দে’জ পাবলিশিং নিবেদিত, সংবাদ প্রতিদিন শোনো আয়োজিত ‘গল্পের সেরা হাত’ প্রতিযোগিতায় নির্বাচিত গল্পগুলি থেকে শুনে নিন, অয়ন ভট্টাচার্যের গল্প মন-কি-বাত। এই প্রতিযোগিতার তিন বিচারক ছিলেন শ্রদ্ধেয় সাহিত্যিক অমর মিত্র, যশোধরা রায়চৌধুরী ও জয়ন্ত দে। তাঁদের বিচারে দ্বিতীয় স্থান পেয়েছে এই গল্পটি।
পাঠ চৈতালী বক্সী, শঙ্খ বিশ্বাস, শুভদীপ রায়
শব্দগ্রহণ অঙ্কুর নন্দী
অলংকরণ সুযোগ বন্দ্যোপাধ্যায়
সকাল হয়েছে। বালিশটা অনেকক্ষণ থেকেই কানে সুড়সুড়ি দিচ্ছিল।তারপর বিছানার গদিটা আমাকে জোর করে ঠেলে তুলেই দিল। মা বলল, ধ্রুব তৈরি হয়ে নাও তাড়াতাড়ি।
ঘুম চোখে ব্রাশ-পেস্ট নিয়ে বেসিনে গেলাম। জলের কলটা ফিসফিস করে বলল, মুখটা সামনে নিয়ে এস ধ্রুব, না হলে জল ছিটবে।
আরও শুনুন: গল্পের সেরা হাত: ভালো লোক, খারাপ লোক | সুজয় চক্রবর্তী
তোয়ালে মুখ মুছিয়ে বলল, ধ্রুব চোখ বন্ধ রাখো, মুখ উপরে তোল ,বাহ্ লক্ষ্মী ছেলে।
আমি বিরক্ত হয়ে টয়লেটে গেলাম। এরা রোজ খালি জ্ঞান দেয়। কমোড, বেসিন, শাওয়ার , সাবান, তেল, স্নানের তোয়ালে, পোশাক– সবাই আমায় যত্ন করে তৈরি করে দিল। আর সাবধান করতে লাগল, বেশি যেন জল না নষ্ট করি, সাবান ঠিক প্রয়োজন মতো যেন মাখি, ময়েশ্চারাইজার ত্বকের গভীরে যেন সঠিক ভাবে মিশে যায়, চুল একদম পরিপাটি করে আঁচড়াতে হবে, প্যান্টের জিপারটা যেন নিজে টেনে নিই ইত্যাদি।
মা খাবার টেবিলে বসে আছে আমার অপেক্ষায়। উলটো দিকের দেওয়ালে ‘মন কি বাত’ চালু হয়েছে। মাকে এখন শুনতে হবে এক ঘণ্টা চুপ করে।
আমি বসলাম, আমার থালা বলল, আজ বৃহস্পতি বার , আজ কিন্তু ডিম খাবে না, শুধু ফল আর দুধ। আর অবশ্যই খাওয়ার আগে প্রার্থনা।
আমি চোখ বন্ধ করে মন্ত্র জপলাম, মানে কিছু বুঝি না কিন্তু জপ করতেই হবে। না করলে হয়তো বাবার মতো হবে। এমনই এক বৃহস্পতি বার মায়ের জন্মদিন ছিল। বাবা ঘুম থেকে উঠে মাকে চুমু খেল, আর দেওয়াল থেকে সঙ্গে সঙ্গে ‘ছি ছি’ সাউন্ডের সাইরেন বেজে গেল। সেটা ছিল শুধু ওয়ার্নিং, কিন্তু বাবা কী খেয়ালে সেদিন ছিল কে জানে! চায়ে পে চর্চার পবিত্র বাণী যখন সবার ঘরের দেওয়ালে দেওয়ালে প্রচার করা শুরু হয়েছে বাবা তখন চুপি চুপি একটা বিয়ারের ক্যান খুলেছিল, আর মাকে চোখ টিপেছিল। তক্ষুনি ওরা এল, দেওয়াল ফুঁড়ে, ছাদ ফুঁড়ে ক্রমাগত সাইরেন বাজল একটানা ‘ছি ছি ছি ছি’ সুরে…বাজতেই লাগল…আর ওরা এসে বাবাকে নিয়ে চলে গেল।
আরও শুনুন: গল্পের সেরা হাত: পাপস্খালন | উৎসা তরফদার
বাবা নাকি আবার ফিরে আসবে। এমনই বলছে বাবার জামা-প্যান্ট আর চশমা কদিন ধরে। বাবার কিছু পুরোনো বই আছে,ওরা কোনও কথা বলতে চায় না, শুধু বাবার জন্য ওরা অপেক্ষা করে আছে অনেকদিন। ওরা দেওয়াল থেকে খবর পায়, বাবাকে নাকি দীক্ষা দিয়েছে, বাবার দীক্ষা নেওয়া ছিল না তো তাই নাকি মাঝে মাঝে অমন বিগড়ে যেত।।এখন আশ্রমে দীক্ষা পরবর্তী পাঠ নিচ্ছে বাবা।
মা আমার দিকে তাকাল। মন কি বাত শেষ হয়েছে, এইসময় মায়ের মুখটা খুব শক্ত হয়ে থাকে। মার চোখে ধূসর কাচের চশমা, যেটা খোলা যায় না, কপালের টিপ, সিঁথির সিঁদুর, হাতের চুড়ি– এগুলো সব হাত থেকে খোলা বারণ। মা এখন হাসে না, আমায় জড়িয়ে ধরে না, আমাকেও আদর করে চুমু খায় না।
আমায় খাবার দিল মা। ফল আর দুধ। আর বলল, আজ থেকে তোমার নতুন পাঠ শুরু হবে ধ্রুব…।
আমি শান্ত চোখে তাকালাম, আশ্রমে আমার নতুন পাঠ মানে নতুন কোনও গুরুদেব, নতুন শিক্ষা, আর কিছুদিন পাঠ নিয়ে ফেলার পরেই আমার দীক্ষা হবে, আমার একটা ধূসর চশমা হবে মায়ের মতো, আমি শুদ্ধ, সভ্য নাগরিক হয়ে যাব।
মা বলল, খুব মন দিয়ে আজ থেকে পাঠ নিয়ো ধ্রুব, আজ থেকে তোমার অনেক দায়িত্ব বেড়ে যাবে।
আমার খাওয়া শেষ, গ্লাস বলল– জল খাও।
দরজা শুনলাম ডাকছে– বাস এসে গেছে ধ্রুব, তাড়াতাড়ি এসো।
আমার জুতো পায়ের নিচে সুড়সুড়ি দিচ্ছে– ধ্রুব দেরি কোরো না, নতুন গুরুমশাই অপেক্ষা করে থাকবেন।
আমি বিরক্ত হলাম, আমার এত জ্ঞান ভালো লাগে না, সবাই আমাকে ভালো বানাতে উঠে পড়ে লেগেছে।
মা কে বললাম– আমার আজ আশ্রম যেতে ভালো লাগছে না।
আমি জানি মায়ের চশমার পিছনের চোখ দুটো এখন অনেক মায়া নিয়ে আমায় দেখছে। মা আমায় বুকে নিয়ে আদর করতে পারে না, আমাদের এখন কান্না ও হাসি দুটোরই অনেক বিধিনিষেধ আছে।
মা বলল– যাও ধ্রুব, দেরি হয়ে যাচ্ছে।
আমি বাসে আমার নির্দিষ্ট সিটে বসলাম, আমার সঙ্গে আশ্রমের অন্য ছাত্ররাও বসেছে। সবাই নিজের সিটে চুপ করে ভেড়ার মতো, গরুর মতো, ছাগলের মতো বসে মানুষ হতে যাচ্ছি। কেউ কারও সঙ্গে বেশি কথা বলি না, বললে বন্ধুত্ব হয়ে যেতে পারে, তাহলে আবার ‘ছি ছি ছি ছি’ সাইরেন বেজে উঠতে পারে।
বাসের জানালা বলল– বাইরে হাত বার করবে না ধ্রুব। রাস্তায় মেয়েদের দিকে বেশি তাকাবে না।
বাসের সিট বলল– স্থির হয়ে বসে থাকো, প্রার্থনা শুরু করে দাও।
আশেপাশের ভেড়ার দল তাই করছে। আমি চোখ বুজে চেষ্টা করি, আমার ভাল লাগছে না। বাবার মুখ মনে পড়ছে, বাবা জিভ ভ্যাংচাতো, হ্যা হ্যা করে হাসত, গালাগাল দিত, চশমা একদম চোখে রাখত না, মাকে যখন তখন আদর করতে যেত…আমার মন এইসব ভেবে বিক্ষিপ্ত হয়ে যাচ্ছে।
জানলা দিয়ে হাওয়া আসছে মুখে, আমি চোখ খুলে তাকালাম, সিগনালে বাস দাঁড়িয়েছে। রাস্তায় সব ভালো মানুষের দল হেঁটে যাচ্ছে। শান্ত নিয়ন্ত্রিত নাগরিক জীবন। আমি চোখ বুজে বিড়বিড় করলাম– ভাল লাগছে না।
আশেপাশের গরু, ভেড়ার মধ্যে দু-এক জন ফিসফিস করল, আমি শুনতে পেলাম ওরাও বলছে– আমার ভাল লাগছে না।
আমি চোখ মেললাম, সিগন্যালের সেন্সর, সি সি টিভি, আকাশের ড্রোন, কেমিক্যাল সার দিয়ে বড় করে তোলা সবুজায়নের প্রকাণ্ড গাছ, নীরবে মাথা হেঁট করে চলা শান্ত মানুষের দল– সবাই ফিসফিস করছে, সবাই বলছে ওই একই কথা– নাকি আমি একা একাই মনে মনে শুনছি– আর ভাল লাগছে না!
গল্পের সেরা হাত প্রতিযোগিতার ফলাফল: