সিংহ-সিংহীর কানে এসেছে যে তাদের নামকরণ নিয়ে একটা হেস্তনেস্ত হবে। আদালত নাকি ঠিক করে দেবে, তাদের কী নাম হবে। একদল তো আবার বলছে, নামকরণ আসলে হয়ইনি। যা হচ্ছে তা রাজনীতি ছাড়া আর কিছুই নয়। বলিহারি রাজনীতি! যা নিয়ে তাদের বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা নেই, তাই নিয়েই মানুষের মাথা ঘামানোর শেষ নেই। তা রাম-রহিম নিয়ে যারা রক্তপাত ঘটায় তাদের কাছ থেকে এর বেশি আর কী আশা করা যায়!
সিংহ-সিংহীর অনুচ্চারিত সংলাপে কান পাতলেন সরোজ দরবার।
পাঠ: চৈতালী বক্সী।
অলংকরণ: সুযোগ বন্দ্যোপাধ্যায়।
কী নামে ডেকে, বলব তোমাকে…! ভরা ফাল্গুনে একই ঘেরাটোপের ভিতর মৃদু প্রণয়ভাষে সবে এ-কথা বলতে শুরু করেছিল সিংহ। তবে জবাবটা মোটেই সুখকর হল না। সিংহী খানিক ব্যাজার আর বিরক্ত হয়ে বলল, আর যাই হোক, সীতা কক্ষনও নয়! শুনে বিরস বদন স্বয়ং পশুরাজ। নামেই রাজা, সে রাজত্ব তো আর নেই। মানুষের বদান্যতায় আজকাল কোনওক্রমে টিকে থাকা। তবে মানুষসমাজের হালচাল কিছুই বুঝে উঠতে পারে না বেচারা সিংহ।
মামলাটার কথা তাদের কানেও উঠেছে বটে। তাদের দুজনের নাম ‘আকবর’ আর সীতা’ দেওয়া হয়েছে বলে আদালতে গিয়ে নালিশ ঠুকেছে একদল মানুষ। একে তো ত্রিপুরা থেকে সদ্য আসা। তার উপর কোয়ারেন্টাইনের ঝক্কি! তা সে সব সামলে একটু গুছিয়ে বসতে হবে, তা নয়; তার আগেই নামকরণের সার্থকতা নিয়ে বেধে গেল ঝামেলা। সত্যি বলতে, নামের যে কী মাহাত্ম্য তা সিংহ আজ পর্যন্ত বুঝেই উঠতে পারল না। শুনেছে যে, মানুষের সমাজে নাম নিয়ে বাড়াবাড়ি আছে। তারা নাকি কাউকে সিম্বা, কাউকে মোফাসা বলতে ভালোবাসে। তা বাসে তো বাসে, ওটুকুতেই থেমে গেলেই তো মিটে যেত। সিংহ এবং সিংহী আরও শুনেছে যে, মানুষের সমাজেই নাকি গণ্যমান্য কেউ একজন বলেছিলেন,নামে কী আসে যায়! গোলাপকে যে নামে ডাকো সে তো গন্ধই বিলোবে। আর সিংহকে যে নামে ডাকো, সে তো সিংহই থাকবে। এই সহজ সত্যি কেন যে মাথায় ঢোকে না কে জানে! অথচ নাম নিয়ে মানুষের অতিশয় নির্বুদ্ধিতার কোনও অর্থই সে খুঁজে পায় না। আরে বাবা, রাজা তো রাজা-ই। তার নাম যাই-ই হোক না কেন! মানুষের আর-একটা বোকামিতেও সে বিরলে কখনও-সখনও হেসে ফেলেছে। মানুষ তো নিজেকে শ্রেষ্ঠ ভাবে। অতএব সে ধরেই নিয়েছে যে, যে যে ভাষায় সে যোগাযোগ করে, সেগুলিই শ্রেষ্ঠতম। তা কেন হবে! বেচারা মানুষ তো কোনও দিন খেয়াল করেই দেখেনি বনজ ভাষার দীর্ঘকালীন রাজত্ব। পশুদের কি ভাষা নেই! পাখিরা যে কী ভাষায় গান করে, তা কি মানুষ কখনও ভেবে দেখেছে! নিজেদের পৃথিবীশ্রেষ্ঠ ভাবতে ভাবতে এসব তলিয়ে দেখার কথা তাদের মাথাতেই আসেনি। ঘন অরণ্যে প্রণয়ের মুহূর্তে সিংহ যে কী ভাষায় সিংহীকে সম্বোধন করে, তার কোনও হদিশই তো নেই তাদের কাছে। তার উপর আবার ব্যাকরণ, সাধু, চলিত, গুরুচণ্ডালি নিয়ে তারা হিমশিম। দিস্তে দিস্তে লেখা হচ্ছে, তবু ভাষার নাগাল কেউ পাচ্ছে না। আজ এই ভাষা উবে যাচ্ছে তো কাল ওই ভাষা বিপন্ন! এতই যদি ভাষার প্রতি ভালোবাসা, তাহলে এমনধারা ব্যাপারস্যাপার কেন বাপু! পশুদের সমাজে ব্যাকরণ-ট্যাকরণের বালাই নেই, তবু যোগাযোগের অভাব কোনও দিন হয়নি। আসলে মানুষ তো মানতেই চায় না যে তাদের বাইরে পৃথিবী আছে, আর সে-পৃথিবীর নিজস্ব একটা সিস্টেম আছে। অতএব ভাষাও আছে। এই যে পরিযায়ী পাখিরা যুগে যুগে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গা আসছে আবার ফিরেও যাচ্ছে, তার জন্য কি তারা মানচিত্র দেখে না তৈরি করেছে! অথচ মানচিত্র নিয়েও মানুষের মাথাব্যথার শেষ নেই। কোনটা কার দেশ, কোনটা কার প্রদেশ, সেই হিসাবে কোনটা কার ভাষা, তা নিয়ে বিস্তর জগাখিচুড়ি। এই বিষণ্ণ দিনে সে সব কথা মনে পড়তে বরং হাসিই পেল সিংহের।
-: আরও শুনুন :-
রামকে ‘পৌরাণিক’ বললে অপমান! শিক্ষাক্ষেত্রে খোলা তর্কের পরিসরেই লক্ষ্মণরেখা টানছে গেরুয়া শিবির?
এমন জটিল দিনকালে সিংহকে হাসতে দেখে প্রথমে অবাকই হল সিংহী! তারপর সে-ও খানিক হেসেই ফেলল। একটাও শব্দ উচ্চারিত না হলেও সিংহের চিন্তাটা সে বিলকুল পড়তে পেরেছে। মানুষের মাথামোটার নমুনা নিয়ে তাদের সমাজে এর আগেও বিস্তর হাসাহাসিই হয়েছে। কী আর বলা যায়! একে তো নিজেদের শ্রেষ্ঠ ভাবার মতো মূর্খামি পৃথিবীতে কেউ করে না। অরণ্যের দিকেই তাকিয়ে দেখা যাক না কেন! একদা যাদের রাজত্ব ছিল, তাদের থেকে অনেক দুর্বল ছিল মানুষ। কিন্তু তারা ধূর্ত। অতএব ছলে-বলে-কৌশলে অন্য সকলেরই রাজত্ব সে খতম করেছে। নইলে এই বন্দিদশা কি সিংহ-সিংহীকে মানায়! তা-ও নয় মানা গেল। যুগন্ধর মানুষের ধূর্ততার কাছে একরকম নাহয় হার-ই মেনে নেওয়া গেল। তবে তাই বলে ভাষার ভিতর ধর্মকে গুঁজে দেওয়া কি কোনও ভদ্রসমাজের কাজ! ধর্ম কি অরণ্যে নেই! এই যে বাঘ, সিংহ, হাতি, ময়ূর একই অরণ্যের ভিতর দীর্ঘকাল বসবাস করে এসেছে, ধর্ম বিনা তো তা হয় না। কোনটা ন্যায় আর কোনটা অন্যায় তা তারা নিশ্চিত করেই জানে। অন্যায় যুদ্ধে কেউ যায় না। আর কেউ অন্যায় করলে তাকে সমুচিত শাস্তি দেওয়া হয়, তাও দলবদ্ধ ভাবে। এ তো চিরকালের ধর্ম। খিদে ধর্ম। তাই বলে খাবারের ভিতর তারা তো ধর্ম খুঁজতে যায়নি কস্মিনকালেও। খিদের জন্য যা করতে হয়, তা করতেই হয়। অন্যথায় অন্যের ক্ষতি কেউ করতে যাবেই বা কেন! কিন্তু মানুষের সমাজ এসবের তোয়াক্কা করে না। নিজেদের যারা শ্রেষ্ঠ ভাবে, তাঁরা যে এমন হীনভাবে শ্রেষ্ঠ হয়ে উঠতে পারে, তা বুঝি ভাবাও যায় না। মানুষ শুধু ভুলে যায় যে, পৃথিবীতে কোনও কিছুই ঋত বা শাশ্বত নয়। সে মানুষের আধিপত্য কায়েম হলেও নয়।
-: আরও শুনুন :-
সরস্বতীর পোশাকে বিতর্ক! আদিতে ভারতীয় মহিলারা কি শাড়ি পরতেন?
দুজনেরই কানে এসেছে যে তাদের নামকরণ নিয়ে একটা হেস্তনেস্ত হবে। আদালত নাকি ঠিক করে দেবে, তাদের কী নাম হবে। একদল তো আবার বলছে, নামকরণ আসলে হয়ইনি। যা হচ্ছে তা রাজনীতি ছাড়া আর কিছুই নয়। বলিহারি রাজনীতি! যা নিয়ে তাদের বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা নেই, তাই নিয়েই মানুষের মাথা ঘামানোর শেষ নেই। তা রাম-রহিম নিয়ে যারা রক্তপাত ঘটায় তাদের কাছ থেকে এর বেশি আর কী আশা করা যায়! নাম পেরিয়ে নিজেদের আর কবেই বা ওরা চিনতে শিখেছে! মানুষ আর কবে ভাবল যে, নামধামগোত্র নয়, সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপর নেই।
ঘেরাটোপের বিষণ্ণতা এখন খানিক কেটেছে। আদালত যা বলে বলবে। যা অসার তা নিয়ে তারা আর বেশি ভেবেই বা করবেটা কী! মুচকি হেসে সিংহ-সিংহী শুধু ভাবে, আকবর নামে কেউ যদি সীতাভোগ খায়, তাহলেও কি মানুষ আদালতে যাবে!