ভাষার ভিন্নতা আমাদের আলাদা করে। আবার সেই ভিন্নতার সূত্রেই যেন গড়ে ওঠে সামগ্রিক এক দেশের ধারণা। স্বীকৃতি-অস্বীকৃতি পেরিয়ে ভেসে থাকা ভাষার ভিতর দিয়েই তাই যেন চোখে পড়ে আমার দেশ, আমাদের দেশ।
ভাষার সেই চলাচলের কথাই ভাষাদিবসে তুলে ধরলেন, বিতস্তা ঘোষাল।
পৃথিবীতে নাকি সবচেয়ে দ্রুত বয় বাতাস, আর তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ভাষা। প্রতি মুহূর্তে যত সংখ্যক মানুষ পরিযায়ী হচ্ছেন, তাঁদের অনুষঙ্গ হিসাবে ভাষা পৌঁছে যাচ্ছে সীমানার গণ্ডি ছাড়িয়ে অন্য কোনও প্রান্তরে। কালস্রোতে সেই অজানা ভাষার শব্দ-বর্ণ জুড়ে জন্ম নিচ্ছে নতুন ভাষা।
‘সমুদ্রের মধ্যে হাজার হাজার প্রবাল আপন দেহের আবরণ মোচন করতে করতে কখন এক সময়ে দ্বীপ বানিয়ে তোলে। তেমনি বহু সংখ্যক মন আপনার অংশ দিয়ে গড়ে তুলেছে আপনার ভাষাদ্বীপ’– এ-কথা বলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। কাজেই ভাষা অনেকটা জলের মতো বহমান, অন্তত আমার তাই-ই মনে হয়। ভাষা ও ভাসা – এই দুইয়ের নিরন্তর যাত্রা – গন্তব্য এক। পথ আলাদা। এ-কথা নিশ্চিতভাবেই বলছি। কারণ অনুবাদ পত্রিকা ও ভাষা সংসদের সম্পাদক হবার সূত্রে প্রতিদিন বিভিন্ন ভাষার সংস্পর্শে আসার সুযোগ পাই। সমগ্র বিশ্বকে যদি বাদও দিই, শুধু ভারত নামক এই দেশটির মধ্যেই আছে বহু ভাষা। অথচ প্রতিটির মধ্যেই কিছু শব্দের অদ্ভুত মিল। ভাষাবিজ্ঞানীরাও এ বিষয়ে এক মত। বিশ্বের হাজার হাজার ভাষা নিয়ে গবেষণা করে তাঁরা বের করেছেন যে, এদের মধ্যে পার্থক্য থাকলেও, তা খুবই সীমিত। সব ভাষার ব্যাকরণেই কিছু বিশ্বজনীন অংশ আছে।
সে বিষয়ে বিস্তৃত না গিয়ে ভারতে ফিরি। এখানে সংবিধান স্বীকৃত ভাষার সংখ্যা কাগজে-কলমে ২২টি, কিন্তু যেগুলোর কথা সংবিধানে নেই, তার সংখ্যাটা এই মুহূর্তে পনেরোশোরও বেশি। এই স্বীকৃত-অস্বীকৃত ভাষার দৌড়ে প্রধান ক্ষতিগ্রস্ত সত্তাটি হল ‘ভারত’ নামক দেশ। এক দেশের ধারনার আড়াল থেকে জন্ম নেয় দ্বেষ। ধর্ম,ক্ষমতা, জাতের বাইরে জেগে থাকে ভাষার প্রতি বিদ্বেষও। বিবিধের মাঝে মিলনের গান যতই আমরা গাই না কেন, এ দেশ আমার – এই বোধ ভাষার ভিন্নতা এবং অধিকারবোধের দৌরাত্মেই যেন একাত্ম হতে দেয় না কখনও। অথচ আমাদের সাহিত্য সংস্কৃতি শিল্পের মধ্যে সেই একতা গভীরভাবে চলাচল করে। অনায়াসে ভাসিয়ে দেয় মনের দৈন্য। অর্থাৎ তখন আলাদা আলাদা ভাষা নয়, এক জীবন বহু জীবনের সঙ্গে জুড়ে গিয়ে অচেনা ভাষাটিও কখন যে আমার হয়ে যায়, তা টেরও পাই না।
-: আরও শুনুন :-
প্রান্তিক বা বিলুপ্তপ্রায় ভাষাগুলো নিয়ে কাজ করার সময়ও দেখি সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি, ধর্মের মধ্যে অনেক পার্থক্য থাকলেও মূল সুরটা এক। অর্থাৎ এক্ষেত্রে আমাদের সামগ্রিক জীবন এক রঙে আঁকা। উদাহরণস্বরূপ মাত্র ১০১১ জন মানুষের ভাষা টোটো ভাষার গল্প কবিতা পড়তে গিয়ে, ওঁদের গল্পের পটভূমির সঙ্গে মিসিং, কুড়ুক, বা কুড়মালি গল্পের খুব বেশি অমিল চোখে পড়ে না। ঠিক যেমন সাঁওতালি, গোণ্ডী, টুলু– তা কর্নাটক, সাঁওতাল পরগণা, রাঁচি, ঝাড়খণ্ড যেখানকারই হোক না কেন, প্রবাহমান ঘটনা একই, একই যন্ত্রণা, একই অভিযোগ, একই ক্ষত…। সাহিত্য শিল্পেও তার প্রতিফলন। আবার যদি প্রধান প্রধান ভাষা দেখি তখনও কিন্তু অভিব্যক্তিগুলো বিশেষ বদলায় না।
অর্থাৎ আমাদের সমস্ত ভাব বিনিময়ের একটা মাধ্যম ভাষা; এটা মেনে নিলেও, তা যে কেবল নিজ ভাষাতেই আবদ্ধ থাকবে এমন কোনও শর্ত কখনও ছিল না। সভ্যতার শুরুতে মানুষের নির্দিষ্ট কোনও ভাষাই ছিল না। বিভিন্ন প্রাকৃতিক পরিবেশে অবস্থান করে মানুষ আপন মনোভাব প্রকাশের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন বস্তু ও ভাবের জন্য বিভিন্ন ধ্বনির সাহায্যে শব্দের সৃষ্টি করল। সে সব শব্দ মূলত নির্দিষ্ট পরিবেশে মানুষের বস্তু ও ভাবের প্রতীক মাত্র। এ জন্যই আমরা বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন ভাষার ব্যবহার দেখতে পাই। সে ভাষাও আবার বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে উচ্চারিত হয়ে এসেছে। বারবার বিবর্তন, সংযোজন, পরিমার্জন, বিসর্জন হতে হতে জন্ম নিয়েছে বর্তমান ভাষা– যা আধুনিক সভ্যতার ফসলও বটে।
সাম্রাজ্যবাদ,ঔপনিবেশিকতা অর্থাৎ দখলদারির রাজনীতির অনুষঙ্গ হতে হতেও বহু ভাষা হারিয়ে গেছে, সেখানে নতুন ভাষার সঙ্গে মানিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছে মানুষ। তবে ভাষা বদলে গেলেও যুগ যুগ ধরে দেশ-সংস্কৃতি-ঐতিহ্য রয়ে গেছে তার সঙ্গে সঙ্গেই। রিলে রেসের মতো সেই সংস্কৃতির ব্যাটন প্রজন্মের পর প্রজন্ম বহন করে চলেছে। লোক সংস্কৃতির আকর হয়ে উঠেছে তা। যা হয়তো হাজার হাজার বছর আগে তার পরিবার শুনে শুনে মনে রেখেছিল।
অথচ, তারপরেও ভাষার দৌলতে পুরুলিয়া, বীরভূম, বাঁকুড়া, মুর্শিদাবাদ এমনকী বর্ধমান থেকে কলকাতায় আসা মানুষটিরও ‘দেশ’ যেন ‘ভারত’ হয় না; জেলাগুলোতেই তার ‘দেশ’ ঘুরে বেড়ায়। দেশের বাড়ির কথা বলতে গিয়ে সে সেই বুকের মধ্যে লুকিয়ে রাখা জেলাটির সোনার বাটি উপুড় করে; তার চোখ-মুখ তখন আনন্দে ভরে ওঠে। অন্য রাজ্য থেকে আসা ব্যক্তিটিও কেবল ভাষার ভিত্তিতে নিজের মুলুক আলাদাই করে রাখে। রাজস্থানি, গুজরাতি, কাশ্মিরী, পঞ্জাবী বা অন্য ভাষার মানুষটি আমার পরিবার হয়ে ওঠে না। সেই আমিই যখন নিজ দেশের ভাষা ছাড়িয়ে অবলীলায় অন্য দেশের ভাষাকে স্বীকার করে নিই, আত্মস্থ করি, বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগের সেতু হিসাবে কোনও একটি ভাষাকেই আঁকড়ে ধরি, তখন অপরিচিত সেই বিদেশ বিঁভুয়ে দেশ থেকে আসা অন্য আরেকটি মানুষের ভাষা ভুলে অনায়াসে তাকে ‘দেশওয়ালি’ বলে বুকে টেনে নিই। ভাষার ব্যবধান ঘুচে তখনই দেশ বড়ো হয়ে ওঠে। হঠাৎ করেই যেন মনে পড়ে যায়, নিজের মাতৃভাষা জানার পাশাপাশি অন্য একটা ভাষা জানা থাকলে শরীর একটি অতিরিক্ত আত্মা বহন করে। ঠিক যেমন বলেছেন ভাষা বিজ্ঞানী ও মনোবিদ ফ্রাঙ্ক স্মিথ– ‘One language sets you in a corridor of life. Two languages open every door along the way, Language is the road map of a culture.’
ভাষার ভিন্নতা যেন দেশকে ভাগ-ভাগ করে রাখে। আবার সেই বিবিধের মিলনসেতুই গড়ে তোলে সামগ্রিক দেশের ধারণা। ভাষার ভিতর দিয়ে তাই যখন নিজেদের দেখি, তখনই যেন দেখতে পাই আমার দেশ, আমাদের দেশকে।