শীতকালীন অধিবেশনে হাফ সোয়েটার বরাবরের বিরোধী দল। ঠিক যেন লেসার ইভিল, মানুষ যাকে চায় কিন্তু মানুষকে রেহাই দেওয়া তার কম্ম নয়। বড়জোর ওয়াকআউট করেই তার জনপ্রতিনিধির কর্তব্য সারা, ফাঁকতালে ধ্বনিভোটে একাধিপত্যের বিল পাশ করিয়ে নেয় শীত। শীতের পলিটিক্সে হাফ সোয়েটারের সেই আলতো আনাগোনার মিনিটস লিখে রাখলেন সরোজ দরবার। শোনালেন শঙ্খ বিশ্বাস। ছবি: দীপঙ্কর ভৌমিক।
সোয়েটার শীতের শ্রেণিশত্রু। হাফ সোয়েটার মানুষের। শীত সে ঠেকায় না, মানুষকে ঠকায়। শীতের সংসদে গত অধিবেশনে যে তিনটি বিল পাশ হয়েছিল– এক, মানুষের কান ঘেঁষে বেরিয়ে যাওয়া যাতে সে কেঁপে ওঠে; দুই, গলা জড়িয়ে গলা ব্যথা করে দেওয়া; এবং তিন, হাতের পাতা ঠান্ডায় জমিয়ে দেওয়া – তিন বিলেই ওয়াকআউট করে হাফ সোয়েটার। মানব-স্বার্থের বিরোধী, অথচ মানুষের গায়ে সেঁটে থেকেও সে শুধু আপত্তিকর স্লোগান দিতে দিতে সংসদ ছেড়েছিল। শীতের তাতে বয়ে গেছে! ধ্বনিভোটে সব বিল সে পাশ করিয়ে নিয়েছে। তারপর প্রত্যাশামতো মানুষকে কবজা করতে রাস্তায় নেমেছে। এমনকী ঠিক হয়ে আছে যে, অন্য দেশের বিশেষ শীত চাইলে শীতদেশের নাগরিক হওয়ার আবেদন করতে পারে। তা মান্য হবে। আর সব জেনেশুনে হাফ সোয়েটার, চোখ ঠার দিয়ে যেন শীতের বিরোধিতা করে চলেছে সমানে। এই রঙ্গ চলছে তো চলছেই। অথচ মানুষ বুঝবে কেন!
সবথেকে সমস্যা তো মানুষকে নিয়েই। হাফ সোয়েটার জানে। শীতের জামা বলে তাকে ন্যাপথালিন দিয়ে বছরে এগারো মাস তুলে রাখে মানুষ। গরমের জামা তোলা থাকে সাকুল্যে মাসখানেক। তা গোলেমালে পিরিত করলে যা হওয়ার তা-ই তো হবে। মানুষের আর একটু বিচক্ষণ হওয়া উচিত ছিল। বছরভর সে মেতে থাকবে রাজনীতিতে। আরে, ভোট দিয়ে কি শীত আটকানো যায়! তাহলে কবেই মানুষের দুর্দশা মিটে যেত। তা ছাড়া কস্মিনকালেও কোনও মন্ত্রী– সে তিনি মুখ্য হোন বা গৌণ– শীত পরিদর্শনে বেরোন না। আপনি কখনও শুনবেন না এমন খবর যে, ভারী শীতে ঠান্ডামগ্ন সাত জেলা আকাশপথে ঘুরে দেখবেন মন্ত্রী। এসব বর্ষায় হয়। বর্ষায় জলের অভাব নেই, মানুষের ছলের। ছুতোনাতায় সে শীতকে খানিক হেয় করে। শীতের জামাকেও। হাফ সোয়েটার মনে করে, শীতে কাজে লাগলেও মানুষের মাঝে মাঝেই সোয়েটার বের করা উচিত। কারণ সোয়েটার একরকমের শীতনৈতিক চর্চা। তাতে শান না দিলে বিপদ। খবরের কাগজ কিংবা চায়ের দোকানের ঠেক থেকে শীত বিষয়ে জেনে কেউ যদি শীতোদ্ধার করতে নামেন, তাহলে শীত তো থাবা বসাবেই। সোয়েটার তাই আর একটু মনোযোগ দাবি করে। মানুষ যদি তা করত তাহলে লেসার ইভিল হাফ সোয়েটারের দরকারই পড়ত না। সোয়েটারকে মানুষ এতটা দূরে সরিয়ে রাখে যে, হাফ দিয়ে কাজ চালাতে চায়। হাফ টিকিট, হাফ প্যাডেল, হাফ সোয়েটার- সবকিছুর মধ্যেই এক ধরনের ছেলেমানুষি আছে। মানুষ তা করে বলেই শীতের বাড়বাড়ন্ত। হাফ সোয়েটার যা কি-না হাফ হাতা সোয়েটার, অর্থাৎ মানুষের হাতের অর্ধেক সে ঠান্ডা থেকে বাঁচায় না। হাত-ই তো মানুষকে প্রাণীকুলে শ্রেষ্ঠ করছে। সেই হাতকে অর্ধেক অকেজো করে রাখার অর্থ হাফ মানুষ। মানুষকে এই ভাগ করে ফেলার ষড় যত না শীতের, তার থেকে বেশি মানুষেরই। হাফ সোয়েটার অতএব মানুষের আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। শীত আর না-শীতের মধ্যে সে এক গরমবর্জিত মধ্যপন্থা। যার না আছে উদ্দেশ্য, না আছে আদর্শ, না আছে গন্তব্য। সে যতদিন গায়ে লেগে থাকে, তদ্দিন নিজের রংচঙে কার্নিভ্যাল বজায় রাখে। তেলে-জলে মিশ খাওয়াতে চায়। কেননা হাফ সোয়েটার জানে, যত চেষ্টাই করুক ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য শীতের দিনে মানুষের কাছে সে কখনোই প্রধানের মর্যাদা পাবে না।
গোলমাল হল, এটা জানার পর থেকেই হাফ সোয়েটার একবগগা। শীতের শুরুতে মানুষের ঘাড়ে সে চেপে বসবেই। অসুস্থ করবেই। অসুখ হলে তবে শাল-কম্বল, শেষে ফুল সোয়েটার। তার আগে হাফকে গা থেকে ঝেড়ে ফেলা মুশকিল। মধ্যে মধ্যে, মানুষের প্রতি করুণাই হয় তার। নিজের ভুলে নিজেই কেমন ফেঁসে যায় মানুষ। হাফ সোয়েটার তখন দু’চার আনা গরম খয়রাতি করে। গরম ভাত না হোক, শীতে গরম ভাতা পেলেও মানুষ খুশিই হয়। তা ছাড়া ফুল সোয়েটারের এখন কোনও সংগঠন নেই। বিশ্ব বদলে গিয়ে উষ্ণায়ন তাকে এপ্রিল ফুল করে বেরিয়ে গেছে। বহুদিন হল তাই, পূর্ণ সোয়েটার মানুষের কাছে এসে বলতেই পারেনি যে, আমাকে তোমার দরকার। মানুষ এই ব্রেন রটের দিনকালে দরকারি কথা ফলত দ্রুত ভুলে যায়।
হাফ সোয়েটার তাই দিব্যি থাকে। নিশ্চিন্তেই। মানুষ রেখেছে বলেই থাকে। শীতের সঙ্গে তার সেটিং আছে। তা নিয়ে কথা হয়। মানুষের সঙ্গেও সেটিং। তাতে তার অসুবিধা হয় না। নিজে অল্পায়ু হলেও হাফ সোয়েটার জানে, মানুষ আর শীতের পলিটিক্সের ভিতর গরমের খোঁজ নেই। গায়ে চাপানোর দায় আছে মাত্র। হাফ সোয়েটার তাই পরা সহজ, খুলতে গেলেই আটকে যায় মানুষের ঘাড়ে-মাথায়। বোকা মানুষের ঠান্ডা লাগে। আবার সে পরে ফেলে হাফ সোয়েটার।
হাফ সোয়েটার সবথেকে ভালো জানে, তাকে পরার যুক্তি নেই, তবু তার থেকে মানুষের মুক্তি নেই।