আমাদের অপরিমেয় কৈশোর, তার বোকামির দরজায় কলিংবেল টিপে পালিয়ে যাওয়া সময় আর দরজা খুলে দাঁড়িয়ে বারবার দেখে ফেলা মাইক গ্যাটিং-এর মুখ, পিটার শিল্টনের বিরক্তি, ইকার ক্যাসিয়াস কিংবা অলিভার কানের ভ্যাবাচ্যাকা– জীবন কুড়ি কুড়ি বছরের পারে চলে গেলেও বুক পকেটে হাত দিলে এখনও সেই সব বোকা বনে যাওয়া মুহূর্তের কত যে খসখস আওয়াজ – কত ভরসা-বিশ্বাস– এক আধবার বোকা হলেও কুছ পরোয়া নেহি। লিখলেন, অর্পণ গুপ্ত।
পাঠ: শঙ্খ বিশ্বাস
প্রচ্ছদ: অর্ঘ্য চৌধুরী
বিকেলে খেলতে যাবার জন্য ব্যাট আর স্টাম্পার বল সাজিয়ে রেখে কখন যে চোখে এসে যেত এক বেলার ঘুম; চোখ খুলে, আচমকা পর্দার আড়াল থেকে দেখা নেমে এসেছে সন্ধে– ভেতর থেকে ডুকরে ওঠা কান্না সামলে নেওয়ার চেয়েও বেশি অসহায় লাগত এই বোকা বনে যাওয়ায়; যেন ন’ঠাকুমা ফোকলা চোয়াল আর তোবড়ানো গাল নিয়ে কানের কাছে এসে সেই বিশ্রী হাসিটা হেসে হেসে বলছে– ‘ তুই একটা বোকা, তোর দাঁতে পোকা…’
আসলে বোকার হদ্দ লোক, পাড়ায় যার জিলিপিটা অনায়াসে কেড়ে নেওয়া যায়, যে বগলের ফাঁক দিয়ে গোল খায়, বাজারে কানাবেগুনটা একেবারে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিয়ে যার থলেতেই নিরাপদ আশ্রয় খুঁজে নেয়– তেমন লোক বোকা বনে গেলে বিশেষ গা করে না কেউ; কিন্তু আমি– যে কিনা বিকেলের ম্যাচে টেনিস বলখানা চুন্নি করে দেবার স্বপ্ন দেখছিলাম– বেমালুম ঘুমিয়ে পড়লাম !
অবিশ্যি আমার প্রবল কনফিডেন্সের বেলুন ফুস হয়ে যাওয়ার দলে প্রথম পেয়েছিলাম এক থতমত ব্রিটিশকে,– মাইক গ্যাটিং– ভদ্রলোকের ঝুলিতে খান দশেক টেস্ট সেঞ্চুরি– তিনি কিনা ওই সাদাচুলো অস্ট্রেলিয়ানের ডেলিভারিটায় অমন ল্যাজেগোবরে হল? লেগস্টাম্পের বাইরে থেকে ওই বলখানা কীভাবে চুমু খেয়ে গেল অফস্টাম্পের ঠোঁটে? যতবার হাইলাইটস দেখেছি, ততবার পিচের দিকে তাকিয়ে সেই কানাবেগুন থলেতে ভরে বাড়ি ফেরা লোকটার মতো অসহায় গ্যাটিং দু’দিকে মাথা নড়ছেন। মাঝে মাঝে মনে হয়, তিরিশ বছর ধরে যতবার প্লে- বাটনে ক্লিক করে কেউ বল অফ দ্য সেঞ্চুরি দেখেছে– মাইক গ্যাটিং ততবার বোকা হয়েছেন– প্রতিবার সেই বোকা বনে যাওয়ার পর মাথা নাড়ার ভঙ্গি এক তিল আলাদা।
আবার ধরা যাক, পিটার শিল্টনের কথা– ভদ্রলোকের নাকের ডগা দিয়ে এক গাঁট্টাগোট্টা খাটো উচ্চতার আর্জেন্টাইন একেবারে হাত দিয়ে বল ঠেলে দিলেন জালে; প্রতিবাদ করার আগে একবার দু’হাত তুলে ফের মাটির দিকে ছুড়লেন শিল্টন– বিশ্বাসই করতে পারছেন না যে কস্মিনকালে এমনটা কেউ ভাবতে পারে– হাজার হাজার চোখের সামনে, স্বয়ং শিল্টনের নাকের ডগায় ঘুসি পাকিয়ে বল জালে ঠেলে মারাদোনা গোলটা পেয়েও গেলেন– শিল্টনকে দেখে মনে হচ্ছিল দোর্দণ্ডপ্রতাপ সোভিয়েত, ভেতরে ভেতরে কোল্যাপ্স করে যাচ্ছেন– অথচ বিশ্বাস করতে পারছেন না কিছুতেই।
আমাদের ‘বোকা প্রেমে যে অহংকার’– তার বুদবুদ ফাটতে কিঞ্চিৎ দেরি তখনও; তখনও গলির মোড়ে আধঘণ্টা অপেক্ষার পর সে এলে, ভ্রু-পল্লবে ডাক দিলে, চন্দনের বনে একাকী আলাপের মাঝে এসে পড়েনি তার বাবা– মোটা গোঁফের আড়াল থেকে মাপেনি ওষ্ঠে স্মিত হাসি নিয়ে কোনওদিন না বলা সে সাবধানবাণী– ‘আর যেন না দেখি…’; অঙ্কে একশো পাওয়ার গুমোর নিয়েও মোক্ষম সময়ে আউট অফ পজিশন– এককের ঘরে দশক– কী আজব সেই বছরই এমন আউট অফ পজিশন হলেন ইকার ক্যাসিয়াসও– সেই ইকার ক্যাসিয়াস যাকে কিনা গোলের নিচে বিগত ৬ বছর ধরে ভিডিও গেমের রিমোট দিয়ে পজিশনে বসিয়েছে বিধাতা! তিনি ভুল পজিশনে ছিলেন, নাকি হতচ্ছাড়া উড়ন্ত ওলন্দাজ ভ্যান পার্সি কিছু একটা এলোমেলো করে দিলেন বোঝা গেল না, স্টপারের মাথার ওপর দিয়ে ভেসে আসা বলটাকে ডলফিনের মতো ভাসমান শরীরের মোচড়ে জালে জড়ালেন – মিডিয়া হইহই করে ফ্রন্টপেজে হেডলাইন করল – ‘দ্যা ফ্লাইং ডাচম্যান…’; আর উড়ন্ত ক্যাসিয়াস, আগের বিশ্বকাপ ফাইনালে আর্জেন রবেনের ডানা ছেঁটে দেয়া ক্যাসিয়াস, বিশ্বকাপের শ্রেষ্ঠ কিপার ক্যাসিয়াস একটা হতভম্ব মুখ করে চেয়ে আছেন জালে জড়িয়ে থাকা বলটার দিকে– বেচারা পঞ্চায়েতের ভোটার যেন– বুথে গিয়ে জানতে পারলেন তিনি ভোট দিয়ে দিয়েছেন– এপ্রিল ফুল…
অবশ্য তার থেকেও বেশি বোকা বনেছিলেন একযুগ আগে– অলিভার কান! বিশ্বকাপে জার্মানিকে ফাইনাল অবধি কার্যত কাঁধে করে টেনে নিয়ে গেলেন– ফাইনালে ন্যাড়ামাথা ব্রাজিলিয়ানের সামনে মোক্ষম সময়ে হাত থেকে ফসকাল বল, বিষয়টা যেন জাকির হোসেন তিনতালের ঠেকায় তাল কাটলেন।
শ্যেন ওয়ার্নের ওই লেগস্পিন-গুগলির দ্যোতনা একটা আস্ত পয়লা এপ্রিল– বাইরে বেরোতে বেরোতে আচমকা ঢুকে আসে ভেতরে– কত দুঁদে খেলোয়াড়ের গাণ্ডীব যে সোজা ভূপতিত হয় তার ইয়ত্তা নেই– আর এইসব রথী-মহরথীদের বেজায় এপ্রিল ফুল হওয়ার পেপার কাটিং বুকপকেটে জমিয়ে রাখা আসলে তো নিজেদের বোকা বনে যাওয়ার সপক্ষে কিছু খড়কুটো জমানোই।
আমাদের অপরিমেয় কৈশোর, তার বোকামির দরজায় কলিংবেল টিপে পালিয়ে যাওয়া সময় আর দরজা খুলে দাঁড়িয়ে বারবার দেখে ফেলা মাইক গ্যাটিং-এর মুখ, পিটার শিল্টনের বিরক্তি, ইকার ক্যাসিয়াস কিংবা অলিভার কানের ভ্যাবাচ্যাকা– জীবন কুড়ি কুড়ি বছরের পারে চলে গেলেও বুকপকেটে হাত দিলে এখনও সেই সব বোকা বনে যাওয়া মুহূর্তের কত যে খসখস আওয়াজ – কত ভরসা-বিশ্বাস– এক আধবার বোকা হলেও কুছ পরোয়া নেহি।
আমাদের মতোই যারা বোকা হতে না চেয়েও বোকা হয়েছিল কোনও একদিন, খুব অপ্রত্যাশিত সেই সব বোকা হওয়া গল্পের খাতা নিয়ে কত এপ্রিলস্য প্রথম দিবস যে পেরিয়ে গেল…