দে’জ পাবলিশিং নিবেদিত, সংবাদ প্রতিদিন শোনো আয়োজিত ‘গল্পের সেরা হাত’ প্রতিযোগিতায় নির্বাচিত গল্পগুলি থেকে শুনে নিন, সৌরভ হোসেন-এর গল্প ভাঙন। এই প্রতিযোগিতার তিন বিচারক ছিলেন শ্রদ্ধেয় সাহিত্যিক অমর মিত্র, যশোধরা রায়চৌধুরী ও জয়ন্ত দে।
পাঠ-অভিনয় চৈতালী বক্সী, শঙ্খ বিশ্বাস, শুভদীপ রায়
শব্দগ্রহণ অঙ্কুর নন্দী
অলংকরণ সুযোগ বন্দ্যোপাধ্যায়
কোলে একটা তেলচিটে কুলো। কুলোটায় তামাকের মশলা আর সুতো বাঁধা বিড়ি। রোজিনা মাথাটাকে নিচু করে চোখদুটো ফুঁড়ে বিড়ির মুখ মারছে। পরনের কাপড়টা নদীর দিক থেকে বয়ে আসা হিলহিলে হাওয়ায় ফিনফিন করে উড়ছে। রোজিনা যেখানে বসে আছে তার এক-দেড় মানুষ দূরে ফাটলটা হাঁ করে আছে! যেন নদীর একটা স্রোতের ধাক্কার অপেক্ষা করছে! সে ধাক্কাটা লাগলেই হুড়মুড় করে ধ্বসে পড়বে! কুলোটা একবার ঝাড়তেই ধক করে তামাকের গন্ধ লাগল রোজিনার নাকে। তামাকের পাতাগুলো শুকিয়ে গেলে যেমন চিমটে হয়ে যায় রোজিনার শরীরখানাও তাই। অথচ তার এই চামটা-চিমটে শরীরটাকে নিয়ে কেউ হিস মারলে রোজিনা বলে ওঠে, “এই গতরই চারশ-পাঁচশ বিড়ি বানধে। ধক আছে বুলিই তো?” রোজিনা খাতুন বিবি হতে পারেনি। বিয়ের বয়স যে হয়নি তা নয়, বয়সের গাছ-পাথর কিংবা কাগজ-দস্তাবেজে রোজিনা দু-কুড়ি দুই। রূপের ছিরির সঙ্গে সঙ্গে রোজিনার সাকিনও পালটে গেছে মাঝেমধ্যে। জন্মের আগে হেকিমপুর, মায়ের কোলে শিবনগর আর এখন এই বিড়ি বাঁধা ইহকালে কামালপুর। খাইকুন্নি নদী এভাবেই তার ঠিকানা বদলে দিয়েছে বারবার। নদীটা ফুঁসে উঠেল রোজিনার মা আবেদা বেওয়া গাল পাড়েন, “খাইকুন্নি লদীর এত্ত খেয়ি প্যাট ভরে না? যেখেনেই ঘর বাঁনধি সেখেনেই হাঘরে প্যাট লিয়ি তেড়ি আসে!” দাওয়ার বাঁশের খুঁটিটায় হেলান দিয়ে ফিতরার কাপড় পরে মরা ঢোলকলমির গাছের মতো যে থুত্থুরে বৃদ্ধার চোখগুলো ঘুলঘুল করছে সেই বৃদ্ধাই আবেদা বেওয়া। ছানি পড়া চোখ দিয়ে নদীটাকে দেখছেন। আর বিড়বিড় করছেন, “দুনিয়ায় সবাই মরে লদীডা মত্তে পারে না? জান খেকি ভিটি খেকি লদী কুথাকার।” পড়শি ছাইরা বিবি আবার বলেন, “ভিটি খেকি বিটি খেকি লদী।” এই নদীই যে গেল বছরের ঢলে তার এক আঁচলা মেয়েটিকে খেয়েছিল। রোজিনার ফেঁসোর মতো চুলগুলো দক্ষিণী হাওয়ায় ফিরফির করে উড়ছে। চুলগুলোয় ঠিক মতো তেল পড়ে না। অত যত্ন-আতিরের সময় কই? পেটের হিল্লে করতে গিয়েই শরীরের জেল্লা ফুড়ুৎ! খুঁটল চোখের নিচে কালশিটে দাগ! রোজিনা বলে, এ হল দুখকরানি দাগ। এই দাগই হাশরের ময়দানে শেষ বিচারের দিনে আমার হয়ে সাক্ষ্য দেবে, হে আল্লাহ তোমার দুনিয়ায় এই অভাগা মেয়েটি ভাত ছাড়া আর কিছুই খোঁজার সময় পায়নি। তুমি একে বেহেশতের সবচেয়ে সুস্বাদু খাবারটা খেতে দাও। উড়ন্ত চুলগুলোর ফাঁকফোকর দিয়ে দেখা যাচ্ছে ওপারে বাংলাদেশের শিবগঞ্জ উপজেলা। দুই দেশের মাঝে একখানা নদী। আর মাঝেমধ্যে ধু-ধু সাদা বালির চর। এই চরটাকে দেখিয়ে আবেদা রোজিনাকে বলে, “ওই যে ওইখানডায় যেখেনে সাদা বালিগুলেন চিকচিক কচ্চে ওইখেনে আমাদের বাড়ি ছিল। তুই ওই বাড়িতেই জন্মিছিলি।” “না জন্মালেই পাত্তাম! আল্লার কী দরকার ছিল এই খড়খুটোর মুতন একখানা ঠ্যালা খাওয়া খিদি পুষা জীবন দ্যাওয়া? অ্যার চেহি শামুক-গুগলি করি পাঠালেই পাত্তোস? আর কেহু জব্দ হোক না হোক নদীডা তো জব্দ হোতোস?” রেগে ওঠে রোজিনা।
খক করে কাশলেন আবেদা। রোজিনার ভেতরটা আঁতকে উঠল। সেই মরণ কাশিটা নয় তো! পেটের ভেতরের নাড়িভুঁড়ি কল-কলিজা থেকে টেনে বের করে আনে রক্ত যে কাশিটা? এই ব্যামুটায় কতজনই তো মরল এই কামালপুর গ্রামে। মায়ের কাশিটা উঠলেই রোজিনার চোখগুলো তেঁতুলের বিচির মতো হয়ে যায়! ওত পেতে দেখার চেষ্টা করে, জান কবজের ফেরেশতা আজরাইল আশেপাশে ঘুরঘুর করছেন কি না! দেখলেই, গলার নলি টিপে ধরে বলবে, “প্যাটে চাড্ডে ভাত দিতে পারোনি আর এখন জান লিতে এসচ? তুমার আস্পদ্দা তো কম লয়?”
বাঁশের চাটায় দিয়ে ঘেরা দরমার বাড়ি। জোর বৃষ্টি হলে শিতেনে ছিটেনি ঢুকে। কাঁথা-কাপড় সব ভিজে যায়। তখন ঘরের কোণে পোঁটলার মতো জড়সড় হয়ে বসে থাকে রোজিনা। মা আবেদা জড়ানো শীতলপাটির মতো জড়িয়ে-পেঁচিয়ে মেয়েকে আঁকড়ে থাকেন। আবেদার কাশিটা যেই থেমেছে অমনি বানের ঢেউয়ের মতো এক ঝাঁক ছেলেছোকরা দড়বড় করে ছুটে এল রোজিনাদের উঠোনে। উঠোনটা কিছুটা কাঁপল। সে কাঁপন টের পেল রোজিনা। ভাঙনের পাড়ে থেকে থেকে মাটির বাইরের ভাঙন তো টের পায়ই মাটির ভেতরের ভাঙনও টের পায় রোজিনা। দুই চোখে এসে ভর করে দুশ্চিন্তা! ভিটেটা আবারও নদীগর্ভে! ‘সাংবাদিক এসচে! সাংবাদিক!” ছেলেগুলো আনন্দে ডগমগ করে বলছে। বুকের উড়নাটা মাথায় দিল রোজিনা। গা-গতর ভালো করে আব্রু করে নিল। পুঁইমাচার মতো শরীরটাকে শক্ত করল। হাড়ে হাড় ঠেকাল। লিকলিকে পাগুলোকে শক্ত খুঁটি করল। মনে মনে বলল, “আজ আর কেহু আমার মুখ বন্ধ করি থুতে পারবে না। যম আলেও না।” তবুও চোখ ঘুলঘুল করে ভিড়ের মধ্যে আশরাফকে খুঁজল রোজিনা। নদীর নিচে দৃষ্টি ফেলল। সেখানেও নেই। দূরে ঘাটের দিকে তাকাল। সেখানে ধুধু দুপুর আর ঢলানি নদীর গ গ ডাক। এখন খেয়া পারাপার বন্ধ। একটা দুটো জেলেনৌকো দক্ষিণ গাঙে বাইছে। রোজিনা মনে মনে বলল, “আজ উ থাকলেও বুলব না থাকলেও বুলব।” আর তখনই রিপোর্টার লোকটি ঢুকলেন। লম্বা ফর্সা। গায়ে হলুদ টি-শার্ট। পরনে নেভি ব্লু জিন্স। এক হাতে বুম আরেক হাতে ক্যামেরা। ঘাড়ে কমলা রঙের শান্তিনিকেতনী ব্যাগ। আবারও ভিড়ের মধ্যে আশরাফকে খুঁজল রোজিনা। নাহ, নেই। সাংবাদিক লোকটিকে দেখে আবেদার কাশি হঠাৎ বেড়ে গেল। রোজিনা মায়ের কাছে গেল। মায়ের বুকটা কয়েকবার ডলে দিল। জিজ্ঞেস করল, “খুউব কষ্ট হচ্চে মা?” আবেদা মুখে কিছু বললেন না। শুধু ঘোলা চোখগুলো ঘুলিয়ে রিপোর্টার লোকটির দিকে তাকালেন। তারপর ফিসফিস করে বললেন, “তুই কিচ্চু বুলিস নে রোজিনা। আশরাফ শুনলে আর জানে বাঁচি থুবে না আমাধের!”
“আমরা কি বেঁচি আছি মা? অ্যাখে বাঁচা বুলে? আর কদ্দিন মুখ বন্ধ করি থুব?”
“গরিবধের কুনু ফোঁস কত্তে নাই রে মা।”
“আমাধের কি শুদু পেটই আছে? দাঁত-শিং নাই?”
“থাকলেও উসব ভেঙি ফেলতে হয়। না ভাঙলে বিপদ ডেকি আনে। উসব ফ্যাকড়ায় যাস নে মা।” চোখ ছলছল করে ওঠে আবেদার। রোজিনা মায়ের কথা শুনে না। খাড়া হয়ে দাঁড়ায়। গড়গড় করে নদীর পাড়ে আসে। পিছনে তখন ফাটলটা রাক্ষসের হাঁ হয়ে আছে। আশরাফের ভয়ে গ্রামের কেউ বাইট দেননি। রিপোর্টার লোকটি হন্যে হয়ে ঘুরছিলেন। আর তক্ষুনি কুদ্দুছের বউ লুতফা রিপোর্টার লোকটিকে রোজিনার কথা বলেছিল। এ গ্রামের একমাত্র মেয়ে রোজিনা যে মাইক্রোফোনের সামনে কথা বলতে পারে। “আপনার নাম রোজিনা?”
“জি।” রোজিনা মাথা হেলাল।
“আপনাদের সমস্যাগুলো বলবেন?”
“বুলব।” ফাটলটার দিকে তাকাল রোজিনা। রিপোর্টার ক্যামেরা অন করে বাইট নিতে শুরু করলেন। রোজিনা বলতে লাগল, “আমরা অসহায়। এই দেখতে পাচ্চেন আমাদের বাড়ির অবস্থা, যে কুনু সময় নদীতে চলি যাবে…।”
“কোনও সরকারি সুবিধা পেয়েছেন?”
“নাহ। আমি তো কিচ্চু পাইই নে। আমার সত্তর বছরের মাও কুনু ভাতা-টাতা পায় না।” রোজিনার কথাটা কান করেই আবেদা বেওয়া আনমনে বলে উঠলেন, “আমার ভাতারও নাই ভাতাও নাই।” আর তক্ষনি ভিড়ের মধ্যে থেকে বেরিয়ে এসে ফাটলটার কাছে দাঁড়িয়ে পঞ্চায়েত মেম্বার আশরাফ হুমকি দিয়ে উঠলেন, “মুখ বন্ধ কর রোজিনা। তা না হলে যা পাচ্চিস তাও পাবিনে।” বুঁ করে মাথাটা ঘুরে গেল রোজিনার। এক হাতে রিপোর্টারের ক্যামেরাটাকে সরিয়ে দিয়ে আরেক হাতে একটা জোর ধাক্কা দিল আশরাফকে। হুড়মুড় করে ফাটলটা ধ্বসে গেল! আশরাফ পাড়ের মাটির সঙ্গে ছিটকে পড়ল নিচের ফণা তুলে থাকা শ্রাবণের নদীতে! রোজিনা নদীকে চিৎকার করে বলল, “অনেক মানুষ খেয়িচিস নদী, এবের একটা অমানুষ খা।”
গল্পের সেরা হাত প্রতিযোগিতার ফলাফল: