বাবা। তাঁর কথা লেখা অসম্ভব। বাবা, শহর থেকে দূরে থাকা পাওয়ার স্টেশনের মতোই। এ অনুভব কি শুধুই ব্যক্তিগত! বোধহয় নয়। বাবার পৃথিবী আমাদের আরও বৃহত্তর উপলব্ধির সামনে এনেই দাঁড় করায়। যেমন, এখন শুনব সেই বাবার গল্প, সন্তানের মৃত্যুশয্যায় যিনি পৌঁছতে পারেননি। তাঁর আকুল কান্না যেন অসংখ্য প্রশ্নে বোবা করে দিয়েছিল এই পৃথিবীকে। আসুন শুনে নিই, ফাদার্স ডে উপলক্ষে সংবাদ প্রতিদিন শোনো-র বিশেষ নিবেদন ‘বাবার গল্প’।
লেখা: সরোজ দরবার
পাঠ: চৈতালী বক্সী
অক্ষরশিল্পী: সম্বিত বসু
কাবুলিওয়ালা রহমত সম্ভবত তাঁর মেয়ের কাছে পৌঁছতে পেরেছিলেন। রামপুকার পণ্ডিত পারেননি। রহমত ভিন দেশ থেকে নিজের দেশে ফিরেছিলেন সন্তানের আকুল টানে। রামপুকার পণ্ডিত নিজের দেশেরই এক রাজ্য থেকে আর এক রাজ্যে পৌঁছতে পারেননি। তাঁর সন্তান মৃত্যুশয্যায় জেনেও পারেননি। শরীরের সর্বশক্তি খরচ করে হেঁটেও পৌঁছতে পারেননি। কেননা হাঁটা ছিল মানা। কেননা হাঁটলে বিঘ্নিত হবে লকডাউন। তাতে টলে যাবে সভ্যতা। অতএব সভ্য দেশে রামপুকার পণ্ডিত ফোন কানে শুনলেন, তাঁর সন্তান মরতে বসেছে। শেষ দেখাটুকুও আর হবে না।
কতদূরে বাড়ি এই হতভাগ্য বাবার? কাঁদতে কাঁদতে রামপুকার আঙুল তুলে শুধু বলেছিলেন, উধার…। উধার? চমকে উঠেছিলেন বিশিষ্ট এক সংবাদ সংস্থার চিত্রগ্রাহক। লকডাউনের নানা মুহূর্ত তুলে রাখছিলেন। দিল্লির নিজামুদ্দিন ব্রিজে বসে থাকা বছর চল্লিশের মানুষটার দিকে তাকিয়ে যেন আর পা সরেনি। ক্যামেরায় চোখ রেখে দেখেছিলেন মানুষটি অঝোরে কাঁদছেন। লকডাউন। ভারতবর্ষ। পরিযায়ী শ্রমিক। সেই যন্ত্রণাদীর্ণ দিনে চোখে তো জল আসতেই পারে। তবু, কোথাও যেন একটা অন্য কিছু ছিল। মানুষটার মুখের রেখায় যন্ত্রণার যে মানচিত্র ফুটে উঠেছিল, তা উপেক্ষা করতে পারেননি চিত্রশিল্পী অতুল যাদব। ছবি তুলে তাই চলে যেতে পারেননি। এগিয়ে এসে জানতে চেয়েছিলেন, আপনার বাড়ি কোথায়? চাপা কান্নায় ফোঁপাতে ফোঁপাতে রামপুকার শুধু বলেছিলেন, ওই যে ওখানে। তাঁর দিকনির্দেশ করা আঙুলের সামনে তখন ধু-ধু ফাঁকা রাস্তা। অনেক পরে অতুল বুঝতে পারেন, সেই রাস্তা ধরে এগোলে একদিন পৌঁছনো যাবে যে গন্তব্যে, তা আসলে বিহারের বেগুসরাই। প্রায় ১২০০ কিমি দূরে। সেখানেই মৃত্যুকে শিয়রে নিয়ে শেষ ক’টা দিন গুনছে তাঁর সন্তান। ফোনে সে খবর পাচ্ছেন রামপুকার। কিন্তু হেঁটেও পৌঁছনোর উপায় নেই। লকডাউন সার্থক করে তুলতে পুলিশ হাঁটা বন্ধ করে দিয়েছিল পরিযায়ী শ্রমিকদের।
এই সেই সময় যখন ওয়ার্ক-ফ্রম হোম ঢুকে পড়ছে গরিষ্ঠসংখ্যক নাগরিকের জীবনে। গৃহবন্দিকালীন অবসর যাপনে ফন্দি-ফিকির খোঁজায় মগ্ন মধ্যবিত্ত। এই সেই সময় যখন ওটিটি আর ডিজিটাল পৃথিবী নতুন করে জেগে উঠছিল। এই সেই সময় যখন করোনা ছড়ানোয় কে কতখানি দোষী, তা নিয়ে আঙুল তোলার খেলা খেলছিল নিরাপদ ছাদের ভিতর থাকা সভ্য মানুষেরা। রামপুকাররা তখন হাঁটছিলেন। পুলিশের ভয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে থাকছিলেন। আর একান্ত না পেরে জীবনের প্রতি গভীর আক্ষেপে সম্ভবত কেঁদে ফেলছিলেন। অতুল যাদব রামপুকারের যন্ত্রণার গল্প শুনে তাঁর ফেরার ব্যবস্থা করার চেষ্টা করেন। পুলিশের কাছে অনুমতি আদায় ঝকমারি! তবু মিডিয়ার মানুষের অনুরোধ শুনে পুলিশ বলেছিল, দেখা যাক কী ব্যবস্থা করা যায়! কী ব্যবস্থা হয়েছিল? কিছুই না। বাড়ি থেকে রামপুকারের স্ত্রী বিমলা ফোন করে জানাচ্ছিলেন, বছরখানেকের ছেলেটার আয়ু আর বেশি নেই। কিন্তু রামপুকার অসহায়। তাঁর হাঁটারও উপায় নেই। সঙ্গে ছিল সাড়ে পাঁচ হাজার টাকা। তাও ছিনিয়ে নিয়ে চলে গেছে একজন। কান্না ছাড়া আর কীই-বা থাকে রামপুকারের! এক মহিলা সমাজকর্মী তাঁকে ফেরানোর চেষ্টা করছিলেন। ব্রিজের মস্ত থামের আড়ালে তখন লুকিয়ে পুলিশের চোখ এড়াচ্ছিলেন রামপুকার। অনেক কষ্টে একটা ট্রেনের টিকিট মেলে। মহিলা রামপুকারকে ওই সাড়ে পাঁচ হাজার টাকা দেন। বাড়ি ফেরার ট্রেন ধরেন রামপুকার। ফিরে আবার কোয়ারেন্টাইনে থাকতে হয় তাঁকে। শেষ পর্যন্ত যতদিনে ঘরের চৌকাঠে পা রেখেছিলেন রামপুকার, ততদিনে তাঁর বছরখানেকের সন্তান পৃথিবী ছেড়ে পাড়ি দিয়েছে অন্য লোকে। সন্তানের মুখ আর দেখা হয়নি রামপুকারের। শুধু যে স্নেহময়ী সমাজকর্মী তাঁকে বাড়ি ফেরার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন, তাঁর স্মৃতিটুকু বাঁচিয়ে রেখেছিলেন রামপুকার। ট্রেনের টিকিট আর তাঁর দেওয়া টাকা থেকে একটা একশো টাকার নোট বাঁধিয়ে রেখে দিয়েছিলেন।
রামপুকারের এই একটা ছবি সেদিন ভারতবর্ষের বিবেকে ঘা দিয়েছিল। মধ্যবিত্ত নিরাপত্তার ঘেরাটোপে বসেও কেঁপে উঠেছিল দেশবাসী। প্রায় সাড়ে তেইশ লাখ পরিযায়ী শ্রমিকের সামগ্রিক যন্ত্রণার স্মারকচিত্র হয়ে উঠেছিল রামপুকারের ওই ছবি। জমে উঠেছিল রাজনৈতিক দোষারোপের পালা-ও। তবে মজার বিষয়, ভোটের সময় ধর্ম যেভাবে এগিয়ে এল, লকডাউনের সেই যন্ত্রণা সেভাবে এল না। এই তো সভ্যতার আয়রনি! এই আয়রনির ভিতর দিয়েই ক্রমাগত নিষ্ঠুরতার জন্ম হয়। এই তো সেই দেশ, যেখানে মেয়ের মৃত্যুর খবরটুকু না পেয়ে তাঁর জন্য নতুন শাড়ি কিনে বাড়ি ফেরেন বাবা। আর তারপর যে হা-হা কান্নায় ভেঙে পড়েন তা আদতে বোবা করে দেয় পৃথিবীকে। সিনেমায় সেই দৃশ্য ধরতে গিয়ে পরিচালক সে কান্নার আওয়াজটুকু অব্দি শোনাতে পারেন না। শোনাবেনই বা কী করে! দেশের আত্মার ভিতরেই যে গুমরে উঠছে সেই কান্না। অথচ দেশকে শুষে নেওয়ার জন্য মাকড়সার জালের মতো বিছানো হয়ে গিয়েছে রেলপথ। যোগাযোগ ব্যবস্থায় বিপ্লব এলেও উপনিবেশ ভারতে দুর্গার মৃত্যুর খবর পৌঁছয় না হরিহরের কাছে। আর স্বাধীন দেশে সেই নিষ্ঠুরতার নতুন মাত্রা রামপুকারের ব্যক্তিগত ট্র্যাজেডিতে। যেখানে বাবা সন্তানের মৃত্যুপথযাত্রার সংবাদ শোনেন, অথচ পৌঁছতে পারেন না কিছুতেই।
রামপুকার পণ্ডিতের গল্পটা তাই ব্যক্তিগত শুধু নয়, রাজনৈতিক। এই একটা ছবি যতবার চোখে পড়বে, আমরা চিনতে শিখব নিজেদের। আমরা কী করেছিলাম, আমাদের কী করা উচিত ছিল- এ প্রশ্নই বিদ্ধ করবে আমাদের। সেদিন না পারলেও, পরবর্তীতে আমরা আমাদের দায়িত্ব পালন করেছিলাম তো? রামপুকার পণ্ডিতকে সত্যিই আমরা সহনাগরিক মনে করি তো? একটা ছবি, চিরকাল থেকে যাবে এই সব জাগর প্রশ্ন নিয়ে। নাহ্, রামপুকার চিৎকার করেননি, অভিযোগ করেননি, সোশ্যাল মিডিয়ায় এসে প্রতিবাদের নদীকে রাইটার্স বিল্ডিং-এ আছড়ে ফেলেননি। শুধু কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন। যে-কান্না আদতে আমাদের সভ্যতার মুখেই থাপ্পড়। নিরাপদ, ব্যক্তিসুবিধাভোগী, অরাজনৈতিক ভানে রাজনৈতিক হয়ে থাকার মুখে থাপ্পড়। যেভাবে ছোট্ট একটি নমস্কারকে মস্ত থাপ্পড় করে তুলেছিলেন রমাপদ চৌধুরী, মৃণাল সেন; সেভাবেই রামপুকারের যন্ত্রণার কান্নাও হয়ে উঠেছে থাপ্পড়। আমরা তাকে খারিজ করতে পারে না কিছুতেই।