ছোটবেলার ট্রেন স্টেশন ছেড়েছে অনেকদিন। রিটার্ন টিকিট নেই। স্মৃতির গায়ে তবু ফেরার ডাক। সেইসব জমানো চিঠিতেই শোনো-র ডাকঘর। পড়ে-শুনে নিন।
প্রিয় ছোটবেলা,
অনেকদিন তোমার সঙ্গে কথা হয়নি। কেমন আছ? মনে পড়ে সেইসব আলাভোলা দিনগুলোকে? সেই যখন আমি চার কিংবা পাঁচ। তখনও আমাদের বাড়িতে কয়লার তোলা উনুনে রান্না হত। মা যখন উনুনে ঘুঁটে সাজাতেন, আর উপরে চুড়ো করে রাখতেন কয়লা, আমি খুব মন দিয়ে দেখতাম। পড়াশুনোর বালাই ছিল না আমার। যতক্ষণ না মা হাতের সব কাজ সেরে আমায় নিয়ে বসছেন, আমি বই ছুঁতাম না। আর সংসারের কাজ যে শেষই হয় না। তাই আমার পড়ার পাট নেই বললেই চলে। সারাদিন শুধু মায়ের পায়ে পায়ে ঘুরে বেড়াতাম।
আমার মনে হত মা ঘরকন্নার সমস্ত কাজ ভালভাবে পারে না। আমি যখন বড় হয়ে ‘গিন্নি’ হব, তখন ঘরকন্নার কাজ ঢের ভালো করব। কখন, কোন বয়সে, কিভাবে ‘গিন্নি’ হয় সে বিষয়ে কিছুই ধারনা ছিল না। শুধু জানতাম, ‘গিন্নি’ হওয়া, বড়ো হওয়ারই একটা ধাপ। ঝাঁট দেওয়া, উনুনে আঁচ দেওয়া, রান্না, পাতকুয়ো থেকে জল তোলা, এসব যে আমি মায়ের চেয়ে হাজার গুণে ভাল করব তাতে আমার কোনো সন্দেহ ছিল না।
এর পাশাপাশি আরেকটা ইচ্ছেও ছিল। বাড়িতে ঘুঁটে বিক্রি করতে আসতেন এক মহিলা। মাথার ঝুড়িতে সুসজ্জিত ঘুঁটের স্পতূপ, আসাধারণ ব্যালেন্সে হাঁটা, সর্বোপরি, অবিশ্বাস্য দ্রুত গতিতে ঘুঁটে গুনে র্যাকে সাজিয়ে দেওয়া, আমি মুগ্ধ হয়ে দেখতাম। আমার মা ঘুঁটে-কয়লা এত সাজিয়ে রাখায় আগ্রহী ছিলেন না । যেগুলোকে পরদিনই উনুনে গুঁজতে হবে, তাদের এত সাজিয়ে রাখার কী আছে? আমি কিন্তু স্বপ্ন দেখতাম যে বড় হয়ে আমি ‘ঘুঁটেওয়ালি’ হব— কেমন লোকের বাড়ি বাড়ি ঘুরে ঘুঁটে বিক্রি করব আর সাজিয়ে দিয়ে আসব। মাকে একদিন সে কথা বলতেই মা জোর ধমক দিয়েছিল, ‘ওই হবে তোমার! যে মেয়ে পড়াশুনোর নাম করে না, তার আর কী হবে?’
না, ঘুঁটেওয়ালি হওয়া আমার হয়নি। বছর ঘুরতেই বাড়িতে এল গ্যাসের উনুন, ঘুঁটেওয়ালির আনাগোনা বন্ধ হল, আর আমিও ভুলে গেলাম সেই ইচ্ছের কথা।
পরের বছর আমি ইস্কুলে ভর্তি হলাম। লোকজনের কথা শুনে আমার মনের মধ্যে একটা ছবি আঁকা হয়ে গেছিল যে ইস্কুল আসলে একটা খুব লম্বা সিঁড়ি, অনেকটা গ্যালারির মতো – সিঁড়িগুলোর গায়ে ১ থেকে ১০ পর্যন্ত নম্বর লেখা। ছাত্রছাত্রীরা সব্বাই সকালে গিয়ে প্রথমে ১ নং ক্লাসে বসে, তারপর একটা করে ঘণ্টা পড়ে আর সকলে একটা করে সিঁড়ি উঠে বসে। এমনি করে প্রত্যেকে প্রতিদিন ১ থেকে ১০ সব ক্লাসে পড়ে। পরের দিন আবার সেই একই ভাবে পড়াশুনো চলে। আর যদি কেউ সিঁড়ি উঠতে গিয়ে কখনও পড়ে যায় তবে সে সেই ক্লাসে ফেল করল। মা বলত, ‘ভাল করে পড়, নইলে ফেল করবি যে।’ আমি ভাবতাম, কী করে হবে? আমি তো সাবধানে সিঁড়িতে উঠব, ফেল করব না মোটেই!
কিন্তু ইস্কুলে গিয়ে দেখলাম ঘণ্টায় ঘণ্টায় পাশ করে পরের ক্লাসে ওঠা যায় না, একটা গোটা বছর একটা ক্লাসে থাকতে হয়। আর পাশ করতে অনেক বই পড়তেও লাগে, সিঁড়ি উঠতে পারলেই হয় না।
তবে ইস্কুলে যেতে শুরু করে আরেকটা নতুন জিনিস দেখলাম। সকালে যখন ইস্কুল যেতাম তখন ঝাড়ুদারেরা লম্বা হাতলওলা ঝাঁটা দিয়ে রাস্তা ঝাঁট দিত। বাড়িতে মা উঠান ঝাঁট দেয় যে খাটো ঝাঁটায় সেটা এমন চমকপ্রদ নয়। ইস্কুলে গিয়ে দেখলাম সেখানের ঝাড়ুদারকাকুরও অমন লম্বা ঝাঁটা আছে; সে খাটো ঝাঁটাতেই অমন লম্বা হাতল লাগাতে পারে! ব্যস! মনস্থির করে ফেললাম, আমি কাকুর কাছে ঝাঁটায় হাতল লাগিয়ে নিয়ে রাস্তা ঝাঁট দেব।
এখন প্রায় চার দশক পরে- আমার দৃষ্টি ঝাপসা, গাঁটে-গাঁটে মরচে, মুখের রেখায় আজব ত্রিকোণমিতির খেলা। জীবনের পাকেচক্রে পড়ে কী হওয়ার কথা ছিল, আর কী হলাম গুলিয়ে গেছে। সুকুমার রায়ের ‘কিম্ভুত’ জন্তুটার মতো নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করি, ‘নই আমি কিচ্ছু?’
এখন মনে হয় ইস্কুল নয়, জীবনটাই আসলে অন্তহীন সিঁড়ি; সেই সিঁড়ি চড়ার পাঠ কোনও ইস্কুলে কখনও শেখায় না। নিজে ঠোক্কর খেতে খেতে শিখতে হয়। আমার অনেক পাঠ শেখা হয়নি, অনেক সিঁড়ি চড়তেই পারিনি আমি- ফেল করে গেছি ডাহা।
বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ছোটবেলার ইচ্ছেগুলো হারিয়ে গেছে। অনেক নতুন ইচ্ছে জন্মেছে, তার বেশিভাগই চুপচাপ গিলে নিয়েছি, আলোর মুখ দেখেনি তারা। কিছু খুব বেয়াড়া, জেদি ইচ্ছে রয়ে গেছে মনের কোণে মাটি কামড়ে। যেমন ধরো, একটা ক্যামেরা কেনার ইচ্ছে। আরেকটা ইচ্ছে,একবার অন্তত পাহাড়ে যাওয়া। আজকাল লোকে দেশ-বিদেশ সব ভ্রমণ সেরে ফেলছে ,আর আমি কিনা দিঘা-পুরীও যাইনি কখনও। তাই, অন্তত একবার, দেবতাত্মা হিমালয়ের সামনে গিয়ে নতজানু হব, হাত জোড় করে বলব, ‘হে দশ দিক, আমি কোনও দোষ করিনি, আমাকে ক্ষমা কোরো’।
এমনি করে কিছু পাওয়া আর কিছু না পাওয়াতে ক্রমশ ভরে উঠছে জীবনের ঝুড়ি। জানি শৈশবে আর ফেরা যায় না; তবু যখন দমবন্ধ লাগে, ভীষণ মন খারাপ হয়, বা রাতে ঘুম আসে না- উল্টোপাল্টা কাটাকুটি আর কথা চালাচালি চলে মাথার মধ্যে – তখন আমি দুই বিনুনি ঝোলান , হাসিখুশি সেই দিনগুলোকে আবার ছুঁতে চাই। তুমি তাদের খুব যত্নে রেখো। ভালো থেকো, ছোটবেলা …