ছোটবেলার ট্রেন স্টেশন ছেড়েছে অনেকদিন। রিটার্ন টিকিট নেই। স্মৃতির গায়ে তবু ফেরার ডাক। সেইসব জমানো চিঠিতেই শোনো-র ডাকঘর। পড়ে-শুনে নিন।
বড় হতে হতে আমরা হারিয়ে গেছি ক্রমশ। হারিয়ে গেছে আমাদের শৈশবের সোনাঝরা মন। কত কথা বলা হয়নি, কত ক্ষমা চাওয়া হয়নি, কত অর্থহীন আবদারে উত্যক্ত করা প্রিয়জনদের কাছে ফিরে যাওয়া হয়নি সেই ছোট্টটি হয়ে!
কলকাতার বাঙ্গুর হাসপাতালের বেডে শুয়ে শুয়ে বছর পঁচিশ আগের তারা গোনা একুশটা রাতের স্মৃতি, শৈশবের কাছে নতশিরে বসিয়ে রাখে আমায়। একটা লম্বা হলঘরে একটানা আট-দশটা বেড পাতা। সেইরকম একটা বেডের অধিকার নিয়ে বছর পাঁচেক বয়েসে বাঙ্গুর হাসপাতালে ঢুকতেই যাদের সঙ্গে দেখা হল, তারা সবাই তখন নতুন বন্ধু। আমার ঠিক উলটোদিকের বেডে ছিল তাতাইদাদা। স্থূলকায় টকটকে ফর্সা শরীরটুকু কোনোরকমে তুলে ধরে ঠেস দিয়ে তাকে বসিয়ে দিত ওর মা। ওর মুখ দিয়ে অনবরত লাল ঝরত। তখন তো জানতাম না পৃথিবীতে ওর জীবনের মেয়াদ খুব বেশিদিন নয়! তাই আমার আগেই যখন ওর হাসপাতাল থেকে ছুটি হয়ে গেল, তখন খুব রাগ হল৷ মনে হয়েছিল ডাক্তারবাবুরা শুধু শুধু আমাকে আটকে রাখছে! আমি তো ওর থেকে অনেক সুস্থ! তাতাইদাদাকে কোনও দিন বলা হল না, ওর আর আমার অসুস্থতার পার্থক্য বোঝবার বোধ তখনও হয়নি বলেই ওর ছুটির সময় আমি ওর গায়ে হাত বুলিয়ে দিইনি মোটেই!
তখন কেবলই আমার মনটা ওই বাঙ্গুর নামক বাড়িটা থেকে বেরোবার জন্য ছটফট করত৷ আমাদের ঘরের একটা জানলা দিয়ে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের পরিকে দেখা যেত৷ আর সেই জানলার ধারে ছিল আনন্দদাদার বেড। ওর বিছানায় বসে খেলতে খেলতে আমরা পরি দেখতাম৷ ওর বাড়ি থেকে কেউ কোনও দিন ওকে দেখতে আসেনি। ডাক্তারবাবুরা ওর বাড়ির লোককে খবর দেবার জন্য উতলা হয়ে উঠেছেন দেখে আমার বাবা উপযাচক হয়ে ঠিকানা খুঁজে হাওড়ার কোনও এক প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে ধরে আনল ওর বাবাকে। বিকেলে জানতে পারলাম, আগামী কাল ওর অপারেশন। বলেছিলাম সুস্থ হলে আমরা সব্বাই ওদের বাড়ি ঘুরতে যাব। দুদিন বাদে ছুটি হয়ে আমি যখন বাড়ি ফিরছি, তখনও আনন্দদাদা স্যালাইন চ্যানেল হাতে অঘোরে ঘুমাচ্ছিল। কথা হয়নি আর কোনও দিন৷ বড় হয়ে বুঝেছি, আমাদের বাড়িতে আদরের ঢল ছিল। ওর একটা বাড়ি ছিল হয়তো, কিন্তু আদর আর আশ্রয় ছিল কি?
ফিমেল ওয়ার্ডের এক দিদি আমায় ‘বন্ধু’ বলে ডাকত। আমি বাড়ি ফেরার জন্য বায়না করলেই বলত, যদি আমার আগে ওর ছুটি হয়ে যায় তাহলে নার্সদিদিকে বলে ও আমার বেডে থেকে যাবে, আর আমাকে বাড়ি পাঠিয়ে দেবে। সেদিন আমার ছুটির খবরে ওর মুখে খুশির হাসি ঝিলমিল করে উঠেছিল, যেন ওরই ছুটি! তারপর টানা পাঁচমাস প্রতিমাসে চেক-আপ করাতে যেতাম, আর ওর সঙ্গে দেখা করে আসতাম। ওই একই বেডে একইরকম হাস্যোজ্জ্বল মুখে ‘বন্ধু’ আমায় কোলে নিত। শেষবার যখন দেখা করতে গেছি তখন ওর হাতে স্যালাইন চলছে, ঘুমোচ্ছে। বাবাকে নার্সদিদি বলেছিল, “নতুন করে অপারেশন হয়েছে, এবারে সাকসেসফুল হলে ভালো, না হলে…!” বড় হয়ে খুব মনে হয়, আমার ছুটির খবর আনন্দ করে ‘বন্ধু’কে বলতে গিয়ে কী আঘাতই না করেছিলাম তাকে! তবু অদ্ভুত শক্তিতে নিজেকে হাস্যোজ্জ্বলতায় ঘিরে রেখেছিল ও। ওর কাছে ক্ষমা চাওয়ার কোনও পথই তো আর নেই!
এদের কারও মুখ বা অবয়ব আমি আজ এত বছর বাদেও ভুলিনি। সোশ্যাল মিডিয়ার অনেক কাল আগের এই বন্ধুরা- হারিয়ে গেছে সকলেই! কেউ হয়তো বা এই মর্তরাজ্যের বুকেই, আবার কেউ হয়তো মহাকাশের শূন্যতায়! শৈশবের ছোট্ট গণ্ডিজীবনে আরও অনেক বন্ধুই ভেসে গেছে ঠিকই, কিন্তু এদের মতো করে কেউ কি চলে গেছে এক্কেবারে ঠিকানাহীন নিরুদ্দেশে! এই নিরুদ্দেশের উদ্দেশেই বর্ণমালা সাজালাম।