ছোটবেলার ট্রেন স্টেশন ছেড়েছে অনেকদিন। রিটার্ন টিকিট নেই। স্মৃতির গায়ে তবু ফেরার ডাক। সেইসব জমানো চিঠিতেই শোনো-র ডাকঘর। পড়ে-শুনে নিন।
প্রিয় ছোটবেলা আমার,
কেমন আছিস তুই? অনেকদিন লেখা হয় না তোকে। কথা অবশ্য হয় মাঝেমধ্যেই। নির্ঘুম রাতের আটকে যাওয়া স্বপ্নজালে সময়ের চোরকাঁটা যেখানে হুল ফোটাতে পারে না, সেই সময় স্মৃতির অ্যালবাম খুললেই তোকে দেখি। এই যেমন সেদিন এত্ত বড় চাঁদটা যেই না উঁকি দিল, ওমনি ঘুম গেল হারিয়ে, তড়াক করে বিছানা থেকে লাফিয়ে দাঁড়ালাম তার মুখোমুখি। মা বলল, “জ্যোৎস্নায় ঘুম ভেঙেছে বুঝি! পর্দা টেনে শো’ দেখি।”
জানলা ভাবল, ‘অ! কবিতা-টবিতা লিখবে হয়তো!’
গোটানো পর্দার ছায়ারা মাথা দুলিয়ে টিপ্পনী কাটল– ‘চন্দ্রাহত!’
ওদের কাণ্ড দেখে হাসছিলাম আমিও। ওরা যাকে চাঁদ দেখছে, সে তো আসলে তুই। সেই ন্যাপি পাল্টানোর দিন থেকেই আমার নামের (মুন) সঙ্গে চাঁদের রেণু জুড়ে আছে, যতবার লোকে নাম ধরে ডাকে ততবার তুই সাড়া দিস– এ আমি স্পষ্ট টের পাই। আপন মনে কথা বলার জন্য অনেকবার মায়ের কানমলা, বাবার বকুনি খেয়েছি। একবার এক বেস্টফ্রেন্ডকে বড় বিশ্বাস করে তোর গল্প বলেছিলাম। ভেবেছিলাম সে হয়তো বুঝবে যাদের ভাই-বোন থাকে না, আত্মীয়স্বজনের ইষ্টিকুটুম ডাক থাকে না, তাদের বয়স যতই বাড়ুক ছোটবেলাটাও আষ্টেপৃষ্ঠে সেঁটে থাকে আমৃত্যু। কিছুতেই একলা ছাড়বে না- এমনই অটুট পণ সেই ছোটবেলার। সে মুখ ভেটকে বলেছিল, “ধুস, খ্যাপা হয়েছিস নাকি!”
তারপর থেকে তোর কথা আর কাউকে বলিনি, বলি না। তুই যে আমার বড় যত্নে লুকিয়ে রাখা গুপ্তধন। সবাই বিশ্বাস করবে কেন! তাই তো কেবল চাঁদ জানে, ফুল জানে, পাখিরা জানে আর আকাশ জানে তোকে। এরা বাদে আরেকজনও অবশ্য জানে– আমার বইয়ের তাক।
সেই মেয়েবেলা থেকেই কতরকম ঘটনাই তো ঘটল জীবনে, সবই তোর জানা। কিন্তু জানিস কি, দুঃখ হোক বা সুখ, ন্যাপথলিনের গন্ধ মাখা সুকুমার-সমগ্র অথবা ফেলুদা-শঙ্কুর পাতা খুললে, কিংবা রং-তুলি নিয়ে আপন মনে বসলে, অথবা রেডিওর নব ঘোরালে কে জানে কোন অদৃশ্য তরঙ্গ বেয়ে তুই নেমে আসিস।
এই যেমন সেদিন, মাকে নিয়ে কাল্লা গিয়েছিলাম। তুইও নিশ্চয় মিস্ করিস কাল্লা হসপিটাল, আমাদের নার্সেস হোস্টেল নামের জন্মবাড়ি, রতনকাকু আর গোবিন্দমামার দোকান, নুনিয়া নদীর ব্রিজ, মধু-মাস্টারের টিউশনের গলি, আমাদের একমাত্র ঠাকুরদালান আর ফুটবল গ্রাউন্ডকে। মায়ের সঙ্গে তো এইসব নিয়ে রোজ কিছু-না-কিছু গল্প হয়। তবে কিছু কথা তো বাকি থেকেই যা, যা তোতে-আমাতেই হতে পারে কেবল। সেইজন্যই তো প্রতিবছর নভেম্বর এলেই সুযোগ খুঁজি কখন যাব আমাদের জন্মস্থানে। মায়ের ব্যাঙ্কের হিজিবিজি কাজ পড়লেই তোকে নিয়ে নিশ্চিন্তিপুরের রাস্তায় বেড়িয়ে আসার সুবর্ণ সুযোগ মেলে।
জানিস, গত সাতাশ বছরে কাল্লা নামের ছোট্ট শহরতলিটা অ-নে-ক বড় হয়ে গেছে। সেখানে এখন প্রচুর মানুষের বসতি বেড়েছে, নজরুলের নামে বিশ্ববিদ্যালয় হয়েছে, হসপিটাল কলোনীতে এখন মস্ত মস্ত চশমা আঁটা পড়ুয়াদের মেস-বাড়ি। আমাদের মেয়েবেলার চেনা মুখেরা কেউ থাকে না, তবু আজও সেখানকার রাস্তাগুলো, গলির মুখ বা বাজারের চেহারাটা বদলায়নি। লাল ‘পোস্টাপিস’ বাড়িতে নীল রং পড়েছে, কিন্তু ছাঁচ বদলায়নি। সেই গলিপথে ঢুকলে আজও বাতাসে টাটকা সেরেল্যাকের গন্ধ ভাসে। বুকের খাঁচাটায় যখন সেই গন্ধমাখা বাতাস দখল নেয়, টের পাই তুই উচ্ছ্বাসে দু’হাত তুলে চিৎকার করছিস।
আশ্চর্যের বিষয় হল, বুকের লাব-ডুবে এই গন্ধটার গোপন সুখটা কেবল আমিই পাই। মায়ের মতো বড়রা নাকে রুমাল চেপে রাস্তা পেরোয়।
‘উফ, ঘনশ্যাম গোয়ালা মরে গেছে, কিন্তু তার খাটালটা আড়ে-বহরে বেড়েছে! ভাঙাচোরা, গু-গোবরে ভর্তি পথঘাট পেরিয়ে ফি-বছর আসতে ভালো লাগে?’– এইসব টিপ্পনীতে মন খারাপ হলেও বেশি কান দিই না। নইলে তোর সঙ্গে কাটানো ‘ফ্যান্টাস্টিক্’ দিনগুলো হারিয়ে যাবে না! এই যেমন কিছু অনুভূতি, যা অন্যেরা কেউ টের পাচ্ছে না– শুধু আমি পাচ্ছি, এর নামই তো‘খুশি’। তাই না!
আর জানিসই তো, বড়বেলায় আমরা শিখেছি খুশি জিনিসটা বড্ড আপেক্ষিক। এই যেমন নুনিয়া নদীর উপরের রাস্তাটার, যেখানে ছট পুজোয় এখন প্রচুর ভিড় হয়, লাইট আর ডিজে বাজে- সেটার ঢাল দিয়ে যখন আমার অল্টো গাড়ি, ওরফে ‘পক্ষীরাজ’কে গড়াতে দিলাম, তখন ওর চাকার শিহরনগুলো আমার সেই প্রথম সাইকেল শেখার দিনগুলোকে মনে করাচ্ছিল। কত ফাঁকা ছিল নদীর পাড় আর কত ঠান্ডা ছিল জলের বাতাস। বিচিত্র স্বরে বোঁ-ও-ও-ও আওয়াজ তুলে ওখানটায় সাইকেল চালাতাম,প্যাডেল করতে হত না, শুধুই হালকা ব্রেকে আঙুল– ব্যস, মনে হত যেন উড়োজাহাজের জানলা খুলে উড়ছি!
ফেরার পথে মা বলল, “কী রে, সেই কবে থেকে কাল্লা যাব নিজে ড্রাইভ করে, বলে বায়না করছিলি – এবার শখ মিটল তো!”
মাকে বললাম বটে ‘হ্যাঁ’, কিন্তু মনে মনে তো জানি, মেটেনি ।
কী করে মিটবে? হিমেল বিকেল দ্রুত গড়াচ্ছিল আর মা তাড়া দিচ্ছিল ফিরতে হবে।
বৃন্দাবন দারোয়ানের ক্যান্টিনের সামনে একটা পাবলিক টেলিফোন-বুথ ছিল আনন্দ-দার। সেখানেই প্রথম শিখেছিলাম PCO/ STD/ISD অক্ষরমালা, ল্যান্ডলাইন টেলিফোনে নাম্বার ডায়ালের হাতেখড়ির সেই মানুষটা যখন হঠাৎ ‘কেমন আছ, মুন?’ বলে ডেকে উঠল, আমার স্মৃতির পাতায় তার নাম হাতড়াতে দু’সেকেন্ড সময় বেশি লাগলেও খুশির প্যাঁটরা খুলতে সময় লাগেনি। গাড়িতে উঠতে যাব হঠাৎ দেখি সামনে অনিতা মাসি, মানে আমার ‘লালী’– এখনও অবসর নিতে দু’বছর বাকি! স্মৃতিদের খোসগল্পের কি সময়জ্ঞান থাকে!
এইসব নষ্ট জিয়াদের ধড়কন যখন তুঙ্গে, তখন দূর থেকে বোধহয় ‘ওরা’ দেখতে পেয়েছিল আমায়। নইলে চিরকুমারী একপেয়ে তালগাছটা হঠাৎ দুলেই বা উঠবে কেন, আর টিনের ভাঙা ট্রি গার্ডের মধ্যে বেড়ে ওঠা কামিনী গাছগুলোই বা দু’চারটে ফুল গড়িয়ে দেবে কেন! ভাঙা-টিনের ট্রি-গার্ডের মরচে পড়া ধারালো কোণায় আমার বাম ঊরু ক্ষতবিক্ষত হয়েছিল তেইশ বছর আগে। গাছগুলো একইরকম আছে। বদলে গেছে তাদের বেড়ার চেহারা। এখন সেখানে ইঁটের মজবুত দেওয়াল।
আমার জন্মবাড়ি, মানে মা-মাসিদের সেই নার্সেস হস্টেলটা – যেখানে ২১ নম্বর রুমের দরজায় আজও সাঁটা রয়েছে আলাদীন-জীনির স্টিকার – তার বৃটিস আমলের বিরাট কাঠামোটা নিয়ে একইভাবে দাঁড়িয়ে। প্রধান ফটকে দেখি শেকল পরানো রয়েছে! নিজের বাড়িতে ঢুকতে গিয়ে যদি দেখো ভোজবাজির মতো ‘নো-এন্ট্রি’র সাইনবোর্ড ঝুলছে – কেমন লাগবে? প্রথম গেট বন্ধ, দ্বিতীয় গেট বন্ধ, তৃতীয় গেটের একেবারে শেষে প্রায় আধ কিমি ঘুরে তবে মিলবে ঢোকার পথ! আমাদের জন্মবাড়ির কলেবর তো নেহাত কম নয়! গায়ে এখন তার নতুন রঙের পোচ। তা শরীরে যতই নতুন পোশাক চাপুক, তার শতাব্দীপ্রাচীন শিরাধমনীর পাকদণ্ডিতে ছড়ানো পুরোনো গাছেরা জানে আমার মা-মাসিমণিদের অক্লান্ত শ্রমের কথা, তাঁদের হৈ চৈ করা সরস্বতী পূজা ও রবীন্দ্রজয়ন্তীর নাটকে ভরা যৌবনের কথা। তিনটে শিশুর বড় হওয়ার কথা। তাদের হাসি-কান্না, শারদঅর্ঘ্য, পুজোর অঞ্জলি,ভোগ বিতরণ থেকে বিসর্জনের ভাংরা নাচ, অংকে লাল কালি পাওয়া ঘোর বর্ষাদিন অথবা আম কুড়ানি বোশেখের কথা। ওদের টানেই, কী মনে হল জানিস, উঁকি দিয়ে দেখলাম প্রধান ফটকের মেঝেতে আবছা হয়ে ফুটে আছে আমাদের কাঁচা হাতে আঁকা শেষ সরস্বতী পুজোর আলপনা। তার হলদে দেওয়ালে এখনো ‘বিদ্যাং দেহি’-র অস্পষ্ট হরফে ফুটে আছে কালচক্রের প্রহেলিকা। আমার শেষতম নৈবেদ্য ।
ওই ছোট্ট হাসপাতাল-কলোনিতে আনন্দের মতো কিচ্ছু কেউ, কেউ নেই এখন। তবু যাই ছোটবেলাকে ছুঁয়ে দেখতে। না-ই বা থাকল চকচকে রাস্তা, না-ই বা থাকল সাজানো গোছানো দোকানপাট- যে ‘জীবন গিয়েছে চলে কুড়ি কুড়ি বছরের পার…’ তার স্মৃতিদের কী সাজগোজ মানায়, বল!
সেজেগুজে থাকে তো সেই এলাটিং-বেলাটিং-এর বালিকার দল। তাদের গায়ে ঝলমলে ফ্রক, মাথায় উজ্জ্বল পালকের মুকুট। সেই যারা আকাশের তারাখসা দেখলে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে গোপনে ‘উইশ’ করত প্রিয় বন্ধুর জন্য। কলোনির আড়ম্বরহীন একটা মাত্র পুজোকে ঘিরেই তাদের কেটে যেত মাস খানেকের পুজোর ছুটি। সেই দুর্গামণ্ডপের গায়ে এখনও আমাদের হরলিক্সের গন্ধ লেগে আছে। ঢাকের বোল পড়লে যেখানে নামতীর্থ কাকু আমাদের সবাইকে ডেকে ডেকে প্রসাদ দিতেন আঁজলাভরে। যেখানে কোশাকুশি আর গঙ্গাজলে ব্যস্ত পুরুতমশাই আমার হাজারও কৌতূহলী প্রশ্নের উত্তর দিতে বসতেন।
তোর মনে পড়ে, নিজের ধর্ম ইত্যাদি নিয়ে বিন্দুমাত্র ধারণা না-থাকা আমি,পুজোয় কাকভোরে স্নান সেরে, নতুন সুগন্ধী মাখা জামা গায়ে সবার কনুইয়ের ফাঁক গলে ঠিক ঢুকে পড়তাম ঠাকুরমশাইয়ের একেবারে কাছে। সেই দুর্গাপুজোই হোক বা সরস্বতী পুজো। মুশকিল হত ‘গোত্র’ বলার সময়। তা সেই মুশকিলও কেটে গিয়েছিল নামতীর্থ কাকুর বাঁধা বুলিতে- “মুন তো ‘বাচ্চামানুষ’ গোত্র। নিন, ঠাকুরমশাই পুজোটা দিয়ে নিন।”
চিঠিটা কি খুব বড় হয়ে যাচ্ছে! তা যাক, কতদিন বাদে তোকে লিখছি, ক-ত দিন নাকি বছর? দীর্ঘ ৩০টা বছর ধরে এমনি করেই কত তারা খসেছে, দিন গিয়েছে চলে, রাত নেমেছে ঢলে ।
নির্মল আনন্দের ডালি সাজিয়ে তুই তো ভালোই আছিস ছোটবেলা। বড়বেলার আমিটাকে তোর নিষ্পাপ পশমিনার ওম্-এ আগলে রাখিস।