বাবা। তাঁর কথা লেখা অসম্ভব। বাবা, শহর থেকে দূরে থাকা পাওয়ার স্টেশনের মতোই। এ অনুভব কি শুধুই ব্যক্তিগত! বোধহয় নয়। বাবার পৃথিবী আমাদের আরও বৃহত্তর উপলব্ধির সামনে এনেই দাঁড় করায়। বাবার সঙ্গে সন্তানের সম্পর্ক যেমন একান্ত, গভীর, তেমনই বহুমাত্রিক। ঠিক সেই কথাই ধরা পড়েছে বিশ্বদীপ দে-র গল্পে। আসুন শুনে নিই, ফাদার্স ডে উপলক্ষে সংবাদ প্রতিদিন শোনো-র বিশেষ নিবেদন ‘বাবার গল্প’।
গল্প: বিশ্বদীপ দে
পাঠ: শঙ্খ বিশ্বাস, চৈতালী বক্সী
অলংকরণ: সুযোগ বন্দ্যোপাধ্যায়
অক্ষরশিল্পী: সম্বিত বসু
শব্দগ্রহণ, সম্পাদনা: অঙ্কুর নন্দী
আবহ: শঙ্খ বিশ্বাস
সকাল সাতটা নাগাদ বাবার ডাকে ঘুম ভেঙে গেল। বাবা ছোটকাকার নাম ধরে ডাকছে। পাশের বিছানায় তৃণা আর পাপাই ঘুমিয়ে কাদা। জানলা দিয়ে সকালের রোদ ঢুকে পোষা বিড়ালের মতো পাপোশের পাশে গুটিসুটি মেরে শুয়ে। এখনও অন্তত একঘণ্টার ঘুম বাকি আমার। তাও উঠতে হল। বাবা ডেকেই চলেছে। আমার অকালপ্রয়াত ছোটকাকার ডাকনাম ধরে।
‘হাবু, বের করে রাখ ওটা। বেরোতে হবে তো।’
‘কী হল? কী খুঁজছ?’
আমাকে দেখে খানিক ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল বাবা। দৃষ্টি যেন ঘোলা। দ্বিধায় কাঁপতে থাকা স্বরে প্রায় ফিসফিস করে বলল, ‘আমার অ্যাডমিটটা…’
‘কীসের অ্যাডমিট?’
‘কেন? বিকম ফাইনাল ইয়ার! আজ থেকে পরীক্ষা শুরু না?’
গলার স্বর যতটা সম্ভব শান্ত করে বাবার চোখে চোখ রাখলাম, ‘কী বলছ এসব বাবা?’
কিছুক্ষণের স্তব্ধতা। চুপচাপ বাবা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। আমি বাবার দিকে। দ্রুত শরীরটা ভেঙে যাচ্ছে মানুষটার। গলার স্বরে জোর নেই। দু’পা হেঁটে যাওয়াই যেন বিরাট শাস্তি। কিন্তু সবচেয়ে বেশি কাহিল মগজ। সেখানে একে একে সমস্ত কোষে ধুলো জমছে। মুছে যাচ্ছে সব। হারিয়ে যেতে যেতে আচমকা ফিরে আসছে পুরনো স্মৃতি। প্রায় এক মিনিট চুপ করে থাকার পর বাবার মুখে আলতো হাসি খেলে গেল। নাটকের ভুলে যাওয়া পার্ট যেন মনে পড়ে গেছে আবার।
‘তুই অফিস যাবি না?’
‘যাব। তুমি কি একবার বাথরুম যাবে?’
‘নাহ।’ খাটে আধশোয়া হয়ে বসে জানলার বাইরে তাকাল বাবা। বুঝতে পারলাম এখন আর কথা বলবে না। কথা বলাটা দিন দিন কমিয়ে ফেলছে। বাইরে মিহি একটা রোদ্দুর। শরতের এই রোদ কবেকার বলে ভাবছে বাবা? মনে মনে হিসেব কষলাম। বাবার ফাইনাল ইয়ার মানে গত শতকের পঁয়ষট্টি-ছেষট্টি। তখনও মানুষ চাঁদে যায়নি। বাংলাদেশের জন্ম হয়নি। দেশভাগ তখন ফেলে আসা সুদূর অতীত নয়। আমি দেখতে পেলাম এক ছোকরাকে। অ্যালবামের সাদা-কালো ছবিতে যাকে দেখেছি। দ্রুত পা চালিয়ে ছেলেটা এগিয়ে যাচ্ছে কলেজের দিকে। আজ থেকে যার বিকম পরীক্ষা শুরু।
২
‘শুনুন, এই সময় এরকমই হবে। এটা আরও বাড়বে। কমবার চান্স নেই। আপনি হয়তো ভাবতে পারেন ওষুধ কেন দিচ্ছি তবে। আসলে এই যে সিনডোপা, ইকোস্প্রিন, এতে এই প্রসেসটা স্লো হবে। প্রেশারের জন্য স্ট্যামলো। এ ছাড়া আর আপাতত কিছুই করার নেই অতনু।’
এই পর্যন্ত বলে থামলেন ডাক্তারবাবু। কলকাতা শহরে এই মুহূর্তে নিউরোসাইকিয়াট্রিস্ট হিসেবে শীর্ষস্থানীয় চিকিৎসক পার্থ সেন। আমাদের হাউসের হেলথ ম্যাগাজিনটার সূত্রে ওঁকে আগে ইন্টারভিউ করেছিলাম। সেই সূত্রেই পরিচয়। না হলে ওঁর মতো ডাক্তারের অ্যাপয়েন্টমেন্ট চট করে পাওয়া মুশকিল হত।
খানিক থেমে পার্থ সেন বললেন, ‘ওষুধের কাজটা বললাম। কিন্তু আপনাদেরও কাজ রয়েছে। পার্কিনসন’স ডিজিজের পেশেন্টের সঙ্গে নিয়মিত কথা বলাটা জরুরি। পুরনো স্মৃতি উসকে দেওয়া, একসঙ্গে বসে টিভি দেখা এগুলো করে যেতে হবে। তাতে ওঁরা ভালো থাকেন।’
‘তার মানে স্বাভাবিক হাঁটাচলা, নর্ম্যাল জীবনে আর ফিরতে পারবে না, না?’
কী উত্তর পাব জেনেও প্রশ্নটা করে বসলাম। অথচ আগের অ্যাপয়েন্টমেন্টগুলোতেও উনি এর উত্তর দিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু আজ ডাক্তারসুলভ গাম্ভীর্য ছেড়ে কেমন উদাসীন একটা কণ্ঠ বেজে উঠল পার্থ সেনের, ‘হাঁটা? মানুষ কতদিন হেঁটে যেতে পারে? আপনি-আমি, আমাদেরও হাঁটা একদিন শেষ হয়ে যাবে। এটা একটা প্যাটার্ন। এভাবেই ভাবতে হবে। জানি, নিজের বাবার ক্ষেত্রে এভাবে ভাবা কঠিন। কিন্তু… প্রিপেয়ার্ড হোন। ফর দ্য ওর্স্ট।’
ডাক্তারের কবজিতে বাঁধা স্মার্টওয়াচটার দিকে তাকালাম। এখন এই সব যন্ত্র রয়েছে কে ক’পা হাঁটল তার হিসেব রাখতে। বাবাদের সময়ে এসব ছিল না। কিন্তু তবু এক অদৃশ্য ঘড়ি সব হিসেব রেখে গিয়েছে ঠিকই। ডাক্তার বলেছেন প্রস্তুত হতে। বিপর্যয়ের জন্য। আজকাল তো এসব জানা কোনও ব্যাপারই নয়। একবার গুগল সার্চ করলেই দেখা যায়। পার্কিনসন’স শুরুই হয় হাঁটাচলার সমস্যা দিয়ে। তারপর ধীরে ধীরে নার্ভের সঙ্গে সঙ্গে মস্তিষ্কও কুরে কুরে খেতে থাকে এই অসুখ। গোটা শরীরের সদর দপ্তরে ওই হামলার পর চেনা মানুষই অচেনা হয়ে যায়। গলার স্বর বদলায়। কারও কারও হাতের লেখাও। পরে অবশ্য আর লেখা সম্ভবই হয় না। হাত কেঁপে চলে। ক্রমশ ধ্বংসস্তূপ হয়ে উঠতে থাকে শরীর।
আমার খুব ইচ্ছে করে বাবার মাথার ভিতরে ঢুকে পড়তে। সেখানে নাগাড়ে ক্ষয়ে যাচ্ছে, ধসে পড়ছে স্মৃতির চাঙড়। গঙ্গার পাড় ভাঙার ভিডিও দেখেছি। ওভাবেই কি ভেঙে পড়ে মানুষের জমিয়ে রাখা স্মৃতিও? তলিয়ে যায় শূন্য তরল অন্ধকারের ভিতরে? ভাঙতে ভাঙতে কখনও ভুস করে ভেসে ওঠে কবেকার সব স্মৃতি! বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি। দেখে বোঝার উপায়ও নেই শরীরের ভিতরে কী চলছে। দিন দিন নিস্পৃহ হয়ে যাচ্ছে বাবা। ডাক্তার বলেছে, পুরনো স্মৃতি উসকে দিতে। দিই। কিন্তু বাবার তেমন উৎসাহ খুঁজে পাই না। হয়তো মনেই পড়ে না। কিংবা হয়তো যা মনে পড়ে সেই স্মৃতি এতই ছেঁড়াখোঁড়া, সেলাই করেও চালানো যাবে না।
তবু আমি আজকাল বাবাকে নিয়ে বেড়াতে বেরোই। এ এক অন্যরকম ভ্রমণ। কখনও চলে যাই শ্রীমোহন লেনে। সেখানে এক বিয়েবাড়িতে উত্তমকুমার আসবেন। খাওয়াদাওয়া শেষেও তাই অতিথিরা বাড়ি যাওয়ার নাম করছে না। সবাই ঘুরঘুর করছে। সেই দলে রয়েছে বাবাও। বাবার বয়স এখন বাইশ-তেইশ। ওই যে এসে পড়েছে গাড়ি, দূরে… মানুষ ছুটছে… বাবাও। গাড়ি থেকে নেমে আসছেন মহানায়ক। ফিনফিনে সাদা পাঞ্জাবিতে গুরু… আমার মুখ থেকে শুনে বাবা মিটিমিটি হাসে।
একসময় আমরা রানাঘাট লোকালে চেপে বসি। পাত্রী দেখতে যাই। বিকেলের আঁশফল-রঙা আলোয় আমার তরুণী মা এসে বসে বাবার সামনে। দূর থেকে ট্রেনের ভোঁ ভেসে আসে। মিষ্টির প্লেটটা পর্যন্ত চোখের সামনে ভেসে ওঠে আমাদের। দূর থেকে দাদুর কৌতূহলী মুখ। যে মুখটা পরিষ্কার বলে দেয়, ভদ্রলোক বাবার হাবভাব দেখে বুঝে নিতে চাইছেন কলকাতার পাত্রের এই মফস্সলে বড় হওয়া মেয়েটিকে পছন্দ হয়েছে কি না। ছোটবেলা থেকে বাবা কিংবা মা’র মুখ থেকে শোনা কথাগুলোই আমি নতুন করে ভাসিয়ে দিতে থাকি। সেই সব পুরনো স্মৃতির খয়েরি পাতারা ঘরময় ভেসে বেড়াতে থাকে। বাবা কী যেন ভাবে। উদাসীন হয়ে একবার দেওয়ালে ঝোলানো মায়ের ছবির দিকে দেখে। তারপর আবার জানলার বাইরে তাকায়। মুখ থেকে কথা সরে না। কেবল সামান্য হাসি লেগে থাকে।
সেদিকে দেখতে দেখতে দশ বছর আগে আকস্মিক ব্রেন স্ট্রোকে মা চলে যাওয়ার সময় বাবার বেদনার্ত মুখ মনে পড়ে। বত্রিশ বছর সংসার করা সেই সাথিকে কি আর তেমন করে আদৌ মনে পড়ে বাবার? প্রতি মুহূর্তেই যে শূন্য হয়ে যাচ্ছে স্মৃতির কলসি। মাঝে মাঝে আমার মুখের দিকেই এমন করে তাকায়, বুক ছ্যাঁৎ করে ওঠে। বাবা কি আমাকেও ভুলে যাবে?
শুনে নিন গল্পের বাকি অংশ।