দে’জ পাবলিশিং নিবেদিত, সংবাদ প্রতিদিন শোনো আয়োজিত ‘গল্পের সেরা হাত’ প্রতিযোগিতায় নির্বাচিত গল্পগুলি থেকে শুনে নিন, উৎসা তরফদারের গল্প পাপস্খালন। এই প্রতিযোগিতার তিন বিচারক ছিলেন শ্রদ্ধেয় সাহিত্যিক অমর মিত্র, যশোধরা রায়চৌধুরী ও জয়ন্ত দে। তাঁদের বিচারে যুগ্ম প্রথম স্থান পেয়েছে এই গল্পটি।
পাঠ চৈতালী বক্সী, শঙ্খ বিশ্বাস
শব্দগ্রহণ অঙ্কুর নন্দী
অলংকরণ অর্ঘ্য চৌধুরী
নীলচে চোখের মণি। সরু লম্বা হলদেটে ঠোঁট। ডানার রং সাদা, তাতে অবশ্য পাঁকের পরত লেগেছে এখন। হলদেটে পা দুটোও পাঁকে মাখামাখি; তার উপর ডান দিকের পা-টা নারকেল দড়ি দিয়ে শক্ত করে বাঁধা। দড়ির অন্য প্রান্ত বাঁধা একটা প্রমাণ সাইজের আধলা ইটের সঙ্গে। বোল্টে দেখেই বুঝেছে, এই সারস জাতীয় পাখিটার বয়স তেমন নয়। নেহাতই ছেলেমানুষ।
এ বয়সের পাখিগুলোই ফাঁদে ধরা পড়ে বেশি। দলের বড়দের সঙ্গে পাঁকে নামে মাছ ধরতে। তারপর মাছের লোভেই, আর সময় থাকতে উঠতে পারে না। এদের আসার সময়গুলো বোল্টের বাবা-কাকাদের একেবারে নখদর্পণে। একটু বুদ্ধি খাটালেই কম করে দু-তিনটে পাখি ধরা পড়ে যায় জালে। আজ যদিও একটার বেশি হাতে আসেনি। তা ছাড়া আজকাল এসবে সমস্যাও অনেক। পুলিশের কানে খবর গেলেই পাখি তো নিয়ে যাবেই, উলটে ক্ষতিপূরণও দিতে হতে পারে। এসব পাখি নাকি খাওয়া নিষেধ, এতে নাকি পরিবেশের ক্ষতি… আরও কত কী ভুংভাং!
পাখিটার ঘোলাটে চোখে ভয়। যেন ধরা পড়ার মুহূর্ত থেকেই নিজের ভবিতব্য জানান পড়ে গেছে ওর। যেন এখানে দাঁড়িয়েই ও বুঝতে পারছে, আলু ছিলতে বসে গেছে বোল্টের মা। ডান পা-টা ক্লান্ত ভাবে ছাড়ানোর চেষ্টা করতে করতে পাখিটা ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে বোল্টের দিকে। একটু দূরে বসে বোল্টেও দেখছে পাখিটাকে। বেশিক্ষণ বসে থাকলে হবে না যদিও; ওর ইস্কুল যাওয়া আছে খানিক বাদেই।
(২)
অনেক, অনেক দিন বাদে আজ সারস পাখি ধরা পড়েছে বোল্টের কাকার পেতে রাখা ফাঁদটায়। তবে মন ভরেনি বাড়ির কারোরই। ছোট পাখি, মাথাপিছু ভাগে দু টুকরো করে পড়বে বড়জোর! এদিকে ঘরে পিঁয়াজ ফুরিয়েছে। মা বোল্টেকে বলেছে, ইস্কুলে যাওয়ার আগে একছুটে গলির মুখের দোকানটা থেকে একশো পিঁয়াজ এনে দিয়ে যেতে। একটু পিঁয়াজ রসুন মরিচ দিয়ে কষালে অল্প তরকারিতেই অনেক ভাত উঠে যায়।
মাংস হবে জানলেই ইস্কুল যেতে আর মন করে না বোল্টের। কিন্তু উপায় আছে? কামাই তো দূরের কথা, মিনিট বিশ দেরি হলেই বকুনি দেয় মাস্টার। আগের বছর পর্যন্ত এসবের বালাই ছিল না যদিও। মাস ছয়েক আগের কথা, হঠাৎই একদিন শহর থেকে কয়েকজন সোমত্ত বয়সের ছেলে এল ওদের গ্রামে। কেমন ফটর ফটর ইংরেজি বলে, দেখলেই বুক ঢিপঢিপ! গ্রামের একপ্রান্তে তারা রাতারাতি খুলে বসল একখানা ইস্কুল। স্বাভাবিক ভাবেই, গ্রামের লোকেরা মেনে নেয়নি প্রথমটায়। বোল্টের বাবারা রাগও করেছিল খুব। ইস্কুল হয়তো উঠেও যেত, কিন্তু ছেলেগুলো সহজে দমবার পাত্র নয়। কদিনের মধ্যেই কী জানি তুকতাক করল, মোড়ল এসে শেষটায় গ্রামের লোকেদেরই বুঝিয়ে বলল, ওদের না চটাতে।
সেই থেকে ইস্কুল রয়ে গেল। ছেলেগুলো শুধু ইস্কুল খুলেই থামল না। বাড়ি বাড়ি এসে বলে গেল, সবাই যেন তাদের ছেলেমেয়েদের পড়তে পাঠায়। গ্রামে আগেও স্কুল একটা ছিল ঠিকই, কিন্তু সেখানে পড়তে পয়সা লাগে। এই নতুন ইস্কুলে নাকি সেসবের ঝামেলা নেই! প্রথম প্রথম দ্বিধা থাকলেও ধীরে ধীরে বেশ কয়েক বাড়ির লোক, ওদের বাচ্চাদের পাঠাতে থাকে ইস্কুলে। বোল্টেও যায়।
সত্যি বলতে, ওর ততটাও খারাপ লাগে না আজকাল। মাস্টারেরা রাগি হলেও মানুষ ভালো। এই কয়েক মাসে কত্ত কিছু শিখেছে ওরা। জল, বল, কল বানান করা, দুলে দুলে এক থেকে বারোর নামতা পড়া, এ থেকে জেড…। আর শিখেছে, খাবার খাওয়ার আগে সাবান দিয়ে হাত ধুতে হয়। কচলে কচলে। শিখেছে মেয়েদের পাশাপাশি ছেলেরাও যদি সবজি কেটে দেয়, নিজের জামা নিজে কেচে নেয়, তাতে নাকি ক্ষতি নেই তেমন।
ইস্কুলের ভিতরের দেওয়াল জুড়ে নানা রকম রং দিয়ে কত কী পশুর ছবি আঁকা আছে! মোটা অক্ষরে লেখা আছে, জঙ্গলের পশুদের সাহায্য করার কথা। প্রতিদিন ছুটির আগে মাস্টারদের সাথে সুর মিলিয়ে বলতে হয় ছাত্রছাত্রীদেরকেও, “বন আমাদের বন্ধু। বনের পশুরা আমাদের বন্ধু। বনের পশুদের রক্ষা করা আমাদের কাজ!”
(৩)
“কাল ছিক্ষক দিবস নয়, ছার?” গতকাল পড়তে বসে রুপু কথাটা পেড়ে বসল। মাস্টার তখন সবে ব্ল্যাকবোর্ড জুড়ে ইংরেজি বানান লিখতে শুরু করেছে। সে মুখ ফিরিয়ে চোখ গুলি গুলি করে বলল, “বাপরে! তুই আবার এসব জানলি কোত্থেকে!” “ফোনে দেকিচি।” লজ্জা লজ্জা মুখ করে বলল রুপু। রুপুর বাবার বিরাট মাছের আড়ত রয়েছে। পয়সাকড়ির অভাব নেই তা পোশাক পরিচ্ছদে দিব্যি ধরা পড়ে। মাস্টার মাথা নামিয়ে হাসল; গ্রামে খুঁজলে কয়েক বাড়িতে স্মার্টফোন মিলে যাবে ঠিকই। শুধু বাচ্চাকে পয়সা খরচ করে স্কুলে পাঠাতে এদের এতখানি অনীহা।
“তাইলে আমাদের চাউমিন খাওয়াবেনে ছার?” কথাটা বলেই জিভ কাটল ফচকে গণেশ। কয়েকদিন আগেই কার ফোনে চাউমিন দেখে থেকে খাওয়ার খুব শখ জেগেছে ওর। ইস্কুলে এসে সে শখের কথা বলাও হয়ে গেছে জনে জনে। মাস্টার হেসে বলল, “বেশ। চাউমিনই খাওয়াব। তোরা তার বদলে কী দিবি শুনি?” “আমরা দোবো!” রুপু অবাক হল একটু। মাস্টার ভ্রূ নাচিয়ে হেঁয়ালি করে বলল, “হ্যাঁ, তো দিবি না? শিক্ষক দিবসে তো মাস্টারকেই উপহার দেয় ছাত্ররা! তার বদলে মাস্টার খাওয়ায়!”
(৪)
“বন আমাদের বন্ধু। বনের পশুরা আমাদের বন্ধু। বনের পশুদের রক্ষা করা আমাদের কাজ!”
ভেজা আলের পাশ ধরে কাঁপা পায়ে ছুটে চলেছে বোল্টে।এই রাস্তায় মুদির দোকান পড়ে না, কিছুই পড়ে না বলতে গেলে। স্থানীয় লোকেরা ছাড়া এই শর্টকাট কেউই জানে না তেমন। বনের গা ঘেঁষেই তো জীবনের তেরোটা বছর কেটে গিয়েছে ওর। চৈত্র মাসে বাবার সঙ্গে নৌকা চেপে বনের গভীরে মৌচাক ভাঙতে গেছে। বর্ষার পর কাকার সাথে কাদায় নেমে, বর্শার আগায় গেঁথেছে কাঁকড়া আর পাঁকাল মাছ। বনই ওদের বাঁচিয়ে রেখেছে এত বছর ধরে। অথচ কোনোদিন বাবা-কাকাদের আলাদা করে এমন কথা বলতে শোনেনি ও।
গ্রীষ্মে যেবার অনেক রাতে গ্রামে হাতি ঢুকল, গণেশদের সাথে মিলে ও-ও ইয়া বড় বড় পটকা ছুড়ে মেরেছে তাদের গায়ে। আর গত শীতে যখন ভোরের দিকে রুপুর বাবাদের আড়তে মাছ খেতে গিয়ে ধরা পড়ল একটা মোটাসোটা বাঘরোল… গ্রামের মাঝের উঁচু বটগাছটায় ঝোলানো হয়েছিল ছাপা-ছাপা নিথর দেহটা। বোল্টের চেনাজানা কত প্রতিবেশীকেই তো ও দেখেছিল, ছুরি কাটারি নিয়ে ঝুলন্ত মৃত শরীরটার উপর হামলে পড়তে! যেন মোচ্ছব!
একপাশে কালচে সবুজ নিশ্ছিদ্র জঙ্গল; অন্যপাশে মৃদঙ্গভঙ্গ নদী। বোল্টে ছুটছে ইস্কুলের উদ্দেশে। বুকের কাছে দলা পাকিয়ে আঁকড়ে ধরে রয়েছে ইস্কুলে নিয়ে যাওয়ার ব্যাগখানা। আজ প্রথমবার পিঁয়াজ আনতে ইচ্ছে করেনি ওর। বোল্টের পা দুটো কেঁপে যাচ্ছে একেকবার, এমন কাজ তো আগে করেনি কখনও। কিন্তু ঘাবড়ে গিয়ে থেমে গেলেও চলবে না। বাড়ির লোক, পাড়া প্রতিবেশী – কেউ দেখে ফেলার আগে যেভাবে হোক ইস্কুলে পৌঁছাতে হবে। হবেই!
ঢুকলেই মাস্টার চোখ পাকাবে, বলবে, “বোল্টে আজ আবার লেট? সব শিখলি, শুধু ঘড়ি দেখা শিখলি না এক্কেবারে!” বোল্টে আজ ভয় পাবে না। হাঁপাতে হাঁপাতেই, বুকে চেপে রাখা ব্যাগটা ও কাঁপা হাতে এগিয়ে দেবে মাস্টারের দিকে। ব্যাগের মুখ আলগা করতে, ভিতর থেকে বেরিয়ে আসবে একটা হলদে ঠোঁট, একজোড়া সপ্রতিভ নীল চোখ। ফের আকাশ দেখতে পাওয়ার আনন্দে কর্দমাক্ত ডানা দুখানা ঝাপ্টে উঠবে আরও একবার।
পায়ের দড়ি খুলে পাখিটাকে আকাশে উড়িয়ে দিতে দিতে, বিস্ময়ে হতবাক হয়ে তাকাবে মাস্টার। মাথায় আশীর্বাদের হাত রেখে মুগ্ধ গলায় বলবে, “করেছিস কী বোল্টে?” বোল্টে সদর্পে উত্তর দেবে, “উপহার, ছার। আজ ছিক্ষক দিবস নয়?”
গল্পের সেরা হাত প্রতিযোগিতার ফলাফল: