দে’জ পাবলিশিং নিবেদিত, সংবাদ প্রতিদিন শোনো আয়োজিত ‘গল্পের সেরা হাত’ প্রতিযোগিতায় নির্বাচিত গল্পগুলি থেকে শুনে নিন, উস্রি দে-এর গল্প ফাঁদ। এই প্রতিযোগিতার তিন বিচারক ছিলেন শ্রদ্ধেয় সাহিত্যিক অমর মিত্র, যশোধরা রায়চৌধুরী ও জয়ন্ত দে।
পাঠ-অভিনয় চৈতালী বক্সী, শঙ্খ বিশ্বাস
শব্দগ্রহণ অঙ্কুর নন্দী
অলংকরণ সুযোগ বন্দ্যোপাধ্যায়
বেলা পড়ে আসতেই চারপাশটা কেমন বদলে গেল। গাছগাছালির গায়ে গায়ে, পাতায় পাতায় লগ্ন হয়ে রইল শেষ বিকেলের নরম আলো। বাস স্টপে দাঁড়িয়ে দেখতে থাকা এই দৃশ্যটাই গুঞ্জনের মনটাকে ভালো করে দিল। না হলে মেজাজটা এমনিতেই যা খিঁচড়ে ছিল এতক্ষণ। একটা ক্লাস ফোরের বাচ্চা, সব সাবজেক্ট পড়িয়ে মাসে তো ওই কটা টাকা মেলে, তাও আবার আজ থেকে বন্ধ হয়ে গেল। কেন-না, বাচ্চার রেজাল্ট নাকি আশাপ্রদ হয়নি। আর কী চায় বাবা মায়েরা, বুঝতে পারে না গুঞ্জন! ক্লাসে দশজনের মধ্যে আছে, তবু এদের মন ওঠে না। মাসিক আয় হঠাৎ করে কমে যাওয়ার বিষণ্ণতা কিছুটা হলেও কমে গেল প্রকৃতির অকৃপণ দানে। প্রকৃতি কখন কোন সাজে সেজে ওঠে, আর মন তার থেকে রসদ খুঁজে নেয়, বেঁচে থাকার!
ভাবতে ভাবতেই ওর রুটের বাসটা এসে পড়ে। ঠেলাঠেলি করে কিছু যাত্রী নামে, কিছু ওঠে। গুঞ্জন দেখে আর ভাবে, এই চলমানতাই তো জীবন! সূর্যাস্তের ওই মোহময় রূপের টান এক ঝটকায় কাটিয়ে ভিড়ের মধ্যে নিজেকে গুঁজে দিল গুঞ্জন।
সমরের দোকান থেকে এক প্যাকেট সিগারেট নিতে গিয়ে পাশে মেড প্লাস-এর দোকান দেখে মনে পড়ল মায়ের প্রেশারের ওষুধটা নিতে হবে। ওদিকে এগোতেই কাঁধে একটা হালকা হাতের চাপড়। চমকে ফিরে দেখে কিঞ্জল। পোশাক আশাকে চেহারায় জলুস ফুটে বেরোচ্ছে। চেনাই দায়! কী করে! সেসব জানে না গুঞ্জন। এই শ্যামসুন্দরপুরের প্রভাবশালী নেতা মোহন ঘোষের ডান হাত। কী ছিল এই কিঞ্জল! গুঞ্জনদের ক্লাসেই পড়ত, তাও দুবছর ফেল করে। তারপর স্কুলের গণ্ডি আর পেরোতে পারেনি। পুরপ্রধান মোহন ঘোষ- শোনা যায় এই অঞ্চলের বিধায়ক থেকে সাংসদ সবাই ওকে সমঝে চলে, ভোট ব্যাঙ্ক যে ওই-ই কন্ট্রোল করে!
কিঞ্জল বলে–
‘কিরে! তোর তো দেখাই পাওয়া যায় না! কোথায় থাকিস সারাদিন?’
‘কোথায় আর থাকব! রোজগারের ধান্ধায় ঘুরে বেড়াতে হয় আর কি !’
‘অ! তা ক-টাকা হয় সারা মাসে?’
‘কেন লজ্জা দিচ্ছিস? আমাদের আবার…’
‘অ্যায়, এইজন্যই বলি আমাদের সাথে যোগাযোগ রাখ! তা না ফালতু ছাত্তর ঠেঙিয়ে…। যাকগে শোন, কাল সক্কাল সক্কাল পাট্টি অপিসে চলে আয়। মোহনদা ডেকেছে।’
‘আমাকে!’
‘আমি এক কথা দুবার বলি না’– বলেই বাইকে স্টার্ট দিয়ে ধোঁয়া ছড়িয়ে চলে যায় কিঞ্জল।
ওষুধটা নিয়ে বাড়ির রাস্তা ধরে গুঞ্জন। মনের মধ্যে টালবাহানা। কাল যাবে কি যাবে না। হঠাৎ ওকে কেন ডাকল! তবে কি কোনও কাজের ব্যবস্থা হবে? কী কাজ? খারাপ কিছু না তো! ওঁর সম্পর্কে যা সব শোনা যায়! আশা নিরাশার দোলাচল, ভয় উৎকণ্ঠা সব মিলিয়ে মনটা ভার হয়ে আসে। রাতে ছোট্ট চৌকিটায় শুয়ে এইসবই ভাবছিল, মোবাইল বেজে উঠল। মঞ্জরী!
‘ঘুমিয়ে পড়েছ নাকি?’
‘না, তোমার কি নাইট শিফট?’
‘হ্যাঁ, এই জানো তো আমাকে হসপিটালের পাশেই স্টাফ কোয়ার্টার অ্যালট করেছে!’
‘বাঃ!’
‘আমাদের থাকার ব্যবস্থা হয়ে গেল! এবারে তুমি একটা কিছু জুটিয়ে নিতে পারলেই সোজা রেজিস্ট্রি অফিস। ইসস, আমার ভাবতেই কী যে ভালো লাগছে!’
‘তার মানে আমি বউয়ের বাড়িতে থাকব!’
‘ওরকম ভাবার কী আছে! তোমার যদি হত, আমি থাকতাম না?’
‘আচ্ছা মঞ্জরী, তোমার ঘরের জানালা থেকে চাঁদ দেখা যায়? সামনে একটা পুকুর আছে না? পূর্ণিমায় গাছের পাতার ফাঁক গলে চাঁদের আলো আলপনা আঁকবে ঘাটে। বসে থাকব দুজনে নীরবে। বাতাস কথা বলবে ফিসফিসিয়ে। দু-একটা রাতচরা পাখি মাঝেমধ্যে শুধু…’
‘ব্যস, শুরু হয়ে গেল তো কাব্য! এখন শুয়ে পড়ো। কাল কথা হবে।’
পরদিন সকালে পার্টি অফিসে ঢুকতেই মোহন ঘোষ বলল-
‘শোনো গুঞ্জন, কমার্স নিয়ে পড়েছ তো? কাজিপাড়ার মোড়ে আমার যে চুন, বালি, সিমেন্টের গুদাম আছে, ওখানে একজন হিসাবরক্ষক দরকার। এই কাজটাতে লেগে পড়ো। মাস গেলে পনেরো পাবে। ঠিক আছে?’
ছাত্র পড়িয়ে মাসে দশ হাজারও হয় না। তার মধ্যে আজ আছে, কাল নেই! সেদিক থেকে…।
‘কী ভাবছ?’
‘না মানে, কখন যেতে হবে?’
‘দশটা পাঁচটা, একদম সরকারি অফিসের মতো।’ ঠোঁটের কোণে হাসলেন মোহনদা।
পাঁচটার পরে সন্ধের দিকের টিউশন করাই যেতে পারে, মনে মনে ভাবে গুঞ্জন। বাবার অকালমৃত্যুর পর সংসারের যা হাল! সামান্য পেনশন ভরসা। মায়ের হার্টের কন্ডিশন ভালো না। ডাক্তার বলেছেন, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব অপারেশন করাতে। ছোট ভাই বোন দুটো পড়ছে।
‘ঠিক আছে, তাহলে কাল থেকেই…’। নিঃশব্দে মাথা নাড়ে গুঞ্জন।
‘ও, তোমার কোনও ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট আছে? মাইনেটা ওখানেই ঢুকবে, ডিটেইলটা দিয়ে যেয়ো।’
ছাত্রাবস্থাতেই গুঞ্জনের বাবা ওকে দিয়ে একটা অ্যাকাউন্ট খুলিয়েছিলেন ব্যাঙ্কে। উনি বলতেন, রোজগার করলে কিছু একটু তার থেকে ওখানে জমাবি। সেইমতো সামান্য কিছু পুঁজি রয়েছে গুঞ্জনের অ্যাকাউন্টে।
প্রথম মাসের মাইনে পেয়ে গুঞ্জন একটু হাঁপ ছাড়ল। কাজটা যদিও ভীষণ একঘেয়ে, তা ছাড়া সিমেন্টের বস্তার ধুলোয় যা চেহারা হয়! তা হোক। পনেরোর সাথে ওর সান্ধ্যকালীন টিউশন মিলে রোজগারটা তো বেড়েছে! গুঞ্জনের মনে নেতার সম্বন্ধে যে ভীতি ছিল, ধীরে ধীরে কাটতে শুরু করল। সারাদিনের পরিশ্রমের পর রাতে মঞ্জরীর নতুন ঘরের গল্প স্বপ্ন বোনে গুঞ্জনের মনে, চোখের পাতা ভারী হয়ে আসে শুনতে শুনতে। তৃতীয় মাসে মাইনে ঢোকার পর গুঞ্জনের মোবাইলে মেসেজ ঢুকল– একটা লাম্পসাম অ্যামাউন্ট জমা পড়েছে ওর অ্যাকাউন্টে। কী ব্যাপার? কে পাঠাল? ব্যাঙ্কে খোঁজ নিয়ে জানল মোহন ঘোষের অন্য অ্যাকাউন্ট থেকে ওর অ্যাকাউন্টে জমা পড়েছে টাকাটা। মোহন ঘোষকে জিজ্ঞেস করাতে বলে-
‘মায়ের অপারেশনটা করিয়ে নাও।’
‘কিন্তু, এত টাকা! আমি…’
‘আরে ঠিক আছে। মানুষের পাশে থাকাই তো আমাদের কাজ!’
গুঞ্জন ভাবল লোকটা সম্পর্কে যতটা খারাপ রটনা আছে, সবটা বোধহয় সত্যি না। মায়ের জন্য কালই হসপিটালে যোগাযোগ করতে হবে। তারপর মাঝেমধ্যেই ছোট ছোট অ্যামাউন্ট ঢুকত, বলা হত কোনওটা ভাইয়ের ভালো কলেজে ভরতির জন্য, কোনওটা বা মায়ের পোস্ট অপারেটিভ পথ্য বাবদ।
মাস ছয়েক পরে একদিন সন্ধেয় টিউশন সেরে বাড়ি ফেরার পথে গুঞ্জনের মোবাইলে টুং শব্দে মেসেজ ঢুকল। কৌতূহলী হয়ে খুলে দেখে গুঞ্জনের শিরদাঁড়া বেয়ে ঠান্ডা স্রোত বইতে লাগল। এক বিশাল অঙ্কের টাকা ঢুকেছে ওর অ্যাকাউন্টে! বাড়ির গেটের সামনে দাঁড়িয়ে ওর পা দুটো অবশ হয়ে যাচ্ছে। পাশের বাড়ি থেকে টিভির খবর ভেসে আসছে –
‘বনমালীপুরের পুরপ্রধানের অফিসে ইডির হানা। নথিপত্র বাজেয়াপ্ত, বহু টাকার বেআইনি লেনদেন। পুরপ্রধানের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট সিজ করা হয়েছে। একে একে সব পুরসভাতেই তদন্ত চালানো হবে।’
বহুদিন আগে কলেজের বন্ধুর সাথে দেখা ইংরেজি সিনেমার একটা দৃশ্য চোখের সামনে ভেসে উঠল গুঞ্জনের। একটা বিশালাকায় সাপ আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছে একটি মানুষকে। মুক্তির জন্য ছটফট করছে মানুষটি ! কিন্তু সাপটা তাকে পেঁচিয়েই চলেছে পরতে পরতে।
গল্পের সেরা হাত প্রতিযোগিতার ফলাফল: