বাঙালির পাঠশালা লীলা মজুমদারকে ছাড়া সম্পূর্ণ হয় না। সুকুমার রায় যে-পথ চিনিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন তাঁকে, আজীবন সে-সাধনায় ব্রতী থেকেছেন তিনি। ছোটদের জন্য ‘সন্দেশ’ সম্পাদনা করতে এসেও মৌলিক ভাবনার ছাপ রেখেছিলেন। লেখা বাতিল করতে যেমন দ্বিধা করতেন না, তেমনই খুঁজে আনতেন নতুন লেখকদের। সম্পাদনা যে আদতে শিল্প, তা নিজের কাজেই বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। আর তাই তিনিই হয়ে উঠেছিলেন সন্দেশ-এর ‘বড় সম্পাদিকা’।
সম্পাদক লীলা মজুমদারকে ফিরে দেখলেন রণিতা চট্টোপাধ্যায়।
প্রচ্ছদের ছবি: শান্তনু দে
ছোটবেলায় শিলং-এর সাহেবি পরিবেশে বড় হওয়া লীলা কলকাতায় এসে ভর্তি হয়েছিলেন কনভেন্ট স্কুলে। বাংলা ব্যাকরণ ভালো করে না জানার দরুন কম কটাক্ষ শুনতে হয়নি তখন। সেই মেয়েই যে পরে বাংলায় গল্প-নিবন্ধ লিখবেন ঝরঝরিয়ে, এমনকি লেখার উপর কলমও চালাবেন সম্পাদক হিসেবে, এমনটা কে ভেবেছিল! অথবা কে জানে, লীলা মজুমদার হয়তো মনে মনে জানতেন সে কথা। পড়াশোনা করেছিলেন ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে, এমএ-তে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট। কিন্তু এ কথা তো বহুদিন আগেই স্থির করে নিয়েছিলেন, তাঁকে লিখতে হবে বাংলা ভাষাতেই, আর লিখবেন ছোটোদের জন্যই। যাঁর কথায় প্রথম সচেতন ভাবে লেখার চেষ্টা, সেই মানুষটি ততদিনে হারিয়ে গেছেন। হঠাৎ করেই। কিন্তু যাবার আগে নিজের প্রথম বই, যার নাম ‘আবোল তাবোল’, তার ছবিতে তুলি বোলাতে বোলাতে সুকুমার রায় বলে দিয়েছিলেন, “তুইও এসব করবি, কেমন?” পনেরো বছরের লীলা সেদিনই জেনেছিলেন, বড়দা যে পথ দেখিয়ে দিয়েছেন, তা-ই তাঁর আগামী জীবনের গন্তব্য। তাই সেই দাদার ছেলের কাছ থেকেই যখন এসে পৌঁছল সম্পাদক হওয়ার প্রস্তাব, দাদার ফেলে যাওয়া কাজ হাতে তুলে নেওয়ার ভার, সে প্রস্তাব তিনি ফেরাতেনই বা কেমন করে!
১৯২৩ সালে সুকুমারের অকালমৃত্যুতে থেমে গিয়েছিল সন্দেশ পত্রিকার পথচলা। সেই ‘সন্দেশ’ পত্রিকা, যে কিনা প্রথম বাংলার শিশু-কিশোরদের কথা ভেবেছিল, তাদের মতো করে কথা বলেছিল। সত্যি বলতে, লীলা নিজেও বাংলা সাহিত্যকে অনেকখানি ভালোবাসতে শিখেছিলেন সন্দেশের হাত ধরেই। তার আগে বাড়িতে কম বইপত্র ছিল না, মুখে মুখে শুনে রবি ঠাকুরও চেনা মানুষ ছিলেন, আবার আচার রাখার জন্য রবীন্দ্রনাথের বইয়ের পাতা ছিঁড়ে নিতেও পারতেন কিশোরী লীলা। কিন্তু জ্যাঠামশাই উপেন্দ্রকিশোর যেদিন শিলংয়ের বাড়িতে পৌঁছে ডাক দিলেন ‘সন্দেশ এনেছি’ বলে, আর তাঁর হাতে কলকাতার সন্দেশের হাঁড়ির বদলে দেখা গেল রংচঙে বই, সে ছিল এক অবাক করা কাণ্ড। আবার বছর বারো বয়সে যখন পাহাড় থেকে পাকাপাকিভাবে শহরে থাকতে এলেন, সেই সন্দেশের বাড়িই হল তাঁদের ঠিকানা। এই বাড়ির হাওয়ায় সাহিত্য সংস্কৃতির পরিবেশের সঙ্গে মিশে ছিল ইউ রায় অ্যান্ড সন্সের ছাপাখানার শব্দ, গন্ধ, আর ‘সন্দেশ’ পত্রিকা দপ্তরের যাবতীয় কর্মকাণ্ড।
লীলা পরে বলেছেন, “নিচে প্রেস চলত, তার একটানা ঝমঝম শব্দ কানে আসত, মনে হত বাড়িটা বুঝি দুলছে, যে কোন সময় পাখির মতো ডানা মেলে উড়ে যাবে।” সেই ডানার ঝাপটা যার গায়ে লাগে, সে কি আর তিষ্ঠুতে পারে? হলদে পাখির পালকের সে ছোঁয়া ছোট বোনটির গায়ে বুলিয়ে দিয়েছিলেন বড়দা সুকুমার। তখন উপেন্দ্রকিশোর আর নেই, সন্দেশের হাল ধরেছেন তিনিই। তাঁর সঙ্গে সঙ্গত করে চলেছেন লীলার অন্যান্য ভাইবোনেরা- বড়দি সুখলতা, মেজদি পুণ্যলতা, মণিদা সুবিনয়রা। লীলাকে দিয়েও তাঁর প্রথম গল্প লিখিয়ে নিলেন সুকুমার, সন্দেশের জন্যই। লেখিকা নাম দিয়েছিলেন ‘লক্ষ্মীছাড়া’, সম্পাদক তাকে একটুখানি পালটে করে দিলেন ‘লক্ষ্মী ছেলে’। সম্পাদনার একচিলতে আঁচড়ে যে গল্পের বাঁধুনি হয়ে ওঠে আরও অমোঘ, সেই পাঠও বড়দার কাছে পেয়ে গিয়েছিলেন লীলা।
বড়দার না-থাকার সময়েও লিখে লিখে তাঁকে একরকম করে ছুঁয়ে ছিলেন বইকি লীলা। সেসব লেখা প্রথম বই হয়েও বেরোল সুকুমার-পুত্র সত্যজিতের হাত ধরে। খাঁটি সম্পাদকের মতোই, লেখকের থেকে লেখা আদায় করে নিতে জানতেন তিনি। লীলা মজুমদার নিজেই বলেছেন, “মানিক অর্থাৎ সত্যজিৎ বলল, ‘আমায় তোমার সব ছোট গল্পগুলো দেবে? বই হবে।’ ‘বদ্যিনাথের বড়ি’র সব গল্প ও আরো কিছু গল্প নিয়ে গেল মানিক। সিগনেট প্রেস থেকে বেরিয়েছিল ‘দিনদুপুরে’ বইটি ১৯৪৮ সালে। আর ঐ একটি বই দিয়েই চিরকালের মতো বাংলা সাহিত্যের বিপদসঙ্কুল পাথুরে পথে সেই যে একটু দাঁড়াবার জায়গা পেয়ে গেলাম, তার থেকে আর নামিনি।”
এরও অনেক বছর পর, সত্যি সত্যিই সম্পাদকের দায়িত্ব নিয়ে সন্দেশ পত্রিকাকে ফের জাগিয়ে তুললেন সত্যজিৎ রায়। সেটা ১৯৬১ সাল। আর সহ-সম্পাদক হিসেবে তিনি ডেকে নিলেন তাঁর লীলুপিসিকেই। ১৯৬৩ থেকে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত সেই ভূমিকাতেই সন্দেশ-এর সঙ্গে জুড়ে রইলেন লীলা মজুমদার। একদিকে লিখে চললেন ‘টংলিং’, ‘হট্টমালার দেশে’, ‘বালী-সুগ্রীব কথন’, ‘নেপোর বই’-এর মতো চমৎকার সব লেখা, অন্যদিকে লিখিয়ে নেওয়া আর সে লেখা ঝেড়েবেছে নেওয়ার ক্ষেত্রেও রাখলেন কড়া নজর। ‘সন্দেশ’-এর আর এক সম্পাদক নলিনী দাশের ছেলে অমিতানন্দ জানিয়েছেন, “এমন কিছু ‘সন্দেশ’-এ উনি ছাপতে দিতেন না, যা কোনও ভাবে ছোটদের মনে খারাপ প্রভাব ফেলে। এক বার একটা লেখায় ছিল এক জন দোকানদার অসৎ উপায়ে মুনাফা করছে। সেই লেখাটা কম্পোজ হয়ে নেগেটিভ পর্যন্ত তৈরি হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু উনি দেখার পর বললেন, এ লেখা চলবে না।” লীলা মজুমদারের সম্পাদনা প্রসঙ্গে পুরোনো সন্দেশী প্রণব মুখোপাধ্যায়ের অভিজ্ঞতাও একইরকম। সন্দেশের ‘বড় সম্পাদিকা’ তাঁর একটি কবিতা বাতিল করার পর তিনি সোজা চলে গিয়েছিলেন লীলা মজুমদারের বাড়িতে। অচেনা তরুণকে তিনি যত্ন করে বুঝিয়েছিলেন, “লেখা লেখকের সন্তানতুল্য। ‘না’ হয়ে গেলে বড় কষ্ট হয় জানি। তবে মাঝে মাঝে নিজেকে আলাদা মানুষ হিসেবে ভেবে নিতে হয়, ভাবতে হয় সত্যি কেমন লাগছে।” লেখা বাতিল নিয়ে বড় সম্পাদিকার সঙ্গে মাঝে মাঝেই তর্ক বেধে যেত আরেক সন্দেশী শিশির মজুমদারের। কে লিখেছে, লেখা বাতিল হলে সে কতখানি আঘাত পাবে, এই তথ্য লেখা বাছাইয়ের মাপকাঠি হতে পারে না বলেই মনে করতেন লীলা মজুমদার। আর নিজের মতামতে অটল থেকেই হাতে বানানো কেক খাইয়ে ভুলিয়ে দিতেন শিশিরবাবুকেও। সন্দেশের অন্য দুই সম্পাদক সত্যজিৎ রায় ও নলিনী দাশ কোনও লেখা ছাপার পক্ষে, অথচ লীলা মজুমদার আপত্তি করছেন, এ ঘটনাও বিরল ছিল না।
অবশ্য শুধু লেখা বাছাই করাই নয়, লিখিয়ে নেওয়ার ক্ষমতাটিও পুরোদস্তুর আয়ত্ত করেছিলেন লীলা মজুমদার। একদিকে তাঁর বাড়িতে প্রতি মাসের শেষ রবিবার বসত লেখা পাঠের আসর, যেখান থেকে পছন্দসই লেখা জমা নিতেন তিনি। আবার তাঁর শান্তিনিকেতনের বাড়ির আড্ডায় আনাগোনা ছিল স্থানীয় মানুষ থেকে খ্যাতনামা ব্যক্তিত্ব সকলেরই। শান্তিদেব ঘোষ, অমিতা সেন, কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, অম্লান দত্ত, কে থাকতেন না সেখানে! আর ওই আড্ডাখানা থেকে তিনি ‘সন্দেশ’-এর জন্য নতুন লেখকদের খুঁজে বের করতেন। সাংবাদিক ও বিশ্বভারতীর কর্মী স্বপনকুমার ঘোষ, যাঁকে ‘নো প্রবলেম দাদা’ বলে ডাকতেন, তাঁকে দিয়ে সন্দেশ-এর জন্য লিখিয়ে নিয়েছিলেন পুরনো দিনের খেলোয়াড়দের নিয়ে একটা সিরিজ। জিওলজিস্ট শ্যামলকৃষ্ণ ঘোষের থেকে আদায় করতেন তাঁর পেশার বিচিত্র অভিজ্ঞতার কথা। সাহিত্যিক অজেয় রায়ের লেখালিখি শুরুই হয়েছিল লীলা মজুমদারের প্রেরণায়। এমনকি তাঁর মামা, শিকারি রণজিৎ রায়কে দিয়েও তিনি শিকারকাহিনি লিখিয়ে নিয়েছিলেন, সঙ্গে ছবি এঁকেছিলেন সত্যজিৎ রায় নিজেই। আবার উপাসনাকক্ষের বাইরে জুতো চুরি হওয়ার দুঃখ জানিয়ে ছড়ার ছন্দে চিঠি লিখেছিলেন প্রণববাবু, সে চিঠিও টীকা-সহ বেরিয়ে পড়েছিল সন্দেশের ‘গল্পসল্প’ বিভাগে।
১৯৯১ সালে সত্যজিতের মৃত্যুর পরেও নলিনী দাশের হাত ধরে সন্দেশ-এর জোগান অক্ষুণ্ণ রেখেছিলেন সন্দেশের বড় সম্পাদিকা। তবে ১৯৯৩ সালেই নলিনীর মৃত্যু বোধহয় ক্লান্ত করেছিল তাঁকেও। পরের বছর, ১৯৯৪ সালে বরাবরের মতোই সন্দেশ-এর সম্পাদকের কলম নামিয়ে রেখেছিলেন লীলা মজুমদার।