দে’জ পাবলিশিং নিবেদিত, সংবাদ প্রতিদিন শোনো আয়োজিত ‘গল্পের সেরা হাত’ প্রতিযোগিতায় নির্বাচিত গল্পগুলি থেকে শুনে নিন, সুজয় চক্রবর্তীর গল্প ভালো লোক, খারাপ লোক। এই প্রতিযোগিতার তিন বিচারক ছিলেন শ্রদ্ধেয় সাহিত্যিক অমর মিত্র, যশোধরা রায়চৌধুরী ও জয়ন্ত দে। তাঁদের বিচারে যুগ্ম প্রথম স্থান পেয়েছে এই গল্পটি।
পাঠ চৈতালী বক্সী, শঙ্খ বিশ্বাস, সুযোগ বন্দ্যোপাধ্যায়
শব্দগ্রহণ অঙ্কুর নন্দী
অলংকরণ অর্ঘ্য চৌধুরী
দেবুর সঙ্গে আমার ঝামেলাটা এখন মারাত্মক পর্যায়ে চলে গেছে।
দেবু আমার কলিগ। কিন্তু ওকে আমি আর এক মুহূর্ত সহ্য করতে পারছি না। সম্ভবত দেবুও আমাকে সহ্য করতে পারছে না। না পারারই কথা। কেননা আমি ‘চাকে ঢিল মেরেছি।’ বেশ করেছি। আমার চোখের সামনে দিয়ে একটার পর একটা অন্যায় হয়ে যাবে, আর আমি মুখ বুজে সব দেখে যাব! কক্ষনো না। নালিশ ঠুকে দিয়েছি বিডিও-র কাছে।
বছরখানেক হল আমি এখানে ট্রান্সফার নিয়ে এসেছি। তার জন্য আমাকে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। চাকরির প্রথমে পোস্টিং ছিল রায়গঞ্জে। ওখানে বরং ভালোই ছিলাম। উপরি পাওনাও ছিল। শুধু অসুবিধা ছিল বাড়ির থেকে দূরত্ব। ডেলি প্যাসেঞ্জারি সম্ভব ছিল না। সপ্তাহে একবার বাড়িতে আসতাম। ছেলে তখন খুব ছোট। খুব কষ্ট হত মিতালীর। তবু একা হাতে ও-ই সব সামলে নিত। এসব জানত দত্তদা। রায়গঞ্জের অফিসে দত্তদা ছিল আমার প্রিয়জন। লোকাল লোক। খুব ভালবাসত আমাকে। একদিন দত্তদা কথায় কথায় বললেন, ‘দীপঙ্কর, বাড়ি থেকে দূরে থাকার কষ্টটা আমি বুঝি। তুমি ট্রান্সফার নিচ্ছ না কেন?’
– দাদা, যদি বাড়ির কাছে যেতে পারি তবে নিশ্চয় নেব।
– তুমি হেড অফিসে যোগাযোগ করতে পারো!
– আপনার চেনাজানা কেউ আছে?
– আগে তো ছিল না। তবে এখন আছে।
তারপর দত্তদার কথামতো ওঁরই আত্মীয় মুখার্জি সাহেবের সঙ্গে যোগাযোগ করে, অনেক অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে, অবশেষে বাড়ির কাছে ট্রান্সফার নিয়ে এলাম। তাও ছ’বছর পরে।
বাড়ি থেকে এখন আমার অফিস যেতে বাইকে মাত্র পাঁচ মিনিট লাগে। অফিসে সবার সঙ্গেই আমার সদ্ভাব আছে। তবে দেবুর সঙ্গেই যেন একটু বেশি সখ্য তৈরি হয়ে গেল।
কিছুদিন আগেও, কখনও অফিসের কাজে ওর বাইকে আমি, আমার বাইকে ও, একসঙ্গে গিয়েছি। কিন্তু সেসব দৃশ্য এখন অতীত। আমি সেসব কথা ভুলেও যেতে চাই। মানুষ চেনা সহজ নয়। সবকিছু বুঝে নিতে আমার একটু সময় লেগেছিল। এখানে এসে দেখলাম, দেবুর সায় ছাড়া একটা ফাইলও পাশ হয় না।
অফিসে দেবু আমার সিনিয়র হলেও বয়স কিংবা কাজের অভিজ্ঞতাতে আমি ওর সিনিয়র। তবে ওর প্লাস পয়েন্ট- শুরু থেকেই ওর পোস্টিং এখানে। বিডিও, এসডিও, এমএলএ, এমনকি রুলিং পার্টির ছোট-বড় নেতার সঙ্গেও ওর দহরম-মহরম সম্পর্ক। দেবুর সবচেয়ে বড়ো গুণ, কোন দেবতা কোন ফুলে তুষ্ট হয়, সেটা ও ভালো করেই জানে। আর এইজন্যই দেবুকে একডাকে সবাই চেনে। তাই দেবু লোকাল ছেলে না হলেও এখানে জাঁকিয়ে বসতে ওর কোনও অসুবিধা হয়নি। ছোটমোটো, যেকোনো কাজে পাবলিক এসে আগে ওর খোঁজ করে। অথচ আমি ও দেবু একই পোস্টে আছি!
যাই হোক, বাঁ হাতের ইনকাম দেবুর বেশ ভালোই, সেটা ওর বাড়ি দেখলেই বোঝা যায়। কেননা একবার আমাকে দেবু নিয়ে গিয়েছিল ওর বাড়িতে। মার্বেল বসানো তিনতলা বাড়িটাকে আমার ছোটখাটো একটা প্রাসাদ মনে হয়েছিল!
আমার আর দেবুর ব্যাপারটা বাড়িতেও ইতিমধ্যে জানাজানি হয়েছে। আসলে আমিই বলেছি মিতালীকে। না বলে উপায়ও ছিল না। আমি মানসিক অশান্তিতে থাকলে, কেমন করে জানি মিতালী সব জেনে যায়! বহুবার হয়েছে এমনটা। লাস্ট যেদিন দেবুর সঙ্গে বেশ বড় রকমের কথা কাটাকাটি হল, আমাকে ও ‘দেখে’ নেওয়ার হুমকি দিল, সেদিন অফিস থেকে বাড়ি ফিরে সবে সোফায় বসেছি, অমনি আমার মুখের দিকে তাকিয়ে মিতালী বললো, ‘কী হয়েছে?’
– কই?
– মুখ কালো করে বসে আছ!
– কই মুখ কালো?
— কই মানে! কী হয়েছে, বলো?
– বলছি তো কিছু না।
– কিছু না? তুমি হাঁ করলেই আমি হাওড়া বুঝে যাই। বলো?
ওর কথা শুনে হেসে ফেললাম। বললাম, ‘হ্যাঁ, তুমি তো সবজান্তা।’
— হ্যাঁ, আমি সবজান্তা। বলো।
নাছোড় মিতালীকে অবশেষে সব খুলে বললাম। ও দেবুকে চেনে। আমাদের বাড়িতে দেবু বারকয়েক এসেছে।সব শুনে মিতালী বলল, ‘তুমি সম্পর্ক তৈরি করতে যেমন ওস্তাদ, ভাঙতেও তেমন। এই কিছুদিন আগে তোমার মুখ থেকেই শুনেছি, দেবুর মতো নাকি ছেলেই হয় না! ও খুব ভালো লোক। আর আজ তুমিই বলছ, ওর মতো খারাপ লোক নাকি পৃথিবীতেই নেই!’
– ঠিকই বলেছি, মিতালী। ওর মতো হারামি আর একটাও দেখিনি। চাইলে ও মানুষ পর্যন্ত খুন করতে পারে, জানো!
– না, আমার জানার দরকার নেই। তুমিই জানো। জলে থেকে কুমিরের সঙ্গে কেউ লড়াই করে না। ও কি তোমাকে ছাড়বে ভেবেছ? তুমিই তো বলেছিলে, ওর শ্বশুরের নাকি মন্ত্রী লেভেলে জানাশোনা। এবার ঠ্যালা সামলাও। ট্রান্সফার হলে বলে।
– যা হবার, তাই হবে। অতশত ভাবি না।
– না, তুমি ভাববে কেন? ভাবব তো আমি! বুবাইকে সবেমাত্র নতুন একটা স্কুলে ভরতি করানো হল। আর এখন ট্রান্সফার হলে ওর পড়াশোনাটা তো লাটে উঠবে!
– তা কেন! যদি ট্রান্সফার হই, তোমাদের কোথাও যেতে হবে না। বুবাই এই স্কুলেই পড়বে। তোমরা এখানেই থাকবে।
– ও, আবার তুমি সেই মেস করে থাকবে! বাড়ি থেকে খেয়ে অফিস যাচ্ছিলে, ভালো লাগছিল না? ভূতে কিলোচ্ছিল?
– বাড়ির কাছে থাকব বলে কি আমাকে সবকিছু মাথা পেতে সহ্য করে নিতে হবে?
– হবে। তোমার মতো ওই অফিসে আরও অনেকে আছে। তারা যদি মানিয়ে নিতে পারে, তবে তোমার অসুবিধা কোথায়? তুমি এখানে ট্রান্সফার নিয়ে এসেছ বছরখানেকও হয়নি। আর এর মধ্যেই যদি ট্রান্সফার হও, লোকে কী বলবে?
– লোকে কী বলবে, তা নিয়ে আমার ভেবে কাজ নেই। ওটা লোকেই ভাবুক।
– বাড়ির কাছে এলে তাহলে কী জন্যে? পরিবারের সঙ্গে যদি না থাকতে চাও, তাহলে তো তোমার রায়গঞ্জে থাকাই ভালো ছিল।
আমি চুপ মেরে গেলাম। আর কথা বাড়াইনি।
।।২।।
মিতালী যা আশঙ্কা করেছিল, ঠিক তাই। আজ অফিসে টিফিন আওয়ারে বসে ছিলাম আমার টেবিলে। পাশের টেবিলের দিলীপবাবু এসে বললেন, ‘দীপঙ্কর, তোমাকে মনে হয় ফোর্স ট্রান্সফার করছে উপরমহল থেকে, শুনেছ?’
– না তো! আপনি জানলেন কী করে?
– আমি কানাঘুষো শুনছিলাম। বিডিও অফিস গিয়েছিলাম। ওখান থেকেই খবরটা পেলাম।
– মেইল এসেছে নাকি?
– এসেছে মনে হয়।
– আচ্ছা। তবে আমাকে এখনও অফিশিয়ালি কিছু বলা হয়নি।
দিলীপদা শুধু বললেন, ‘ওর সঙ্গে এতটা ঝামেলায় না জড়িয়ে গেলেই মনে হয় ভালো হত।’
‘ওর’ বলতে যে দেবুর কথা বলছেন, তা আর বুঝতে অসুবিধা হল না। আমি একটা শুষ্ক হাসি দিয়ে আলুপোস্ত দিয়ে রুটি চিবোতে লাগলাম।
বাড়িতে এসে বউকে বললাম, ‘একটু কড়া করে চা করো তো, মিতালী। পারলে একটু আদা দিও।’
মিতালী রান্নাঘরে চলে গেল।
বুবাই সোফায় বসে। সারাদিনে সে কী কী করেছে জানতে চেয়ে, কোলে তুলে নিয়ে একটু আদর করছিলাম। এর মধ্যেই মিতালী চা-এর ট্রে নিয়ে ঢুকল। গরম চায়ে চুমুক দিয়ে বললাম, ‘বাঃ! চা-টা বেশ ভালো করেছ।’
মিতালী হাসল। বুবাইয়ের জন্য একটা ক্যাডবেরির প্যাকেট এনেছিলাম। ওটা নিয়ে ও পাশের ঘরে চলে গেল। ছেলে চলে যেতেই মিতালীকে আমার ট্রান্সফারের বিষয়টা জানালাম। শুনেই প্রায় আঁতকে উঠল ও। মুখ ঝামটা দিয়ে বলল, ‘ হল তো, এবার বোঝো! সব তাতে বেশি বেশি।’ আর কিচ্ছু বলল না সে। চুপ করে গেল।
দাঁত বার করে হাসতে হাসতে বললাম, ‘আমিই চাইছিলাম বুঝলে, উপরমহলে বলে দেবু আমার ট্রান্সফারটা করে দিক। জানতাম, দেবুর সেই এলেম আছে। সেজন্যই ওকে আমি আর ইদানীং ‘সহ্য’ করতে পারছিলাম না। কেননা বাড়ির কাছে এসে সত্যিই এক্সট্রা কোনও ইনকাম হচ্ছিল না, মিতালী। যেটা রায়গঞ্জে ছিল। এবার দেখো, প্রতি বছর তোমার একটা করে গয়না হবে। দেবু সত্যিই খুব ভালো লোক।’
গল্পের সেরা হাত প্রতিযোগিতার ফলাফল: