সেই সব ভাষা। যার ব্যাকরণ নেই। নেই আকাদেমি, অভিধানও। তবু আঙুলের নীল কালির ভাষা চেনে ভোটবাক্স। স্লোগান চেনে রাজপথ, আর মাতালের ভাষা বোঝে ফুটপাথ। কড়াই-খুন্তির দাম্পত্যের ভাষা বুঝে নেয় তেলঝুল মাখা রান্নাঘর, আর সোহাগের ভাষা চেনে পর্দা ঢাকা কেবিন।
মাতৃভাষা দিবসে সেইসব ভাষাকে ছুঁয়ে থাকলেন রণিতা চট্টোপাধ্যায়।
‘পাখিটির মাতৃভাষা চেয়ে থাকা’– জেনেছিলেন অলোকরঞ্জন। উটের গ্রীবাও যে নিস্তব্ধতার ভাষা লেখে, তা বুঝে নিয়েছিলেন জীবনানন্দ। ভাষার কলরবের মধ্যে তো জেগে থাকে এমন সব ভাষাও, যে ভাষায় কোনও ব্যাকরণ নেই। নেই আকাদেমি, অভিধান; ফলে বানানে লাল কালি পড়ল কি না তারই বা হিসেব রাখবে কে!
তবে লাল কালির বর্ণমালা কিন্তু জানে পরীক্ষার খাতা কিংবা অ্যাটেনডেন্স রেজিস্টার। ঠিক যেমন আঙুলের নীল কালির ভাষা চেনে ভোটবাক্স। অবশ্য হামেশাই বারুদের ভাষায় লেখা হয় ভোটের হিসেব, কেননা মিছিলের ভাষা কোনও শাসকই পছন্দ করে উঠতে পারে না। চেয়ারের ভাষা বদলে নেয় ক্ষমতা। ঝুঁকে যাওয়া অবশ্য সব ভক্তেরই নিজস্ব ভাষা, সে মন্দিরের হোক কি দলের। তবে এ কথাও সত্যি, কাস্তের ভাষা বিপ্লব যত বোঝে, তার চেয়ে বেশি বোঝে ধান। আর সে ধান যার গোলায় জমা হয়, তার চেয়েও বেশি কথা বলে খিদে-পাওয়া পেটের সঙ্গে। যদিও খিদের কাছ থেকে এখনও সাম্যের ভাষা শিখতে চায়নি কেউই। যেমন জেদি বাচ্চার মতো খিদেও কাঁটাতারের ভাষা শিখছে না কিছুতেই।
আসলে যে ভাষা কথা বলে, সে কথা জুড়ে জুড়ে সমতার বয়ান ভাঙে। কিন্তু শব্দ-অক্ষরের নিয়মনীতির বাইরেও রোজ রোজ প্রাণ পায় অন্যরকম ভাষা-রা। কথা না বললেই যদি ভাষা তৈরি না হয়, জিরাফের তো তবে ভারি মুশকিল। সে যেমন স্তব্ধতার ভাষা জানে, তেমনই জেব্রাও তো চেনে ক্রসিংয়ের ভাষা। জানে, লাল নিশান দেখলে দিনবদলের গাড়ি এগোক না এগোক, রাস্তায় গাড়ি থমকে যায়। ঠিক যেমন, বান্ডিল টিকিটের আঙুলটানা কিরকিরে ভাষা জানে বাসযাত্রী, লোকাল ট্রেন ধাক্কার ভাষাতেই স্বচ্ছন্দ। তবে হলুদ ট্যাক্সির বর্ণমালা ভারি একলষেঁড়ে, ‘না’ ছাড়া আর কাউকে সে সিটের ভাগ ছাড়েনি। স্লোগান চেনে রাজপথ, আর মাতালের ভাষা বোঝে ফুটপাথ। কড়াই-খুন্তির দাম্পত্যের ভাষা বুঝে নেয় তেলঝুল মাখা রান্নাঘর, আর সোহাগের ভাষা চেনে পর্দা ঢাকা কেবিন। কড়া নাড়ার ভাষা যেমন ঘরোয়া, তেমনই সাইকেলের ক্রিং আর টেলিফোনের রিং-এর ভাষা গোপন প্রেমের। লাভ না হোক, লাইক ল্যাংগুয়েজে ওস্তাদ ফেসবুক। তবে লাভের গুড়ের তোয়াক্কা না করেই ছোঁয়ার ভাষায় অধিকারবোধ কায়েম করেছে পার্ক। আর ছেড়ে যাওয়া হাত শিখেছে হারানোর ভাষা। অপেক্ষার ভাষা জানে দেরিতে আসা চিঠি। আর মুছে যাওয়ার ভাষা চেনে ডাস্টার আর স্মৃতি। দাঁড়ের ভাষা বোঝে হাল আর হালের ভাষা বোঝে নদীর জল। জলের ভাষা বোঝে ঘাট, নইলে সে ছলাৎ ছল গল্প করে কেমন করে!
-: আরও শুনুন :-
ফ্রিকোয়েন্সির ভাষা মন জানে, আর জানে রেডিয়োর কাঁটা। ঘড়ির কাঁটা যেমন সময়ের ভাষায় পটু। সন্ধের ভাষা বোঝে শঙ্খধ্বনি আর ধোনির ভাষা বোঝে স্টাম্প। স্ট্যাম্প বোঝে পিন কোডের ভাষা, পিন নম্বরের ভাষা বোঝে এটিএম কার্ড। ইএমআই-এর ভাষা তো ক্যালেন্ডারই চেনে, আর ক্যালেন্ডার না থাক, বসন্তের ভাষা বোঝে কোকিল। ফাল্গুনের ভাষা অবশ্য কাঞ্চনেরও জানা, তবে মল্লিকাবনের ভাষা গীতবিতান ছাড়া কেউ বোঝেনি।
ভয়ের মাতৃভাষা চুপ করে যাওয়া, আঘাতেরও। ঠেকে যাওয়ার ভাষা জানে দেওয়াল। যেমন আত্মহত্যার ভাষা জানে সিলিং ফ্যান।
শুধু প্রতিবাদ জানে না মৌনের ভাষা। সে অপেক্ষা করে সশব্দে ফেটে পড়ার। আজও…