দে’জ পাবলিশিং নিবেদিত, সংবাদ প্রতিদিন শোনো আয়োজিত ‘গল্পের সেরা হাত’ প্রতিযোগিতায় নির্বাচিত গল্পগুলি থেকে শুনে নিন, সুমন বন্দ্যোপাধ্যায়-এর গল্প অপত্য। এই প্রতিযোগিতার তিন বিচারক ছিলেন শ্রদ্ধেয় সাহিত্যিক অমর মিত্র, যশোধরা রায়চৌধুরী ও জয়ন্ত দে।
পাঠ-অভিনয় শঙ্খ বিশ্বাস
শব্দগ্রহণ অঙ্কুর নন্দী
অলংকরণ সুযোগ বন্দ্যোপাধ্যায়
এক আকাশ তারা। আকাশে এত তারা থাকে মাটি থেকে দেখাই যায় না। গ্রামে গঞ্জে হয়তো দেখা যায়, বা পাহাড়ে। যেখানে নিকষ কালো অন্ধকার গ্রাস করে সবকিছু। যেখানে বাতাসে বুক ভরে নির্মল শ্বাস নেওয়া যায়, সেখানে। কলকাতা শহরে নয়। অর্ক দেখেছে। পাহাড়ে বেড়াতে গিয়ে দেখেছে। এমনকি শিমুলতলার গ্রামেও দেখেছে। এক রাতের জন্য ছিল ওখানে – ওই বেড়াতে গিয়েই। পুরো আকাশে কে যেন জরির চাদর মেলে দিয়েছে। না, আজ কলকাতার আকাশে অবশ্য এত তারা দেখা যাচ্ছে না। তবে নিচে থেকে যা দেখা যায়, এই সতেরো তলার ছাদ থেকে তার চেয়ে বেশিই দেখা যাচ্ছে। আজ আকাশে চাঁদ নেই। অমাবস্যা নাকি আজ?
অর্ক জানে না। ছাদে তো আসাই হয় না। আজ এসেছে। আকাশের দিকে মুখ তুলে তাকাল। নিকষ কালো অন্ধকারের মধ্যে আলোর মালা। মনে হয় কালো চাদরে কে যেন পিন ফুটিয়ে ছোট ছোট ফুটো করে দিয়েছে। আর তার পেছন থেকে আলো এসে পড়েছে অর্কর মুখে। বিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবে অর্ক জানে ওই তারার অনেকগুলো আদৌ ওখানে নেই। খসে গেছে বহু বছর আগে। আজ তার আলো এসে পৌঁছাল অর্কর কাছে।
হালকা ঠান্ডা হাওয়ার ঝাপটা লাগছে চোখে-মুখে।
অর্ক পায়ে পায়ে এসে দাঁড়াল পাঁচিলের পাশে। ঝুঁকে তাকাল নিচের দিকে। আলোয় ভেসে যাচ্ছে চারিদিক।
চকচক করছে শানবাঁধানো চত্বর। একদিকে বেশ কিছু গাড়ি। ওদের গাড়িটাও দেখতে পেল অর্ক। মা বেরিয়েছিলেন শপিংয়ে। ফিরে এসেছেন। বাবার গাড়ি আলাদা। এখনো ফেরেননি। ফিরতে ফিরতে অনেক রাত। হাসপাতাল, চেম্বার, অপারেশন- কত কি! বাবার সঙ্গে শেষ কবে বসে গল্প করেছে অর্ক? মনে পড়ে না।
ডিনার টেবিলে একসঙ্গে বসে খাওয়া… নাহ্, তাও না। মার সঙ্গেও বা কদিন! যেদিন মা নিজের বুটিক, লেডিজ ক্লাব সামলে তাড়াতাড়ি ফিরতে পারেন, সেই দিন হয়তো…। না হলে যথারীতি মালতী মাসি ডিনার সাভ করে দেয়। অর্ক খেয়ে নিয়ে আবার ঢুকে যায় ওর ঘরে। দরজা বন্ধ।
ওই দরজার ওপারটা অর্কর নিজস্ব জগৎ। ওদের দারুণ সাজানো গোছানো ফ্ল্যাটের মধ্যে অর্কর ওই ঘর যেন এক মূর্তিমান উপদ্রব। ওর বাবা-মা অনেক চেষ্টা করেও ওই ঘরটাকে কিছুতেই তাঁদের সামাজিক মর্যাদার সঙ্গে মানানসই করে তুলতে পারেননি। অর্ক তুলতে দেয়নি।
খাটের ওপর রাশিকৃত বই। মাঝখানে একটা গিটার। টেবিলের ওপরেও ছড়ানো বই। পড়ার বই যত না, তার চেয়ে বেশি বই সাহিত্যের- ইংরেজি ,বাংলা দুটোই। নামী ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের ছাত্র হলেও অর্ক দিব্যি বাংলা বইও পড়তে পারে। এর সঙ্গে রয়েছে বেশ কিছু ছবি আঁকার বই। কোথাও হিউম্যান অ্যানাটমি ড্রয়িং, কোথাও পোর্ট্রেট পেন্টিং, কোথাও বা বইয়ের বিষয় ইম্প্রেশনিজম্। টেবিলের একপাশে রং তুলির সরঞ্জাম। ঘরের একপাশে দাঁড় করানো একটা ইজেল। তাতে একটা সাদা ক্যানভাস বোর্ড আটকানো। তাতে অ্যাক্রেলিক-এ আঁকা একটা মেয়ের অর্ধসমাপ্ত পোর্ট্রেট। অর্ক ভেবেছিল ছবিটা ঐন্দ্রিলাকে গিফট্ করবে। ওকেই আঁকছিল। রংগুলো আর নেই। ওগুলো কাল রাত্রে ডাস্টবিন-এ জায়গা নিয়েছে। নতুন টিউবগুলো।
আসলে গতকাল সন্ধেবেলা অর্কদের ঘরে ঝড় বয়ে গেছে। গতকাল ছিল রবিবার। বাবার কাজ একটু হালকা ছিল। নিজস্ব নার্সিংহোমে চাপ একটু কম থাকায় কাল সন্ধেবেলায় বাবা বাড়িতেই ছিলেন। আর তখনই অর্ক বোমাটা ফাটিয়েছিল। খুব স্পষ্টভাবেই অর্ক ওর বাবা-মাকে জানিয়েছিল যে, ডাক্তারির এন্ট্রান্স পরীক্ষায় ও বসছে না। ব্যাপারটা হজম করতে কয়েক মুহূর্ত সময় লেগেছিল ওদের। তারপর প্রচণ্ড রাগে বাবা চিৎকার করে উঠেছিলেন- ‘মানে? পরীক্ষায় বসবে না মানে?’
— মানে বসব না। আমার ভালো লাগে না।
— কী ভালো লাগে না? -অধৈর্য হয়ে বাবা প্রশ্ন করেছিলেন।
— ডাক্তারি -সংক্ষেপে জবাব দিয়েছিল অর্ক।
এই সংঘাত অবশ্য এই প্রথম নয়। ক্লাস টেনের পরীক্ষার পর হিউম্যানিটিস পড়ার জেদকে অপরিণত, বালকোচিত ভাবনা আখ্যা দিয়ে স্বাভাবিকভাবেই বিজ্ঞান-এ দিয়ে দেওয়া হয়। অর্কর বাবা-মা দুজনেই নিজেদের যুক্তিতে তাঁদের সামাজিক মান-মর্যাদার কথা অর্ককে স্মরণ করাতে ভোলেননি।
–ডাক্তারি পড়বে না মানে? আমার এত বড় নার্সিংহোম, প্র্যাকটিস, কে সামলাবে এসব? আমি তোমাকে হায়ার স্টাডিজের জন্য ইউকে-তে পাঠাবার সব প্ল্যান করেছি, আর তুমি বলছ ভালো লাগে না! বাঁদরামি হচ্ছে আমার সঙ্গে। বাজে ফ্রেন্ড সার্কেল-এর পাল্লায় পড়েছ নিশ্চয়ই। তবে কী পড়তে চাও শুনি, ইঞ্জিনিয়ারিং?
ক্ষিপ্ত মুখে প্রশ্নটা অর্কর দিকে ছুড়ে দিলেন বাবা।
– না। শক্ত গলায় জবাব দিল অর্ক। – আমি আর্ট কলেজে ভরতি হব।
এই দ্বিতীয় বোমাটা বাবা একদমই সহ্য করতে পারেননি।
ছাদের এই ঠান্ডা হাওয়ায় সারা শরীর জুড়িয়ে যাচ্ছে। এই পৃথিবীটাকে, এই জীবনটাকে খুব ভালোবাসতে ইচ্ছে করছে অর্কর। ঐন্দ্রিলার ছবিটা শেষ হল না। কাল তীব্র রাগে বাবা যখন ওর ঘরে ঢুকে ছবি আঁকার সরঞ্জাম, রঙের টিউব সব নষ্ট করে ডাস্টবিনে ফেলছিলেন, তখন অর্ক আশ্চর্য রকম শান্ত হয়ে সব দেখছিল। বাবার জন্য কেমন যেন একটা মায়া হচ্ছিল অর্কর। তারপর ডাক্তারি পড়ার চূড়ান্ত ঘোষণা জানিয়ে ঘর ছেড়ে চলে গেলেন বাবা।
দরজাটা বন্ধ করে চুপ করে অনেকক্ষণ বসে ছিল অর্ক। না, চোখ দিয়ে জল পড়েনি একফোঁটাও। শুধু দাঁত দিয়ে শক্ত করে চেপে ধরেছিল নিচের ঠোঁটটাকে। প্রচণ্ড ঝড়ের পর প্রকৃতির শীতলতা ক্রমশ গ্রাস করল অর্ককে। তারপর কখন যেন ঘুমিয়েও পড়ল।
আজ সন্ধেবেলায় মা ফিরেই আবার ফোন নিয়ে বসে পড়েছেন। কোনও এক বান্ধবী হবে হয়তো। মালতী মাসি বাজারে গেছে। দরজাটা ভেজানোই ছিল। অর্ক আলতো হাতে দরজা খুলে নিঃশব্দে বেরিয়ে এসে লিফট-এর বোতাম টিপে সোজা চলে এল ছাদে। পায়ে পায়ে চলে এল পাঁচিলের ধারে। আবার দেখল নিচটা। তারপর তাকাল আকাশের দিকে। বুক ভরে নিল টাটকা বাতাস। আর তারায় ভরা বিরাট কালো আকাশটা যেন পরম মমতায় জড়িয়ে ধরল অর্ককে।
গল্পের সেরা হাত প্রতিযোগিতার ফলাফল: