বাবা। তাঁর কথা লেখা অসম্ভব। বাবা, শহর থেকে দূরে থাকা পাওয়ার স্টেশনের মতোই। এ অনুভব কি শুধুই ব্যক্তিগত! বোধহয় নয়। বাবার পৃথিবী আমাদের আরও বৃহত্তর উপলব্ধির সামনে এনেই দাঁড় করায়। যেমন, এখন শুনব সেই বাবার গল্প, নিজের সন্তানকে হারিয়েও যিনি মানবতাকে হারাননি। রুখে দিয়েছিলেন ধর্ম-হিংসার অশান্ত পরিবেশ। আসুন শুনে নিই, ফাদার্স ডে উপলক্ষে সংবাদ প্রতিদিন শোনো-র বিশেষ নিবেদন ‘বাবার গল্প’।
লেখা: রণিতা চট্টোপাধ্যায়
পাঠ: শঙ্খ বিশ্বাস
অক্ষরশিল্পী: সম্বিত বসু
লোকসভা ভোটের হাওয়ায় ভাসছিল ধর্মীয় মেরুকরণের তাস। সেই প্রবল ঝোড়ো হাওয়ার মধ্যে দাঁড়িয়েও খড়কুটোর মতোই বিশ্বাস আঁকড়ে রেখেছিলেন একজন মানুষ। তিনি বিশ্বাস করতে চাইছিলেন, ‘মহব্বত’ জিতে যাচ্ছে। হেরে যাচ্ছে ‘নফরত’ বা বিদ্বেষ। না, তিনি রাহুল গান্ধী নন। তিনি ভারত জুড়ে যাত্রা করেননি। তবে যেটুকু এলাকাকে তিনি চেনেন, তা যেন জুড়ে থাকে, এই প্রার্থনা তিনি করে গিয়েছেন প্রতিদিন।
এমনকি, যেদিন ছেলের ক্ষতবিক্ষত শবদেহ তাঁর বাড়িতে এসে পৌঁছেছিল, সেই দিনও।
আসানসোল সেদিন জ্বলছিল। সেটা ২০১৮ সালের মার্চ মাস। আসানসোলের রানিগঞ্জ এলাকায় রামনবমীর মিছিল বেরিয়েছিল। ধর্মের নামে জোরালো হয়েছিল আস্ফালন। সেদিনও আসন্ন ছিল আরেক লোকসভা ভোট, আর সে কথা মাথায় রেখেই বিভাজনের হাওয়া উসকে দিচ্ছিল রাজনীতি। সেই হাওয়া তার বিরাট হাঁ-মুখে গিলে নিয়েছিল সেই মানুষটির কিশোর পুত্রকে। সেবছরই মাধ্যমিক দিয়েছিল সে। তবে ফলাফল জানা হয়নি। তার আগেই, ২৭ মার্চ নিখোঁজ হয়ে গিয়েছিল দশম শ্রেণির পড়ুয়া, সিবগাতুল্লাহ রশিদি। পরদিন, গভীর রাতে বাড়ি ফিরেছিল তার লাশ। যে মানুষেরা অন্য মানুষকে মারতে ভালোবাসে, তাদের হাতে ছিন্নভিন্ন হয়ে বাড়ি ফিরেছিল। সে দেহের সামনে নিশ্চুপে দাঁড়িয়েছিলেন সন্তানহারা বাবা। তাঁকে ঘিরে ক্ষোভ দানা বাঁধছিল। শক্ত হচ্ছিল আশেপাশের মানুষের মুঠি, বার হয়ে আসছিল হাতিয়ার। ভোটের রাজনীতি হয়তো তখনও লাভালাভের হিসেব কষছিল। কিন্তু সেই মানুষটি সেদিনও এই বিশ্বাস জড়ো করে নিচ্ছিলেন যে, নফরতের পথে লাভ মেলে না। ঘৃণার সামনে ভালোবাসা বিছিয়ে দিলেই, একদিন ঘৃণার মাথা নিচু হয়ে আসে ঠিক। তাই, সেদিনও তিনি বার্তা দিয়েছিলেন, প্রতিহিংসা নয়। প্রত্যাঘাত নয়।
সেদিন, ছেলের মরদেহের সামনে জানাজার নমাজ থেকেও এ কথা বলতে পেরেছিলেন সন্তানহারা পিতা।
ইমাম হিসাবে ওই এলাকার মানুষের আপনার জন তিনি। তাঁর ব্যক্তিগত শোক ছড়িয়ে পড়েছিল দ্রুত, একবিন্দু ইন্ধনে তা জ্বলে উঠতে পারত। যে হিংসার আগুন জ্বলছিলই, পালটা আক্রমণে সে আগুনে আহুতি পড়ত সেদিন। সে আগুন নেভানোর দায় কিন্তু তাঁর ছিল না। অকালে সন্তানকে হারানো পিতার সেদিন অন্য কিছু ভাবার কথাও ছিল না। তবুও, ইমাম ইমদাদুল্লাহ রশিদি সেদিন বাজি ধরেছিলেন ভালোবাসার উপরেই। তাঁকে ভালোবেসে, তাঁর এই ব্যক্তিগত বিপর্যয়ের মোকাবিলা করতে যারা রুখে দাঁড়িয়েছিল; তাদের সেই ভালোবাসাকে অন্য খাতে বইয়ে দিয়েছিলেন ইমাম রশিদি। ভালোবাসার দাবিতেই হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন, কোনও প্রতিহিংসার ঘটনা ঘটলে এলাকা ছেড়ে চলে যাবেন তিনিই।
না, প্রতিহিংসার একটি ঘটনাও ঘটেনি সেদিন। মর্মান্তিক পুত্রশোক বুকে চেপেও যে কেমন করে নাগরিক দায়িত্ব পালন করা যায়, রাজ্যের এবং দেশের এই দুরভিসন্ধিময় রাজনৈতিক আবহে তা সেদিনই দেখিয়ে দিয়েছিলেন ইমাম রশিদি। বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, শান্তিরক্ষা করতে আসলে রাজনীতি লাগে না, প্রশাসন লাগে না, লাগে কেবল সংবেদন। লাগে ভালোবাসার জোর। কিন্তু পুত্রের নিথর মৃতদেহের সামনে দাঁড়িয়েও যে তাঁকে, তাঁকেই এ দায় পালন করতে হল, সে লজ্জায় আমাদের মাথা নিচু হয়ে আসে। সিবগাতুল্লাহের হত্যা দুর্ভাগ্যের, কিন্তু সন্তানের মৃত্যুতে ইমাম রশিদির শোকের অবকাশটুকুও না পাওয়া হয়তো তার চেয়েও বেশি দুর্ভাগ্যের। দুর্ভাগ্যের, যে, এ দেশ এখনও তাঁকে ‘আমরা’-র দলে টানতে পারেনি। তিনি সেই ‘ওরা’-র দলে পড়েন, যাবতীয় শান্তিভঙ্গের ঘটনায়, হিংসা আর অশান্তির তরজায় যাদের দিকে আঙুল তুলে দেওয়া যায়। তিনি সেই ‘বহিরাগত’-র দলে পড়েন, এ রাজ্যের মাটিতে ছেলের কবর খোঁড়া হলেও, খুন হওয়া ছেলের আধার কার্ড দেখিয়ে যাঁকে বলে যেতে হয়, এ মাটি তাঁদেরও। সেই অভিযোগকে মুছে দেওয়ার দায়িত্ব এত বেশি হয়ে ওঠে যে সন্তানহারা পিতার কান্নার অবকাশও মুছে যায় কখন।
তবে এ কথাও সত্যি, ইমাম রশিদি কেবল বাধ্যতামূলক মহত্ত্বের সামাজিক দায় পালন করেননি। এ তাঁর অন্তরের আলো হয়ে থাকা বিশ্বাস। বাইরের ঝড়ে সেই ভরসার আলো এতটুকু কেঁপে ওঠে না। তাই, সন্তানের সম্ভাব্য খুনি হিসেবে গ্রেপ্তার হওয়া দুই নাবালককেও বাঁচিয়ে দেন তিনি। বলেন, তিনি নিজে তো কাউকে দেখেননি, তাহলে আর মামলায় সাক্ষী দেবেন কীভাবে! এনআরসির পরে রাজ্যে হিংসা ছড়ালেও তিনি শান্তির কথাই বলতে চান। আবার লোকসভার আগে রাজনীতি যখন ধর্মীয় তাস খেলে, তখনও ইদের নমাজ থেকে এক সন্তানহারা পিতা বলে চলেন, নিখাদ ভালোবাসা দিয়ে সব কিছুকে জয় করা যায়। মনে করিয়ে দেন, ইসলাম মানে শান্তি। নিজের মনে সেই শান্তি যখন ঠাঁই নেয়, তখন তাকে উদ্বাস্তু করার ক্ষমতা নেই কোনও অশুভ শক্তিরই। রামায়ণের গল্পও তিনি জানেন, বলেন ইমাম রশিদি। তিনি জানেন, কোনও দেশে শান্তি আর সুশাসন থাকলে তাকে রামরাজ্য বলে। কিন্তু যারা তাঁর ছেলেকে মেরেছিল, তারা তো রামকেও চেনে না, আর জানে না ইসলামের কথাও। তাই তাদের আচরণে প্রতিশোধ নয়, ক্ষমাই তুলে রাখেন ইমাম রশিদি।
ইমাম রশিদি জানেন, এক সন্তানকে তিনি রক্ষা করতে পারেননি। তবুও, আর কারও সন্তান যেন না হারায়, আর কাউকে যেন তার সন্তানের মৃতদেহের সামনে দাঁড়িয়ে শান্তিরক্ষার কথা না ভাবতে হয়, ব্যক্তিগত হারানোর ভূমিতে দাঁড়িয়েই সে দায় কাঁধে তুলে নিয়েছেন তিনি। একে অপরের সন্তানকে আঘাত করার এই যুদ্ধক্ষেত্রে তিনিই যেন এক আকাশছোঁয়া ভালোবাসার মশাল।