ছোটবেলার ট্রেন স্টেশন ছেড়েছে অনেকদিন। রিটার্ন টিকিট নেই। স্মৃতির গায়ে তবু ফেরার ডাক। সেইসব জমানো চিঠিতেই শোনো-র ডাকঘর। পড়ে-শুনে নিন।
প্রিয় ছোটবেলা,
মাঝে মাঝে একা থাকলে মনের খবরেরা সিন্দুক থেকে বেরিয়ে ফিরে ফিরে আসে।
আমার মা বাড়ি থেকে অনেক দূরে কলেজে পড়াতেন। হয় বাসে করে যেতে হত প্রায় দেড় ঘণ্টা বা বেশ শ’খানেক সিঁড়ি ভেঙে চড়তে হত মেট্রোতে। তাও বেশিরভাগ দিন মা টিফিন বানিয়ে দিতেন। সেদিন খুব স্যান্ডুইচ খেতে ইচ্ছা করছিল। মা দিয়েছিল রুটি-তরকারি। খুব রাগ করেছিলাম। পরে বুঝেছিলাম মায়ের সেদিন একটু তাড়া ছিল। আমি রুটিটা দাঁতেও কাটিনি। ফেলিনি। কারণ আমার ঠাকুমা বলেছিল, খাবার কখনও ফেলতে নেই, নয়তো একদিন খেতে পাওয়া যায় না। তাই দিয়ে দিয়েছিলাম একজনকে। অন্য একজনের কাছ থেকে লুচি তরকারি খেয়েছিলাম।
বিকেলে স্কুল থেকে ফিরে দেখি, সকালে যেহেতু দিতে পারেনি, মা অতদূর থেকে খানিক কাজ বাদ দিয়েই বাড়ি ফিরে এসে আমার জন্য স্যান্ডুইচ বানিয়েছে। আজ যখন আমার দশমবর্ষীয় পুত্র প্রায় প্রতিদিনই বিভিন্ন খাবার বানিয়ে দেওয়ার আর্জি জানায়, তখন বুঝতে পারি একজন কর্মরতা মায়ের পক্ষে কত কঠিন হয় সব আবদার পালন করা। সেদিন আমার ব্যবহার বা মানসিকতা মনে পড়ে এখন আমার খুব দুঃখ হয় জানো, ছোটবেলা। যদি একবার তুমি বুঝিয়ে দিতে! একবার যদি সেদিনটা ফিরিয়ে দিতে শুরু করতাম পুনরায়!
ডাক্তার হতে চেয়েছিলাম জানো! আমার ক্লাসে আমি ফার্স্ট হতাম বরাবর। কিন্তু জয়েন্টে আমার র্যাংক হয়নি। আমাদের ক্লাসে যে সেকেন্ড হত সে চান্স পেয়েছিল। আজ কোথায় যেন আফশোস রয়ে গেছে, গলায় স্টেথো ঝোলানো আর নামের শুরুতে DR. লেখার স্বপ্নটা বাস্তবায়িত না হওয়ার।
গার্লস স্কুলে পড়লেও ক্লাস এইট থেকে যখন টিউশনি যেতে শুরু করলাম, তখন সমবয়সী ছেলেদের সঙ্গে পরিচয় হয়, সেই প্রথম ‘স্ল্যাং’ শোনা। প্রথমদিন তিন-চার অক্ষরের কয়েকটি কথা বলে ছেলেরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছিল যখন, তখন কান গরম হয়ে গিয়েছিল। পরে আস্তে আস্তে দেখলাম তারা খারাপ নয়। চারিদিকের বেশ কয়েকটি দৃষ্টি মাঝে মাঝে তাকাত। অর্থপূর্ণ বিনিময়। তাও আমি তাকাতাম না। বায়োলজি কোচিংটা ছিল বেশ মনের মতো। স্যার খুব ভালো পড়াতেন। তখন বুঝেছিলাম বিষয় ভালো লাগাটা অনেকটা নির্ভর করে কেমনভাবে পড়ানো হচ্ছে তার উপর। স্কুলে আমরা শিক্ষিকাদের ‘দিদি’ বলে ডাকতাম। আমাদের বাংলামাধ্যম ছিল। এই একটা বিষয়ে আমার সামান্য হলেও একটা হীনমন্যতা আছে। চাইলেই গড়গড় করে ইংরেজি বলতে পারি না। যদিও আমার মনে হয় এটা মেন্টাল ব্লকেজ।
জানো তো, বড়বেলায় এসে বারবার মনে হয় কিছু জিনিস যদি রিস্টার্ট করা যেত! স্কুল ও কলেজের দু’একজন বন্ধু আছে যাদের মন খারাপ হলেই ফোন করতে পারি। কিন্তু অনেকেরই মা-বাবা বন্ধু হয়, আমার তা হয়নি। আবার শুরু করতে পারলে গলায় স্টেথো ঝুলিয়ে খস খস করে প্রেসক্রিপশন লিখতাম! তবে সবটাই না-পাওয়া নয়! ছোটবেলায় ভাবতাম, কবে পরীক্ষা দেওয়া বন্ধ হবে! এখন আর তেমন পরীক্ষা দিতে হয় না ঠিকই। তবে জীবনে নানা ওঠাপড়া চলতেই থাকে। এই জটিলতা ছোটবেলায় ছিল না।
এইভাবেই হয়ত কেটে যাবে একদিন, বড়বেলা, বুড়োবেলাও। ছেলে-মেয়েরাও বড় হয়ে যাবে। সেদিন আবার ফিরে ফিরে আসবে ছোটবেলা, স্রোতের মতো। দেখি সেই সময়ে আবার সব হিসেব মিলিয়ে নিতে পারি কিনা! বড় মিস করি তোমাকে।
ভালো থেকো।