দলবাঁধা কাণ্ড থেকে বিদ্যাসাগর যে কত দূরে ছিলেন, তা তাঁর আজীবনের কর্মকাণ্ডেই স্পষ্ট। বরং বলা যায়, তিনি সর্বক্ষেত্রেই একক। সে সমাজ সংস্কার হোক বা শিক্ষার বিস্তার- তাঁর ভাবনার দোসর সেভাবে পেয়েছেন তা বলা যায় না। অথচ পিছিয়ে আসার পাত্র তিনি নন। অতএব দলের থেকে দূরে চলেছে তাঁর এককের নিরন্তর অভিযান। সে-কাজের ভিতর যে গতি ছিল, তা সমস্ত প্রতিকূলতাকেই অতিক্রম করে এগিয়ে গিয়েছে। এগিয়ে দিয়েছে দেশ ও দেশের মানুষকে।
‘ধর্ম-কর্ম ওসব দলবাঁধা কাণ্ড’ – বলতেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। একবার পণ্ডিতদের তর্কসভায় ধর্ম প্রসঙ্গে কথাবার্তা উঠলে এই সিদ্ধান্তেই পৌঁছেছিলেন তিনি। ‘মনুসংহিতা’ থেকে শ্লোক উদ্ধৃত করেই নিজের মন্তব্যের ব্যাখ্যাও দিয়েছিলেন। শ্লোকটির বক্তব্য ছিল, পিতা-পিতামহ যে পথে চলেছেন, সৎপথ অবলম্বন করে সেই পথে চললে আর দোষের কিছু নেই। রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য এই সূত্রেই আমাদের পৌঁছে দিয়েছেন বিদ্যাসাগরের মৌলিক ভাবনার কাছে; এই শ্লোক ধরেই ছিল বিদ্যাসাগরের প্রশ্ন- “কেন বাপু, সৎপথেই যদি চলবে, তবে আবার পিতা-পিতামহ কেন? আর যদি পিতা-পিতামহের পথেই চলতে হয়, তবে আবার সৎপথ কেন? দুই পথ না বললে, দলরক্ষা হয় না, এই না? পাছে অপরের অপরজাতির সৎপথে লোক যায়, দল ভেঙে যায়, এইজন্যই না মনুঠাকুরকে এত মাথা ঘামাতে হয়েছে। তাই বলি ধর্ম-কর্ম ওসব দলবাঁধা কাণ্ড।”
এই দলবাঁধা কাণ্ড থেকে বিদ্যাসাগর যে কত দূরে ছিলেন, তা তাঁর আজীবনের কর্মকাণ্ডেই স্পষ্ট। বরং বলা যায়, তিনি সর্বক্ষেত্রেই একক। সে সমাজ সংস্কার হোক বা শিক্ষার বিস্তার- তাঁর ভাবনার দোসর সেভাবে পেয়েছেন তা বলা যায় না। অথচ পিছিয়ে আসার পাত্র তিনি নন। অতএব দলের থেকে দূরে চলেছে তাঁর এককের নিরন্তর অভিযান। সে-কাজের ভিতর যে গতি ছিল, তা সমস্ত প্রতিকূলতাকেই অতিক্রম করে এগিয়ে গিয়েছে। এগিয়ে দিয়েছে দেশ ও দেশের মানুষকে। ‘বিদ্যাসাগরচরিত’ লিখতে গিয়ে তাই প্রথম অনুচ্ছেদেই তাই রবীন্দ্রনাথকে টানতে হয়েছিল এই প্রসঙ্গ। বিদ্যাসাগরের অভিমুখ ‘হিন্দুত্বের দিকে নহে, সাম্প্রদায়িকতার দিকে নহে’, বরং তা ‘অপার মনুষ্যত্বের অভিমুখে’। সেই খাতেই বয়ে গিয়েছিল তাঁর ‘দৃঢ়নিষ্ঠ একাগ্র একক’ জীবন। রবীন্দ্রনাথ তাই বলছেন, তিনি যে বাঙালি বড়লোক ছিলেন তাহা নহে, তিনি যে রীতিমতো হিন্দু ছিলেন তাহাও নহে- তিনি তাহা অপেক্ষাও অনেক বেশি বড় ছিলেন, তিনি যথার্থ মানুষ ছিলেন।’
-: আরও শুনুন :-
রবীন্দ্রনাথ যদি ভোটে দাঁড়াতেন, কী থাকত নির্বাচনী ইস্তাহারে?
যদি ভোটে দাঁড়াতেন কাজী নজরুল ইসলাম, কী থাকত নির্বাচনী ইস্তাহারে?
এই ‘যথার্থ মানুষ’ হয়ে ওঠা যেমন বিদ্যাসাগরের নিজের জীবনের সাধনা; তেমনই তিনি দেশের জন্য ‘যথার্থ মানুষ’ তৈরিরই পক্ষে ছিলেন। তাঁর ধর্মভাবনা নিয়ে নানা সংশয় দেখা দেয়। তবে বলা যায়, তিনি ধর্মের যে অর্থ উপলব্ধি করেছিলেন, সেখানে সবার উপর মানুষই সত্য। ‘সেকিউলার’-এর যে মানবতামুখী ধারণা, তাই-ই হয়ে উঠেছিল বিদ্যাসাগরের দর্শন। চিন্তক রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্যের কাছে আমাদের আবার ফিরতে হয়। সময়ের নিরিখে সেকিউলারের নানা অর্থ বিশ্লেষণ করতে করতেই তিনি মনে করিয়ে দিচ্ছেন উনিশ শতকের সেকিউলারিজমের তাৎপর্যের কথা- “সেকিউলারিজম বলতে বোঝানো হলো সেই মতবাদ যাতে নীতিবোধ শুধু মানবজাতির ইহজীবনের ভালো-থাকার উপরেই দাঁড়িয়ে থাকে; ঈশ্বর বা পরকালে বিশ্বাস-সংক্রান্ত সব বিবেচনা তার থেকে বাদ দেওয়া হয়। এই সঙ্গে আর-একটি মতও উনিশ শতক থেকে বেশ জোরদার হয়ে ওঠে। সেটি হল: শিক্ষা, বিশেষ করে সরকারি খরচে শিক্ষাকে একেবারেই অ-ধর্মীয় হতে হবে। … এই ঐতিহাসিক পটভূমি মাথায় রাখলে বোঝা যাবে, বাংলায় তথা ভারতে বিদ্যাসাগরকেই প্রথম ও যথার্থ অ-ধর্মীয় শিক্ষাবিদ ও প্রকৃত অ-ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব বলা যেতে পারে। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি নিরীশ্বরবাদী ছিলেন, না অজ্ঞেয়বাদী ছিলেন, নাকি রবার্ট আওয়েন-এর মতো ডীইস্ট ছিলেন সে নিয়ে তর্ক থাকতে পারে। কিন্তু তাঁর জীবন ও কর্মে যে ধর্মের বিন্দুমাত্র ভূমিকা ছিল না- এ নিয়ে কোনও প্রশ্ন ওঠার সুযোগ নেই।” এই দৃষ্টিকোণ থেকে বিদ্যাসাগরের সারা জীবনকে দেখলে বোঝা যায়, রবীন্দ্রনাথের ‘যথার্থ মানুষ’ অভিধা তাঁর জন্য কী অবধারিত ভাবে সুপ্রযুক্ত। শিবনাথ শাস্ত্রী তো তাঁকে ‘পাগল মানুষ’-ই বলেছিলেন। সেই অর্থে পাগল, যিনি কিনা “পরের জন্য আপনাকে দুরন্ত শ্রমে নিক্ষেপ করিলেন, যিনি হাজার হাজার টাকা তুড়ি দিয়া উড়াইয়া দিলেন, যিনি অম্লানচিত্তে লোকনিন্দা ও নির্যাতনের মুকুট মাথায় তুলিবার জন্য বদ্ধপরিকর হইলেন।”
-: আরও শুনুন :-
গান্ধীজি যদি ভোটে দাঁড়াতেন, কী থাকত তাঁর নির্বাচনী ইস্তাহারে?
কেমন হবে বিরোধিতা? শ্রীচৈতন্যের যুক্তি প্রাসঙ্গিক নির্বাচনের মরশুমেও
নিজেকে এইভাবে বিলিয়ে দেওয়ার ভিতরেই ছিল তাঁর স্বদেশভাবনা। শুধু ‘বর্তমানে অতৃপ্তি’ নয়, ‘ভবিষ্যৎ-রচনা’য় তাঁর মূল আগ্রহ। আর সেদিকেই তিনি দেশকে এগিয়ে দিতে চাইছিলেন তাঁর বিপুল কাজের মাধ্যমে। সবথেকে বড় কথা, তিনি তো নিজে শাস্ত্রজ্ঞ ছিলেন। তাঁর বাবার ইচ্ছা ছিল যে, সংস্কৃত শিখে তিনি চতুষ্পাঠীতে অধ্যাপনা করবেন। সংস্কৃত এবং শাস্ত্র- দুই-ই তিনি বিস্তর জানতেন। আর তাই জানতেন, ঠিক কোথায় কোথায় গোঁড়ামির বাস। যে ভবিষ্যৎ ভারত-সমাজের ছবি তাঁর মনে আঁকা, সেখানে পৌঁছনোর প্রতিবন্ধকতাগুলো তাঁর থেকে ভালো আর কারও জানা ছিল না। তাঁর কাছে তাই মনুষ্যত্বের আদর্শ অনেক বড় ছিল। নিজের জীবনকে তিনি সেই ছাঁচেই ফেলেছিলেন। শিবনাথ শাস্ত্রী তাই বলেন, “বিদ্যাসাগর মহাশয় যে অসত্য ও অন্যায়ের গন্ধ সহ্য করিতে পারিতেন না, তাহার কারণ এই, অসত্য বা অন্যায়কে তিনি মানব-জীবনের পক্ষে এত হীনতা মনে করিতেন যে, তাঁহার চিত্ত তাহার চিন্তনেও অসহিষ্ণু হইয়া উঠিত।” অর্থাৎ যা মানব-সমাজের পক্ষে হীন, তাঁর বিরুদ্ধে সংগ্রামই তাঁর একমাত্র লক্ষ্য। আলাদা আলাদা প্রসঙ্গ উল্লেখ না করলেও বোঝা যায়, তিনি যে কাজে হাত দিয়েছেন সেখানে এই অসত্য, হীনতা ও অন্যায়কে অতিক্রম করারই প্রয়াস ছিল। শিবনাথের মতে, “বিদ্যাসাগর মহাশয় মানব-চরিত্রের আদর্শে প্রাচ্য প্রতীচ্যের সমাবেশ করিয়ে নবচরিত্র ও নবসমাজ গঠন করিতে চাহিয়াছিলেন। সে কার্য এখনও চলিতেছে ও পরেও চলিবে, তাহাতে আর সন্দেহ নাই।” সে কাজে না পেয়েছেন সহযোগী, না পেয়েছেন বিপুল সমর্থন। তবু ওই এককের অভিযান বন্ধ হয়নি। রবীন্দ্রনাথ তাই বলেন, “তিনি প্রতিদিন দেখিয়াছেন-আমরা আরম্ভ করি, শেষ করি না: আড়ম্বর করি, কাজ করি না যাহা অনুষ্ঠান করি তাহা বিশ্বাস করি না; যাহা বিশ্বাস করি তাহা পালন করি না: ভূরিপরিমাণ বাক্যরচনা করিতে পারি, তিলপরিমাণ আত্মত্যাগ করিতে পারি না: আমরা অহংকার দেখাইয়া পরিতৃপ্ত থাকি, যোগ্যতালাভের চেষ্টা করি না: আমরা সকল কাজেই পরের প্রত্যাশা করি, অথচ পরের ত্রুটি লইয়া আকাশ বিদীর্ণ করিতে থাকি; পরের অনুকরণে আমাদের গর্ব, পরের অনুগ্রহে আমাদের সম্মান, পরের চক্ষে ধুলিনিক্ষেপ করিয়া আমাদের পলিটিকস, এবং নিজের বাকচাতুর্যে নিজের প্রতি ভক্তিবিহ্বল হইয়া উঠাই আমাদের জীবনের প্রধান উদ্দেশ্য। এই দুর্বল, ক্ষুদ্র, হৃদয়হীন, কর্মহীন, দাম্ভিক, তার্কিক জাতির প্রতি বিদ্যাসাগরের এক সুগভীর ধিক্কার ছিল। কারণ, তিনি সর্ববিষয়েই ইহাদের বিপরীত ছিলেন।”
বিদ্যাসাগরচরিত তাই আত্মস্থ করা কঠিন। নির্বাচনের মরশুমে আমাদের নানা চাহিদা থাকে; প্রতিশ্রুতিও মেলে; তবে, বিদ্যাসাগরের এই অ-ধর্মীয় এবং মনুষ্যত্বের ভাবনা কি কখনও আমাদের চাহিদা হয়ে উঠবে!