দে’জ পাবলিশিং নিবেদিত, সংবাদ প্রতিদিন শোনো আয়োজিত ‘গল্পের সেরা হাত’ প্রতিযোগিতায় নির্বাচিত গল্পগুলি থেকে শুনে নিন, অরুণ কর-এর গল্প সংস্কার। এই প্রতিযোগিতার তিন বিচারক ছিলেন শ্রদ্ধেয় সাহিত্যিক অমর মিত্র, যশোধরা রায়চৌধুরী ও জয়ন্ত দে।
পাঠ-অভিনয় শঙ্খ বিশ্বাস
শব্দগ্রহণ অঙ্কুর নন্দী
অলংকরণ সুযোগ বন্দ্যোপাধ্যায়
বাড়ির লাগোয়া জমিটা দীর্ঘদিন আগাছার জঙ্গল হয়ে পড়ে ছিল। সম্প্রতি উঁচু টিন দিয়ে ঘিরে সেখানে বাড়ি তৈরি শুরু হয়েছে। রাস্তা জুড়ে ডাঁই করা ইট, বালি, পাথর, লোহার রড, সে এক এলাহি আয়োজন। সেসব ডিঙিয়েই যাতায়াত করতে হলেও খারাপ লাগে না। শুনেছি তিনি মস্ত মানুষ, অমন কেউকেটা প্রতিবেশীর জন্যে এটুকু তো সইতেই হয়। সারাদিন মিস্ত্রিদের হাঁকডাক এবং ব্যস্ত ছোটাছুটি শুনলে মনে হয় যেন ময়দানবের নির্মাণপর্ব চলছে।
মাঝে মাঝে দামি গাড়িতে চড়ে তিনি আসেন। এক ছুটির দিনে বালি-পাথরের পাহাড় টপকে তাঁর সঙ্গে আলাপ করতে গেলাম। পরিচয় পেয়ে উনি উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলেন। হ্যান্ডশেকের জন্যে হাত বাড়িয়ে দাঁতে দাঁত চেপে অননুকরণীয় ভঙ্গিতে বললেন, আমি কে ডাট।
তারপর লজ্জিতভাবে বারবার বলতে লাগলেন, আসলে আমারই গিয়ে আপনার সঙ্গে আলাপ-পরিচয় করে আসা উচিত ছিল। আপনি আমার নিকটতম প্রতিবেশী–, ইত্যাদি। আরও অনেক কথা বললেন, কিন্তু বেশিটাই খাঁটি মার্কিনি অ্যাকসেন্টের ইংরেজিতে, সব বোধগম্য হল না।
নিতান্ত কথাচ্ছলে উনি যেসব বন্ধুবান্ধব এবং আত্মীয়দের নাম বলতে লাগলেন, তাতে ওঁর প্রতি সমীহ আরও বেড়ে গেল।
একদিন উনি নিজেই আমার বাড়িতে চা খেতে এলেন। আমি তো একেবারে কৃতার্থ। কথায় কথায় অত্যন্ত সংকোচের সঙ্গে বললেন, মিস্ত্রিরা ঠিকমতো ঢেকে রাখছে না বলে বৃষ্টিতে সিমেন্ট ভিজে যাচ্ছে, মিউনিসিপ্যালিটির জলের কানেকশান না পাওয়ায় কাজেরও দেরি হচ্ছে।
আমি তুড়ি মেরে বললাম, আমরা থাকতে এগুলো কোনও সমস্যাই না। দরকার হলে আমার বেডরুমে আপনার সিমেন্ট রাখবেন! আর মিস্ত্রিদের আমার বাড়ি থেকে পাইপ লাগিয়ে যত খুশি জল নিতে বলে দিন।
ডাটদা মৃদু হেসে সস্তা সিটিসি চায়ে চুমুক দিলেন।
দেখতে দেখতে অল্প দিনের মধ্যেই আমাদের সম্পর্কটা বেশ মাখো মাখো হয়ে উঠল।
রাজমিস্ত্রিদের দলে একটা বাচ্চা ছেলে ছিল জোগাড়ে, নাম কদম। ভারি মায়াকাড়া টুলটুলে চেহারা। বয়েস বড়োজোর দশ-এগারো। সে তখনও ভালো করে কোদাল ধরতে শেখেনি, সিমেন্ট-বালির বস্তা চাগাতে হিমশিম দশা, যন্ত্রপাতি চেনে না, ওলন আনতে বললে কর্ণিক এনে হাজির করে আর পদে পদে মিস্ত্রিদের গাল খায়।
তবে যে কোনও প্রয়োজনে কদমই আসত আমাদের বাড়িতে। সামান্য ফুরসত পেলে মুর্শিদাবাদি গ্রাম্য লব্জে টুকটাক গল্প করত। বাড়ির কথা, ছোট বোনটার কথা, বলতে বলতে ওর চোখে জল চলে আসত। শুধু ‘ডাট’দার কথা উঠলে কদমের চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠত। কবে তিনি ওকে চুপিচুপি লবেঞ্চুস এনে দিয়েছেন, কবে দোকানের কচুরি আর গজা খাইয়েছেন, সুযোগ পেলে সেসব কথা ফলাও করে বলত।
ওর কথা শুনে ‘ডাট’দার ওপর আমার ভক্তি আরও বেড়ে যেত!
কদমকে দেখতাম, সেও যেন মালিকের জন্যে জান কবুল করে বসে আছে। মিস্ত্রিদের ফেলে দেওয়া বস্তা ঝেড়ে সিমেন্ট বের করত, বেঁকে যাওয়া পেরেকগুলো হাতুড়ি মেরে সোজা করত, এক কণা বালি কিংবা পাথরের টুকরো নষ্ট হতে দিত না। নিরলসভাবে নতুন গাঁথনি অথবা ঢালাইয়ে জল ঢেলে যেত।
মিস্ত্রিরা বিরক্ত হয়ে গাল পাড়ত, শালার বিটা শালা, এ কি তোর বাপের বাড়ি হচ্ছে নাকি বে?
কদম কিন্তু নির্বিকার।
একদিন বিকেলে সিমেন্ট রাখতে এলে লক্ষ করলাম, ওর চোখের পাশে কালশিটে দাগ, হাতের আঙুল থেকে রক্ত গড়াচ্ছে।
জিজ্ঞেস করলাম, কী হয়েছে, কদম? ভারা থেকে পড়ে গিয়েছিস?
সে উত্তর না দিয়ে জেদি ঘোড়ার মতো ঘাড় নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল।
অনেক সাধ্যসাধনার পর যা বলল, শুনে তো আমি হতবাক। মিস্ত্রিদের মধ্যে একজন টিফিনে যাওয়ার সময় ব্যাগে করে লুকিয়ে খানিকটা সিমেন্ট নিয়ে যাচ্ছিল, কদম সেটা ধরে ফেলাতেই এই বিপত্তি।
এত বড় কাজের নিরিখে নিতান্তই তুচ্ছ ব্যাপার। তবু সেটুকু রক্ষা করবার জন্যে সে অত মার খেয়েছে শুনে মনটা খারাপ হয়ে গেল।
ওকে বললাম, চিন্তা করিসনে, কাল ডাটদা এলে বলে দেব।
শুনে আরও ঘাবড়ে গেল। বলল, মিস্ত্রিরা দল বেঁধে ওকে শাসিয়ে রেখেছে, কথাটা মালিকের কানে গেলে ওকে জ্যান্ত পুঁতে ফেলবে।
তার পরেও দেখতাম অন্যেরা কাজের শেষে ফিরে গেলেও কদম একলা সিমেন্টের বস্তা টানাটানি করে ভেতরে ঢোকাচ্ছে, প্লাস্টিকের শিট যত্ন করে ভাঁজ করে রাখছে, লোহার রডের কাটা টুকরোগুলো গুছিয়ে রাখছে।
দেখতে দেখতে চোখধাঁধানো বাড়িটার নির্মাণ সম্পূর্ণ হল। গৃহপ্রবেশের এলাহি আয়োজন। পাড়া-বেপাড়ার সকল গণ্যমান্যদের সঙ্গে আমিও নিমন্ত্রিত।
সেদিন কোনও একটা কাজে আটকে পড়ায় আমি একটু দেরি করে ফেলেছিলাম।
নতুন বাড়িতে ঢোকবার মুখে সুসজ্জিত তোরণের পাশে দেখি বিষণ্ণ মুখে কদম দাঁড়িয়ে। হাতে একটা প্যাকেট। তার থেকে খাবার বের করে দলা পাকিয়ে সে জটলা করা নেড়িকুকুরদের দিকে ছুড়ে দিচ্ছে।
অমন আমুদে ছেলেটার মুখখানা কালো, চোখে টলটলে জল।
কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই সে হাতের প্যাকেটটা ফেলে দিয়ে হনহন করে হাঁটা দিল।
আমি ঢুকতেই ডাটদা মহাসমাদরে ভেতরে নিয়ে গিয়ে মান্যগণ্য অতিথিদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। তারপর নিজে ঘুরে ঘুরে দুষ্প্রাপ্য মার্বেল আর গ্রানাইটের কারিকুরি, ইটালিয়ান কমোড, নামী ব্র্যান্ডের দামি ফিটিং- সব দেখাতে লাগলেন। সর্বত্র রুচি এবং বৈভবের ছাপ স্পষ্ট।
ঢালাও খাওয়াদাওয়ার আয়োজন। উর্দি পরা বয়েরা সুদৃশ্য ট্রেতে গরম গরম মাংসের পকোড়া নিয়ে ঘুরে ঘুরে পরিবেশন করছে। হাতে হাতে ফিরছে নরম-গরম পানীয়ের গেলাস।
ঝাড়বাতি লাগানো বিশাল হলঘরে দেশি এবং কন্টিনেন্টাল মিলিয়ে বুফে লাঞ্চের আয়োজন।
ডাটদাকে বললাম, আসার পথে কদমকে দেখলাম-
উনি আমার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বললেন, আমিই আসতে বলেছিলাম। ওরাই তো এতদিন খেটেখুটে বাড়িটা বানাল, আজ শুভদিনে ওদের কি বাদ দেওয়া যায়?
তারপর গলার স্বর কিঞ্চিৎ নামিয়ে বললেন, তবে একটা কথা তোমাকে না বলে পারছিনে। আজ আমার একটা ভালো শিক্ষা হল।
ডাটদার গলায় উষ্মা স্পষ্ট। কৌতূহল চেপে আমি ওর মুখের দিকে তাকালাম।
নিজেই বললেন, ছোটলোকদের বেশি লাই দিয়েছ, কি মরেছ। এই দেখো না, কাজটা যাতে তাড়াতাড়ি হয়, মালপত্র চুরি না হয়, তার জন্যে ওদের একটু তোল্লাই দিয়ে ফেলেছিলাম। তার ফল কী হল জানো?
ওঁর কাছেই শিখেছি, কোনও ব্যাপারে অযথা কৌতূহল দেখানো ঠিক না। চুপ করে আছি দেখে ফের বলতে শুরু করলেন, আজ ঠাকুরঘরে তোমার বউদি নিজে দাঁড়িয়ে থেকে নারায়ণ প্রতিষ্ঠা করাচ্ছিলেন। এমন সময় বলা নেই, কওয়া নেই, ব্যাটাচ্ছেলে কদম সটান সেখানে ঢুকে পড়ল! তোমার বউদি তো রেগে আগুন! আমি অবশ্য ওসব মানিনে, কিন্তু পুজো-আচ্চার ব্যাপার, হাজার হোক ছেলেটা জাতে মোচলমান, বুঝলে না!
জিজ্ঞেস করলাম, অন্য মিস্ত্রিরা আসেনি?
ডাটদা বললেন, আসবে না কেন? ওদের জন্যে আলাদা ফুড প্যাকেট করেছি্লাম, যে যার মতো নিয়ে চলে গেছে। কত বড় বড় মানুষ এসেছেন, মিস্ত্রিমজুরদের তো আর তাঁদের সঙ্গে একই পঙক্তিতে বসিয়ে দেড় হাজার টাকার প্লেট খাওয়ানো যায় না!
পেটের মধ্যে আগুনে খিদে চেপে আমি ডাটদার হাত ধরে বললাম, চমৎকার বাড়ি হয়েছে দাদা, একেবারে নিখুঁত। আপনার আজকের আয়োজনও যাকে বলে, এক্কেবারে লা-জবাব। কিন্তু আমার কপালটাই খারাপ দাদা, আপনাকে বলতে ভুলে গিয়েছিলাম, আজ আমার উপোস।
উনি বললেন, বেশ তো, একটু শরবত-মিষ্টি—
বলতে বলতে উনি হাঁক পাড়লেন, কানু, অ্যাই হারামজাদা কানু–, দেখো চাকরবাকরগুলোও হয়েছে তেমনি। তোমাকে যে একটু মিষ্টি-ফিষ্টি দিতে বলব-
আমি বিনীতভাবে বললাম, আপনি শুধু শুধু ব্যস্ত হচ্ছেন দাদা। আজ আমার বাইরে কোনও কিছু খাওয়া বারণ।
ডাটদার মুখে সেই চিরাচরিত তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটে উঠল। বিদ্রুপের গলায় বললেন, তোমরা সেই আদ্যিকালের সংস্কার থেকে বেরোতে পারলে না!
গল্পের সেরা হাত প্রতিযোগিতার ফলাফল: