ছোটবেলার ট্রেন স্টেশন ছেড়েছে অনেকদিন। রিটার্ন টিকিট নেই। স্মৃতির গায়ে তবু ফেরার ডাক। সেইসব জমানো চিঠিতেই শোনো-র ডাকঘর। পড়ে-শুনে নিন।
প্রিয় গ্রাম,
তুমি এখন কেমন আছ আমি জানি না। আজ পনেরো বছর হয়ে গেল তোমাকে দেখিনি। তুমি কি আমাকে ভুলে গেছ? হতে পারে। কেনই বা মনে রাখবে? আমি নিজের স্বার্থ রক্ষা করতে, নিজেকে ভালো রাখতে শহরে চলে এলাম।
এখানে আসার পর থেকে প্রায় মনে পড়ে তোমাকে। সারাদিনের ক্লান্তি নিয়ে বিছানায় শুলে ঘুম আসে না, তখন তোমার কোলে মাথা রেখে ঘুমানোর দিনগুলো ভাবি। আমি তো ভূমিপুত্র ছিলাম না, তুমি তা বুঝতে দিলে না। আমাকে নিজের ছেলের মতো আগলে রেখেছিলে। চার বছর বয়সে বড়মামার হাত ধরে তোমার কাছে যাই, তারপর আর মা-বাবার কাছে ফিরে আসি না। কোন যে মায়ার বাঁধনে পড়ে গেলাম! তারপর তোমার মাটির গন্ধ মেখে, পানাপুকুরের জল আর বাঁশ বাগানের সন্ধ্যার বাতাস নিতে নিতে শৈশব থেকে কৈশোর কাটতে থাকল।
মনে পড়ে, দাদুর সঙ্গে কাটানো সেই দিনগুলো। দাদুর হাত ধরে প্রাইমারি স্কুল যেতে যেতে চিনতে শিখেছিলাম ধানের জমি, আল, চাষের লাঙল, চাষীদের পরিশ্রম। স্কুল থেকে ফিরে বিকেলে সারাদিন খেলার পর সন্ধ্যা হলেই বাইরে থেকে এসে ধুলো মাখা হাত-পা ধুয়ে উঠোনে মাদুর পেতে হ্যারিকেন জ্বেলে পড়তে বসতে হত দাদুর কাছে। আগের দিনের পড়া না পারলে মাথায় গাঁট্টা মারত আর পেটের চামড়া এমনভাবে কষে ধরত যে পরেরদিন ঝরঝর করে মুখস্থ করে ফেলতাম। দাদু যেমন শাস্তি দিত তেমনি বাবার মতো ভালোবাসা দিয়ে আমাকে মানুষও করেছিল। রাত হোক বা দিন দাদুর সঙ্গেই খেতে বসতাম। সবসময় নিজের পাতের ডিমের সবটুকুই আমাকে খাওয়াতো। নিজে না খেয়ে আমাকে খাইয়ে দিয়ে বলতো, “ডিম খেলে শক্তি বাড়ে। মাথায় পড়া ধরে রাখতে পারবি। ডিম, দুধ খেতেই হবে তবেই তো আরও বুদ্ধির জোর বাড়বে।”
কিন্তু দাদু হঠাৎ আমাকে একা রেখে চলে গেল কোন অসীম পারে আজও খুঁজে পাই না। তোমার কাছে কি দাদু আসে? এলে জানিও আমি আজও প্রতিদিন তাঁকে মিস করি। আজ আমি পড়াশোনা করে বড় হয়ে গেছি। তবে আমি ক্ষমাপ্রার্থী, দাদু চেয়েছিল দাদুর মতো আমিও যেন স্কুলের মাস্টার হই, কিন্তু হতে পারিনি। আমার মনে পড়ে কৈশোর জুড়ে থাকা কীর্তন আর বোলান গানের কথা। চৈত্রমাসের শেষ দুদিন সন্ধ্যাবেলায় মন্দিরের সামনে দল বসত বোলান গানের। আমার সে কী উন্মাদনা! সারারাত জেগে দেখব বলে ঘর থেকে বস্তা এনে জায়গা রাখতাম, তারপর কৈশোরের অবাক চোখ দিয়ে দেখে যেতাম বোলান গানের নাচ, একটা দলের কথা শেষ হলে আর একটা দল এসে হাজির হত, এই করে করে সারারাত চলত। কিন্তু আমি যত ভাবতাম সারারাত জেগে দেখব, একটা সময় ঠিক ঘুমিয়ে পড়তাম, ঘুমের মধ্যে একটা শব্দ যেন দূর থেকে ভেসে ভেসে আসত, সেই সুর গিয়ে ছন্দ তুলত আমার স্বপ্নে।
বোলান শেষ হয়ে গেলে বৈশাখ মাসে প্রতি সন্ধ্যায় ভিড়ে যেতাম কীর্তনগানের দলে। দু’হাত তুলে নাচতে নাচতে কতবার ভেবেছিলাম চলে যাব বৃন্দাবনে। কিন্তু তারপর যৌবনে পা দিয়ে পড়া শেষ হলে দেখলাম জীবন গিয়ে পড়েছে কোন এক অন্ধকার খাদে। এখন সেই খাদ থেকে আলো খুঁজি, পাই না। তখন শুধু তোমাকে কল্পনা করি, ভাবি তোমার কাছ থেকে চলে না এলেই বুঝি ভালো হত।
আমাকে ক্ষমা করো গ্রাম-মা।