ছোটবেলার ট্রেন স্টেশন ছেড়েছে অনেকদিন। রিটার্ন টিকিট নেই। স্মৃতির গায়ে তবু ফেরার ডাক। সেইসব জমানো চিঠিতেই শোনো-র ডাকঘর। পড়ে-শুনে নিন।
আমার আদরের তিন্নি,
আয়নায় তাকালে আজকাল তোকে না চিনতে পারলেও, মনের ভেতরে তুই দিব্যি হাত পা ছড়িয়ে বসে আছিস রে তিন্নি। কাঁচা চুলের ফাঁকে লুকিয়ে থাকা পাকা চুল, চোখের কোণে কাকের পায়ের ছাপ, কুঁচকানো চামড়া দেখলে মনেই হয় না, একদিন আমি ঠিক তোর মতো ছিলাম। এপাড়া থেকে ওপাড়ায় গিয়ে ক্রিকেট খেলে আসতাম জমিয়ে। ভালো ব্যাট করতাম বলে অর্পণ, বাপ্পাদের থেকে একটু সম্ভ্রমই আদায় করে নিতাম।
জানিস তিন্নি, আজকাল সিঁড়ি ভাঙতে হবে ভাবলে চিন্তা করি, আর আমি যখন তুই ছিলাম দিব্যি গাছে উঠে ডাঁসা পেয়ারা খেয়ে, কাঁচাগুলো নিচে ছুড়ে মারতাম। একদিন তো সোজা সিকদার জেঠুর টাকে গিয়ে পড়েছিল। কী বকুনি, কী বকুনি!
তুই আজকাল কলাবিনুনি করিস আগের মতো? মনে আছে, মাম্মার কাছে কেমন গল্প শুনতাম? মাম্মার গায়ের এলাচের গন্ধ আর দিদার গায়ের জর্দার গন্ধ চোখ বুজলে এখনও পাই জানিস।
স্কুলে যাবার সময় যে ছেলেটা পাশ দিয়ে বোঁ বোঁ করে সাইকেল চালিয়ে চলে যেত, তার নামটা জানা হল না কখনও। আরেকবার তোর জায়গায় ফিরলে নির্ঘাত জেনে নিতাম। বহুযুগ পর সোশ্যাল মিডিয়ায় তাকে খুঁজে বের করে বেশ চমকে দেওয়া যেত।
স্কুল ভাবলেই সব বন্ধুর মুখ, বীণাদি, দীপ্তিদি, লীনাদির কথা মনে পড়ে। স্কুলের গেটে আলুকাবলি আর ফুচকার কথা। আর স্কুল ভাবলেই যমুনার কথা মনে হয়। একটু পিছিয়ে পড়া ছাত্রী ছিল, কী চমৎকার হাতের কাজ। মাটির ঘটে অপূর্ব আঁকত, আদ্দির কাপড়ে ফোঁড় তুলে বানিয়ে ফেলত স্বপ্নের বাগান। একটু গল্প করতে চাইত আমাদের সবার সঙ্গে, ওর কাছ থেকে সেলাই দেখে নিলেও কখনও ওর কথা শুনিনি মন দিয়ে, গল্প করিনি কখনও। আসলে তোর বয়সে বোধহয় কাউকে দেবার মতো সময় থাকে না, আর এখন যখন হাতে সময় ফুরিয়ে এসেছে তখন মনে হয় যমুনার সঙ্গে দেখা হলে বেশ হত, সুখদুঃখের গল্প করতাম। মনের কথা বলাবলি করতাম অনায়াসে।
কী ঘুমকাতুরে ছিলি তুই তিন্নি, রেডিওতে যখন ‘স্থানীয় সংবাদ’ শেষ হয়ে ‘কৃষিকথার আসর’ শুরু হত, প্রত্যেকদিন মা তোর ঘুম ভাঙাত। চোখ পিটপিট করে তুই দেখতিস চান করে নিয়েছে মা, কপালে সিঁদুরের টিপ জ্বলজ্বল করছে। তারপর গঙ্গা দিয়ে কত জল বইল, শেষ বয়সে স্মৃতির কোন অতলে তলিয়ে গেল মা, চোখে ভাষা রইল না, কিন্তু আজও মাকে ভাবলে সেই আলোময় ছবিটাই মনে পড়ে রে তিন্নি। তোর কথা ভাবলেই বাবার কথা মনে হয়, আর বাবাকে ভাবলেই মনে পড়ে নিঝুম অন্ধকারে আকাশের তারা দেখা আর গান। কখনও ভীমসেন যোশী, ওঙ্কারনাথ ঠাকুর, সালামত আলির গান, আবার কখনও বেলা চাও, কানট্রি রোডস টেক মি হোম। তিন্নি আমার বুকের মধ্যে থাকা তুই সবসময় পেছন দিকে হাঁটিস কেন রে? তুইও কি ফিরতে চাস আমার মতো স্মৃতির পথ ধরে? তারা দেখতে চাস ছোটবেলার মতো ছাদে শুয়ে শুয়ে, জানতে চাস ক্যাসিওপিয়ার তারাদের নাম, জানতে চাস কোনটা আলফা, বিটা, গামা, ডেল্টা আর কোনটা এপসিলন ক্যাসিওপিয়া? তুই তো বদলাসনি আমার মতো। সময় তো তোকে পালটাতে পারেনি। তুই খুশি থাকিস, নিশ্চিন্তে থাকিস আমার বুকের ভেতর। তুই কক্ষনো বুড়ো হোস না, কেমন!