দে’জ পাবলিশিং নিবেদিত, সংবাদ প্রতিদিন শোনো আয়োজিত ‘গল্পের সেরা হাত’ প্রতিযোগিতায় নির্বাচিত গল্পগুলি থেকে শুনে নিন, ধীমান বাউর-এর গল্প উপভাষা। এই প্রতিযোগিতার তিন বিচারক ছিলেন শ্রদ্ধেয় সাহিত্যিক অমর মিত্র, যশোধরা রায়চৌধুরী ও জয়ন্ত দে।
পাঠ-অভিনয় চৈতালী বক্সী, শঙ্খ বিশ্বাস
শব্দগ্রহণ অঙ্কুর নন্দী
অলংকরণ সুযোগ বন্দ্যোপাধ্যায়
রাতে খেতে বসে স্বামী প্রবালের উদ্দেশে গায়ত্রী বলল, দুটা দিন তো কাটে গেল। উয়ারা ফোন করল নাই।
প্রবাল বলল, এত অস্থির হচ্ছ ক্যানে? উয়াদের তো ভাবতে সময় দিতে হবেক।
– অস্থির কি আর সাধে হচ্ছি! ছেল্যা বড় কোম্পানিতে চাকরি করে। বাপমায়ের একমাত্র ব্যাটা। এমন ছেল্যার সন্ধান কি আর সবসময় মিলবেক!
– সেটা না হলে বুঝছি। কিন্তু য্যাচে তো আর ফোন করা যাবেক নাই।
– তাহলে কল্লোলকে ফোন করো। উ যদি ছেল্যার বাপমায়ের সাথে কথা বলে উয়াদের মতামতটা জানতে পারে।
– ইটা ভাল বলেছ। তবে আজ নয়। কাল সকালে করব।
আসলে গত রবিবার ওদের একমাত্র মেয়ে প্রজ্ঞার দেখাশোনা ছিল। সম্বন্ধটা নিয়ে এসেছিল প্রবালের মাসতুতো ভাই কল্লোল। দুর্গাপুর থেকে ছেলের বাবা মা এসেছিল দেখতে। দেখাশোনা শেষে চলে যাওয়ার সময় ওরা বলেছিল যে মেয়ে পছন্দ। তবে বাড়িতে ফিরে আর সবার সাথে আলোচনা করে তবেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানাবে।
মেয়ে অবশ্য অপছন্দ হওয়ার মতো নয়। প্রজ্ঞা সুন্দরী। পড়াশোনায় ভালো। এমএ ফার্স্ট ক্লাস। তবে শুধু মেয়ে পছন্দ হলে তো আর হয় না, আনুষঙ্গিক আরও অনেক কিছু দেখতে হয়। তাই হয়তো দুদিন সময় চেয়েছে। কিন্তু দুদিন পরেও কোনও সাড়াশব্দ না পাওয়ায় গায়ত্রীর এই তাড়া।
পরদিন সকালে প্রবাল ফোন করার আগেই কল্লোল এসে হাজির হল। চায়ের কাপ এগিয়ে দিয়ে গায়ত্রী জিজ্ঞেস করল, উদিকের কী খবর? ফাইনাল কিছু জানাল?
কল্লোল বলল, মেয়ে পছন্দ। তবে উয়াদের অন্য কী একটা ব্যাপার নাকি ঠিক ভালো ঠ্যাকে নাই।
কী ব্যাপার? গায়ত্রী উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞাসা করল।
কল্লোল ঠোঁট উলটে বলল, সিটা খুলে বলে নাই। শুধু বললেন যে ওই ব্যাপারটায় ছেল্যার কোনও আপত্তি না থাকলে উয়াদের কোনও আপত্তি থাকবেক নাই। তাই এই রোববার উনারা ছেল্যাকে সঙ্গে নিয়াই আসবেক।
প্রবাল বলল, আমরাও আলোচনা ঝুলায় রাখার পক্ষপাতী নই। কোনও সমস্যা থাকলে সামনাসামনি কথা বলে নিয়াই ভালো।
দেখতে দেখতে রবিবার চলে এল। বেলা দশটা নাগাদ ছেলে আর ছেলের বাবা মা এসে পৌঁছাল। কল্লোলও এসেছে। ভালোমন্দ কুশল বিনিময়ের পর চা আর টিফিন-পর্ব শুরু হল। প্রজ্ঞা তখনও সামনে আসেনি। সাজানো আর একটু বাকি। তাই চা-পর্ব শেষ হতে কল্লোল বলল, আমার একটা কথা জিজ্ঞাসা করার ছিল।
ছেলের বাবা বলল, কী কথা?
কল্লোল বলল, আপনারা ফোনে জানাইলেন যে আপনাদের কী একটা অসুবিধা আছে। এখন সিটা যদি একটু খুলে বলেন।
ছেলের বাবা বলল, সমস্যাটা তেমন গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয়। ওই একটু ভাষাগত সমস্যা।
প্রবাল বলল, ব্যাপারটা ঠিক বুঝলম নাই।
ছেলের মা বলল, আসলে আপনাদের ভাষায় একটা অন্যরকম টান আছে। আর এরকম টান আমাদের আত্মীয়স্বজন কারও মধ্যে নেই। এটাই আমাদের সমস্যা। এখন ছেলে তো বিয়ে করে বউ নিয়ে বাইরে চলে যাবে। তাই এ ব্যাপারে ওর কোনও আপত্তি না থাকলে আমাদেরও কোনও আপত্তি থাকবে না।
ঘরের ভিতরে থাকলেও কথাটা কানে গেল প্রজ্ঞার। শুধু কানে নয়, কানের পর্দা ভেদ করে একেবারে মর্মে গিয়ে বিঁধল। নিজেকে তার খুব হীন মনে হতে লাগল। লজ্জায় মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে হল। সত্যিই তো তাদের উচ্চারণভঙ্গি বাংলা ভাষার প্রথাগত উচ্চারণের থেকে একটু আলাদা। কিন্তু সে তো এই উচ্চারণেই অভ্যস্ত। কিন্তু তার জন্যে কী করতে পারে সে?
মিনিট পাঁচেক পরেই ডাক পড়ল প্রজ্ঞার। সে কুণ্ঠিত পায়ে চেয়ারে এসে বসল। প্রজ্ঞাকে দেখে ছেলের মা ছেলেকে বলল, আমরা তো যা জানার জেনে নিয়েছি, এবার তোর কিছু জানার থাকলে জিজ্ঞাসা করে নে।
ছেলেটি ঈষৎ হেসে প্রজ্ঞার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, হাই, আমি কুন্তল।
প্রাথমিক জড়তা কাটিয়ে প্রজ্ঞাও হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, আমি প্রজ্ঞা।
– এমএ পাশ করেছেন কোন বছর?
– এ বছর।
– সাবজেক্ট?
– জিওগ্রাফি।
– এবার কী করবেন?
– বিএড। সাথে চাকরির পরীক্ষাগুলাও দিব।
কুন্তলের মা এবার বলল, আমার ছেলে যা বড় চাকরি করে তাতে ওর বউ যে হবে তার চাকরি করার কোনও দরকারই পড়বে না।
প্রজ্ঞা চুপ আছে দেখে কুন্তলের বাবা জিজ্ঞাসা করল, তোমায় যদি চাকরি করতে নিষেধ করা হয় তাহলে তুমি কী করবে?
প্রজ্ঞা একটু ভেবে ঘাড় নেড়ে বলল, করব নাই। মানুষকে তো প্রতিদিন কত কিছু আপস করে চলতে হয়। তাই সংসারে শান্তি বজায় রাখতে এটুকু অ্যাডজাস্ট করতে আমার কোনও আপত্তি নাই।
চোখ মুখ দেখে বোঝা গেল এই উত্তরে ছেলেপক্ষের সবাই খুব খুশি।
এবার কুন্তল জিজ্ঞাসা করল, পড়াশোনার বাইরে আর কী ভালোবাসেন?
– গান।
– গাইতে পারেন ?
– হ্যাঁ।
প্রজ্ঞা গান গাইতে পারে শুনে কুন্তলের মা বলল, তাহলে একটা গান শোনাও তো।
প্রবাল তড়িঘড়ি হারমোনিয়ামটা নিয়ে এল। প্রজ্ঞা হারমোনিয়ামে রিড টিপে গান শুরু করল- চরণ ধরিতে দিয়ো গো আমারে।
পুরো গানটা শেষ করে প্রজ্ঞা সামনে ঝুঁকে প্রণাম করল। সবার চোখে মুখে তখন মুগ্ধতার ছোঁয়া।
গদগদ কণ্ঠে কুন্তলের বাবা বলে উঠল, অপূর্ব তোমার কণ্ঠ। আমাদের বাড়িতে কেউ তেমন গান জানে না। এই নিয়ে আমার খুব আপশোশ ছিল। এবার বোধহয় সেই আপশোশ শেষ হতে চলেছে।
কুন্তলের মা বলল, তোমার কথায় টান আছে বলে একটু আপত্তি ছিল আমাদের। তবে বিশুদ্ধ উচ্চারণে তোমার কণ্ঠে এই রবীন্দ্রসঙ্গীতটা শুনে আমার মনে আর কোনও দ্বিধা রইল না। কী বলিস কুন্তল?
কুন্তল বলল, না মা, আমারও কোনও আপত্তি নেই।
মেয়েপক্ষ রাজি ছিল। এবার ছেলেপক্ষেরও সম্মতি মিলল। এবার শুভকাজ শীঘ্র করার পক্ষপাতী সবাই। তাই তড়িঘড়ি পাঁজি আনা হল। পাঁজিতে চলল শুভদিনের খোঁজ। প্রজ্ঞা তখনও বসে আছে দেখে কুন্তলের মা বলল, এখন তুমি আসতে পারো মা। টেনশনে তোমার চোখ-মুখ একেবারে শুকিয়ে গেছে।
শুকনো হাসি হেসে প্রজ্ঞা বলল, আমার একটা কথা বলার আছে।
কুন্তলের বাবা বলল, বলো।
প্রজ্ঞা মাথা নিচু করে বলল, আমার এ বিয়েতে মত নাই।
সাথে সাথে যেন বজ্রপাত হল ঘরের মধ্যে। গায়ত্রী অবাক হয়ে বলল, সে কী, কেন?
সবার জিজ্ঞাসু দৃষ্টি প্রজ্ঞার দিকে। প্রজ্ঞার দৃষ্টি তখন দূরের দিকে। চোখদুটো যেন কোনও এক অবোধ্য আত্মবিশ্বাসে জ্বলজ্বল করছে। সে দীপ্ত কণ্ঠে বলে উঠল, আমার ভাষার মোটা টানকে আপনারা পছন্দ করেন না, যদিও আমার গানকে করেন। কিন্তু আমি তো আর সর্বক্ষণ গানের সুরে আপনাদের সাথে কথা বলতে পারব নাই। কারণ আমি আমার ভাষার এই টানেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি। তাই আমি সেখানেই বিয়্যা করব যেখানে সবাই, শুধু আমার গানকে নয়, আমার ভাষার টানকেও সম্মান করবে।
এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে প্রজ্ঞা দ্রুত পায়ে ঘরে ঢুকে গেল। মুহূর্তে সবার চোখমুখ তখন বিবর্ণ। যেন কালো নীরবতায় ঢেকে গেছে চারিদিক। তবুও তার মাঝে একটা আলোয় ভরে উঠেছে ঘর। সে আলো কোনও জাগতিক আলো নয়, উপভাষার সম্মান রক্ষায় এক সাধারণ মেয়ের অসামান্য প্রজ্ঞার আলো।
গল্পের সেরা হাত প্রতিযোগিতার ফলাফল: