নজরুলের লেখাপত্রে, বিশেষত রাজনৈতিক প্রবন্ধ পরিচয় দেয় যে, সমাজ ও সময় সম্পর্কে তাঁর ছিল তুখড় পর্যবেক্ষণ। শুধু যে স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষায় দেশপ্রেমের বহ্নিশিখা তিনি জ্বালাতে চেয়েছেন, তা নয়। বাংলার সমাজের ভিতরকার মৌলিক সমস্যাগুলিকে তিনি চিহ্নিত করছিলেন। এবং কীভাবে তা মোকাবিলা করা যায় তার পথও খুঁজে চলেছিলেন।
সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুর খেয়াল করেছিলেন এবং লিখেওছিলেন যে, ‘নজরুল সাধারণ শ্রমিক কৃষক ও মেহনতি মানুষের কাছে উত্তরোত্তর যথাযোগ্য স্বীকৃতিলাভ করেছেন’। কাজী নজরুল ইসলান তাঁর কবিতা ও সংগীতে বাঙালিকে আবিষ্ট করেছেন। বাংলা ভাষার মুক্তির পথ দেখিয়েছেন। সুর এবং ভাষা- দুই ক্ষেত্রেই নিরীক্ষা করেছেন। তবে, একই সঙ্গে ভুললে চলবে না, তাঁর রাজনৈতিক চিন্তাভাবনার কথাও। সৌমেন্দ্রনাথের উক্তিটি আমাদের সেই পথই দেখাচ্ছে। যে কবিকে আমরা ‘বিদ্রোহী’ বলি, তাঁর রাজনৈতিক দর্শনকে খুঁটিয়ে দেখা নিঃসন্দেহে জরুরি কাজ।
-: আরও শুনুন :-
রবীন্দ্রনাথ যদি ভোটে দাঁড়াতেন, কী থাকত নির্বাচনী ইস্তাহারে?
বিচিত্র কর্মজীবনে সাংবাদিক হিসাবেও তিনি কাজ করেছিলেন। নিজের বিদ্যালয়ের শিক্ষক ছাড়া, আর একজন ব্যক্তি নজরুলের মনে বিপ্লবী চেতনার আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছিলেন, তিনি মুজফ্ফর আহমেদ- কমিউনিস্ট আন্দোলনের পুরোধা বলা হয় যাঁকে। নজরুলের লেখাপত্রে, বিশেষত রাজনৈতিক প্রবন্ধ পরিচয় দেয় যে, সমাজ ও সময় সম্পর্কে তাঁর ছিল তুখড় পর্যবেক্ষণ। শুধু যে স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষায় দেশপ্রেমের বহ্নিশিখা তিনি জ্বালাতে চেয়েছেন, তা নয়। বাংলার সমাজের ভিতরকার মৌলিক সমস্যাগুলিকে তিনি চিহ্নিত করছিলেন। এবং কীভাবে তা মোকাবিলা করা যায় তার পথও খুঁজে চলেছিলেন। সে সমস্যা প্রধানত সাম্প্রদায়িকতার। ১৯২৬-এ সাম্প্রদায়িক বিষ ছড়িয়ে পড়ল কলকাতায়,মৃত্যু হল বহু মানুষের। এপ্রিলে তা চরম আকার ধারণ করে। তবে, আগে থেকেই এই পরিবেশের উপর নজর ছিল নজরুলের। সেই সময় বন্ধু শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়কে এক চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন, “আমি এবার কলকাতায় গিয়েছিলুম, আল্লা আর ভগবান এত মারামারির দরুন তোমার কাছে যেতে পারিনি।” এই বিরোধ যে দেশের দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা তা বুঝতে ভুল হয়নি যুগসচেতন নজরুলের। খেয়াল করলে দেখা যাবে, দেশের এই মৌল বিরোধ দূর করে সম্প্রীতির কাছে পৌঁছনো ছিল তাঁর অন্যতম অভীষ্ট। তিনি আজীবন এই নিয়ে সরব ছিলেন।
-: আরও শুনুন :-
গান্ধীজি যদি ভোটে দাঁড়াতেন, কী থাকত তাঁর নির্বাচনী ইস্তাহারে?
সেই সময় ‘গণবাণী’ পত্রিকায় তাঁর লেখার দিকে চোখ রাখলেও এর সমর্থন মেলে। কাজীসাহেব লিখেছেন, “আবার হিন্দু মুসলমানী কাণ্ড বাঁধিয়া গিয়াছে। প্রথমে কথা কাটাকাটি তারপর মাথা কাটাকাটি আরম্ভ হইয়া গেল। আল্লার এবং মা কালীর ‘প্রেস্টিজ’ রক্ষার জন্য যাহারা এতক্ষণ মাতাল হইয়া চিৎকার করিতেছিল তাহারাই যখন মার খাইয়া পড়িয়া যাইতে লাগিল, দেখিলাম-তখন আর আল্লামিয়া বা কালী ঠাকুরাণীর নাম লইতেছে না। হিন্দু মুসলমান পাশাপাশি পড়িয়া থাকিয়া এক ভাষায় আর্তনাদ করিতেছে-“বাবা গো, মা গো!’-মাতৃ পরিত্যক্ত দুটি বিভিন্ন ধর্মের শিশু যেমন করিয়া এক স্বরে কাঁদিয়া তাহাদের মাকে ডাকে। দেখিলাম হত আগতদের ক্রন্দনে মসজিদ টলিল না, মন্দিরের পাষাণ দেবতা সাড়া দিল না। শুধু নির্বোধ মানুষের রক্তে তাহাদের বেদী চির কলঙ্কিত হইয়া রহিল। মন্দির মসজিদের ললাটে লেখা এই রক্ত কলঙ্করেখা কে মুছিয়া ফেলিবে?” একটু খেয়াল করলে দেখা যায়, নজরুল এর জন্য সাধারণ মানুষকে দায়ী করছেন না। করছেন, ধর্মের গোঁড়ামিকে। অর্থাৎ ধর্ম যখন প্রতিষ্ঠান, আর সেই প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব যাঁদের হাতে, তাঁদের চালনাতেই এই বিরোধ। নইলে কোনও ধর্ম কেন মানুষকে এই কলঙ্কিত জায়গায় নিয়ে আসবে? নজরুল তাই লিখছেন, “হিন্দুত্ব মুসলমানত্ব দুই সওয়া যায়, কিন্তু তাদের টিকিত্ব দাড়িত্ব অসহ্য, কেননা ঐ দুটোই মারামারি বাঁধায়। টিকিত্ব হিন্দুত্ব নয়। ওটা হয়ত পণ্ডিত্ব। তেমনি দাড়িত্ব ইসলামত্ব নয়, ওটা মোল্লাত্ব। এই দুই ‘ত্ব’ মার্কা চুলের গোছা নিয়েই আজ এতো চুলোচুলি। আজ যে মারামারিটা বেঁধেছে, সেটাও এই পণ্ডিত মোল্লার মারামারি- হিন্দু মুসলমানে মারামারি নয়। নারায়ণের গদা ও আল্লার তলোয়ারে কোন দিনই ঠোকাঠুকি বাধাবে না। কারণ তাঁরা দু’জনেই এক, তাঁর হাতের অস্ত্র তাঁরই আর এক হাতের ওপর পড়বে না। অবতার পয়গম্বর কেউ বলেননি আমি হিন্দুর জন্য এসেছি, আমি মুসলমানদের জন্য এসেছি, আমি ক্রীস্টানের জন্য এসেছি। তাঁরা বলেছেন আমরা মানুষের জন্য এসেছি – আলোর মত সকলের জন্য। কিন্তু কৃষ্ণের ভক্তেরা বলেন কৃষ্ণ হিন্দুর, মহম্মদের ভক্তরা বলেন, মহম্মদ মুসলমানদের, খ্রীষ্টের শিষ্যরা বলেন খ্রীস্ট খ্রীশ্চানদের। কৃষ্ণ মহম্মদ খ্রীষ্ট হয়ে উঠলেন জাতীয় সম্পত্তি। আর এই সম্পত্তি নিয়েই যত বিপত্তি। মানুষ আজ পণ্ডিতে পরিণত হয়েছে, তাদের চিরন্তন জাতীয়তা ভুলেছে।” এই চিরন্তন জাতীয়তাই ছিল নজরলের কাঙ্ক্ষিত। যদিও দেশের অবস্থা তাঁকে সেই স্বস্তি দেয়নি।
-: আরও শুনুন :-
কেমন হবে বিরোধিতা? শ্রীচৈতন্যের যুক্তি প্রাসঙ্গিক নির্বাচনের মরশুমেও
এই বিরোধ যে নজরুলকে পীড়া দিত। শুধু কবিতা বা গানে নয়, সরাসরিই এ নিয়ে তাই নিজের মন্তব্য, মতামত স্পষ্ট করেছেন তাঁর লেখায়। ধর্ম নিয়ে গোঁড়ামির বিরুদ্ধে তাঁর কণ্ঠ সোচ্চার। এই মৌল সমস্যা প্রতিরোধে সংস্কৃতিই হয়ে উঠতে পারে হাতিয়ার, এমনটা মনে করতেন নজরুল। জনার্দন চক্রবর্তীর সঙ্গে যখন তাঁর দেখা হয়, তখন স্পষ্ট করেই বলেছিলেন, “যে-উগ্র শ্বাসরোধকারী সাম্প্রদায়িকতার হাওয়া দেশময় বইছে তাকে রুখতে হলে বাংলার সাহিত্য-সংস্কৃতিকে আশ্রয় করে তার প্রকৃত ব্যাখ্যা দিতে হবে। আপনি নিষ্ঠা দিয়ে তা শুরু করেছেন, দেখে খুশিতে প্রাণ ভরে গেল। আপনি রইলেন বাংলার এই প্রত্যন্তসীমায় আমাদের একজন ঘাটিয়াল- আমাদের ভাবের ভাবুক, একই রসের রসিক।” বোঝা যায়, সাংস্কৃতিক সূত্রেই সাম্প্রদায়িকতাকে পরাস্ত করতে চাইছিলেন নজরুল। তা শুধু তাঁর একার কাজ নয়। তাই বুঝি একই ভাবের ভাবুক, রসের রসিককে দেখে খুশিতে তাঁর প্রাণ ভরে গিয়েছিল।
এই কাজী নজরুল ইসলামকে আমরা বোধহয় সেভাবে খেয়াল করেনি। ভারতবর্ষ আজও সাম্প্রদায়িকতা বিষে কাতর, সেই দেশে নির্বাচনও আসে। কই নজরুলের আদর্শ মেনে এরকম একটা নির্বাচনী ইস্তাহারের কথা আমরা সেভাবে ভাবি না তো !