তিক বাংলায় ধর্ম ঠাকুরের মেলা হোক বা খাস কলকাতার বুকে বইমেলা; মেলার আদত উদ্দেশ্য বাণিজ্যই। হতে পারে অধিকাংশ মেলার উৎপত্তি হয়েছে ধর্মীয় উৎসবকে কেন্দ্র করে কিন্তু মেলা যে বিকিকিনির বৃহত্তর ক্ষেত্র তা অস্বীকার করা যায় না। আড়াইশো বছর আগে পুরাতন মালদহের ঐতিহ্যবাহী চারু শেঠের মেলা শুরু হয়েছিল স্থানীয় মানুষদের বানানো কাঠের জিনিস বিক্রির জন্য। এই ব্যবসা-বাণিজ্যই শতাব্দীপ্রাচীন মেলাগুলোকে বাঁচিয়ে রেখেছে। আজ ‘ভোকাল ফর লোকাল’ নিয়ে দেশজুড়ে এত প্রচার চলছে। কিন্তু বাংলার মেলাগুলো এ জিনিস বহুকাল ধরে করে চলেছে। স্থানীয়রা নিজের হাতে বানানো কাঠের হাতা, খুন্তি, ডালের কাঁটা, বটি, বেলন-চাকি, কাঠের পিঁড়ি নিয়ে মেলায় আসেন, বেচেন। মাটির জিনিস, বেতের জিনিস, হাতে আঁকা পট বিক্রির বাজার পান স্থানীয় শিল্পীরা। স্থানীয় পণ্যের জন্য মেলার চেয়ে ভালো বাজার আর অন্য কিছু হতে পারে না, এখানেই মনে হয় গ্রামীণ হাট থেকে মেলা প্রতিষ্ঠানিক রূপ পেয়েছে।
বাংলার সঙ্গে মেলা এমন ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গেল কী করে?
-: শুনুন শীতকাতুরে অন্যান্য গল্প :-
সোয়েটারের ভাঁজে ন্যাপথালিনের বসতি
শীত শীত স্নানঘর, গ্লিসারিনের খুশবু
বাংলার ভক্তি আন্দোলন বঙ্গের মেলা সংস্কৃতিকে প্রভাবিত করেছে। এ রাজ্যের অন্যতম দুই প্রাচীন মেলা, পানিহাটির দণ্ডমহোৎসব অর্থাৎ দই-চিঁড়ের মেলা এবং মালদহের রামকেলির মেলা দুটোর বয়স পাঁচশো বছরের বেশি। দুই মেলাই শুরু হয়েছে শ্রীচৈতন্যের ভক্তি আন্দোলনকে কেন্দ্র করে। এমনকি হুগলির মাছের মেলাও বৈষ্ণব সংস্কৃতির দান। প্রতিবছর পয়লা মাঘ হুগলির কৃষ্ণপুরে মাছের মেলা বসে। হরেকরকম মাছের পসরা সাজিয়ে হাজির হন মাছ ব্যবসায়ীরা। শোনা যায়, চৈতন্য মহাপ্রভুর প্রধান শিষ্য বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী নীলাচল থেকে ফেরার পথে কৃষ্ণপুরে একদিন রাত কাটিয়েছিলেন। তারপর মেলার প্রচলন হয়। মাহেশের রথের মেলা, জয়দেবের মেলা, গঙ্গাসাগর মেলা, গাজনের মেলা, কোচবিহারের রাসমেলা; এই সবগুলোই বাংলার অন্যতম প্রাচীন মেলা। প্রতিটিই শুরু হয়েছে ধর্মীয় উৎসবকে কেন্দ্র করে। মেলার নেপথ্যে রয়েছে ভগবানের প্রতি ভক্তের ভক্তি, কোথাও সেটা কৃষ্ণপ্রেম, কোথাও শিবের প্রতি ভক্তি, কোথাও আবার জগন্নাথের উৎসব। তবে বৈষ্ণব সংস্কৃতি মেলাকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করেছে।
জমিদার, রাজা-মহারাজা, ভূস্বামীরাও বহুক্ষেত্রে মেলার সূচনা করেছেন। আপাততভাবে সেগুলোর জন্ম উৎসব উপলক্ষ্যে মনে হলেও, আড়ালে ছিল অন্য কারণ। যেমন, গোবরডাঙার গোষ্ঠ বিহার মশলা মেলা। মেলার বয়স দুশো বছরের বেশি, পয়লা বৈশাখে মেলাটি বসে। মনে হতে পারে নতুন বছর উপলক্ষে মেলা। আদতে এটি ছিল খাজনা আদায়ের কৌশল। জমিদাররাই মেলার প্রচলন করেছিলেন। বাংলা নববর্ষের প্রথম দিনে কৃষকরা জমির উৎপাদিত ফসল মেলায় এসে বিক্রি করে জমিদারের খাজনা মিটিয়ে যাবেন, এই উদ্দেশ্য নিয়েই শুরু হয়েছিল মেলা। জমিদারি প্রথা অবলুপ্ত এখন। তবুও মেলা চলে আসছে। কারণ একটাই, বিকিকিনি।
প্রান্তিক মানুষের উৎসব বলতে কেবল মেলাই, সেটিও মেলা প্রসারের আরেকটি কারণ হতে পারে। বাঁকুড়ার কেঞ্জাকুড়ার সুপ্রাচীন মুড়ি মেলা যেন সেই সাক্ষ্য বহন করে। প্রতি বছর মাঘের ৪ তারিখ, দ্বারকেশ্বর নদের চরে মুড়ির মেলা বসে। চপ, আলু সেদ্ধ, ছোলা, মটর, চানাচুর ইত্যাদি দিয়ে মুড়ি মেখে, দ্বারকেশ্বরের তটে বসে মানুষজন তা খান। এ জিনিস নিছক আনন্দ ছাড়া আর কিছুই নয়। দুই ২৪ পরগণার প্রান্তিক এলাকায়; মিনাখাঁ, সুন্দরবন, জয়নগর ইত্যাদি অঞ্চলে ভাদ্রর শেষে বাইচ প্রতিযোগিতা হয়। ধান রোপণের পর গ্রামের কৃষিজীবীদের অবসরের সময় বাইচ প্রতিযোগিতাকে কেন্দ্র করে মেলা বসে।
তবে কারণ যাই হোক, আদত উদ্দেশ্য সেই বেচাকেনা। স্থানীয় অর্থনীতিকে দৃঢ়তা দেওয়া। এই একটি মাত্র কারণ যা মেলাকে টিকিয়ে রেখেছে। হয়তো মেলার রূপ বদলেছে, মেলা আধুনিক হয়েছে অনেক, কিন্তু উদ্দেশ্যটি একই রয়ে গিয়েছে। বাঙালি খাদ্যরসিক, তাই হালে খাদ্যমেলা, পিঠে-পুলি মেলার আয়োজন বেড়েছে। কর্মব্যস্ত বাঙালির আর নারকেল কুরিয়ে পিঠে বানানোর সময় নেই, তাই মেলার ভাপা পিঠেতেই রসনা তৃপ্তি ঘটছে। অন্যদিকে, গ্রামের মা-ঠাকুমারা পিঠে বানাতে এসে রোজগার পাচ্ছেন। সরকার আয়োজিত হস্তশিল্প মেলায় শিল্পীরা উপার্জন পাচ্ছেন। গ্রামীণ অর্থনীতির চালিকা হয়ে ওঠাই এ যুগেও মেলার অস্তিত্ব বজায় থাকার কারণ।