ছোটবেলার ট্রেন স্টেশন ছেড়েছে অনেকদিন। রিটার্ন টিকিট নেই। স্মৃতির গায়ে তবু ফেরার ডাক। সেইসব জমানো চিঠিতেই শোনো-র ডাকঘর। পড়ে-শুনে নিন।
ভাই ছোটবেলা,
তোমার মনে পড়ে একজন অবাক চোখের মেয়েকে, যে মাথায় বাটিছাঁট আর পায়ে ধুলো নিয়ে ঘুরে বেড়াত? তার মা সেই সকালে ইস্কুল চলে যায়, ফিরতে সন্ধে ঘনায়– আর বাবা রাজ্যের লোকের মুশকিল আসান করতে মাঝে মাঝেই বেরিয়ে পড়ে। তুমি তাকে একার জগৎ গড়তে শিখিয়েছিলে। সে পাশের বাড়ির গাছেদের পড়াত। একদিন বেত দিয়ে মেরে টগরের গায়ে সাদা রক্ত বের করে দিয়ে সে কী কষ্ট! রূপকথার বইতে পড়া ছিল, গাছ-মায়ের গায়ের ক্ষত মাটি লেপে সারিয়ে দিয়েছিল কোনও এক ভালো মেয়ে। কনুই পর্যন্ত কাদা ঘেঁটে সে পরম যত্নে প্রলেপ লাগিয়ে দিয়েছিল ফুলগাছের গায়ে।
সে মামার বাড়ির বাগানে জমা মাটির ঢিপিতে ছোট্ট ছোট্ট আগাছা আর নুড়িপাথর সাজিয়ে তৈরি করত নিজের রাজ্য– কানের পাশে দেবদারু পাতা গুঁজে টহল দিত তার আশেপাশে। নিতান্ত দায়ে পড়ে ‘খেলনাবাটি’ খেলতে হলে পুঁইমুচুরির রস মাটির তালে মিশিয়ে তাই দিয়ে বানাত কেক। সরু লম্বা নাম-না-জানা পাতার গায়ে সেফটিপিন দিয়ে নকশা করে মাছ বানাত, ঠিক বাজারের গোপালকাকুর মতো করে লেজ আর কানকোও কেটে দিত। ডাঁটির কাছটা ভেঙে আঠায় ফুঁ দিয়ে বুদ্বুদ ওড়ানোর সেই পাতা অনেক হত বাড়ির বেড়ায়। ছোট্ট লাল রঙের ফুলের কোন জায়গাটায় মধু থাকে, সে জানত। একদিন বেলি ফুল জলে সেদ্ধ করে ‘সেন্ট’ বানানোর চেষ্টাও করেছিল। মায়ের সদ্য কাচা সাদা শাড়িতে ছিটিয়ে যখন হলুদ দাগ হয়ে গেল, তখন পিঠেও কিঞ্চিৎ দাগ পড়েছিল। তাতে তো আর হাল ছেড়ে দেওয়া যায় না! বনজঙ্গলে ঘুরে বিছুটি পাতা লাগা, ইউনিফর্ম ভরতি চোরকাঁটা নিয়ে ফেরা, শিমুলতুলো বোঝাই মাথা নিয়ে হেঁচে ক্লান্ত হয়ে যাওয়া– কিছুই তার অন্তরায় হয়নি। তুমি তার হাত ধরে ছিলে।
পাঁচ বছর বয়সেই সে হারমোনিয়াম-তানপুরা ধরেছে; ঘুরে বেরিয়েছে সুরের অরণ্যে। ক্যারাটে ক্লাসে অদৃশ্য জলদস্যুকে খুব মেরেছে ‘খিয়াই’ বলে রগ ফুলিয়ে। যে ভিখারি বা সেলসম্যান খালি হাতে ফিরে গেল বলে গলার কাছে কান্না আটকে ছিল, আঁকার খাতায় তাদের বাড়ির পেছনেই পাহাড়ে লাল সূর্য ওঠাত। সামনে খেলা করত বাদামি কুকুর। পাড়ার বাচ্চারা যখন কুমিরডাঙা খেলছে, সে সবার আগে আউট হয়ে ফিরে এসে বাবার দেওয়া ইলেকট্রো-ম্যাগনেটিক সেট নিয়ে বসে ছোট্ট ফ্যান চালাচ্ছে। এয়ারগানে সিসের গুলি ভরে হনুমান তাড়াচ্ছে। উঠোনের রুক্ষ বালিমেশানো মাটি দিয়ে কার যেন মুখ বানানোর চেষ্টা করছে। ‘ইস্পাত’ পড়ে কেঁপে উঠছে, ‘আনা ফ্রাঙ্কের ডায়েরি’ রাতে ঘুমোতে দিচ্ছে না। তুমি তো দেখেছ সেসব। স্কুলে যে বন্ধুর জলের বোতল রাস্তায় পড়ে ভেঙে গেছিল, তার মাকে চিঠি লিখে দিয়েছিল, ‘ওকে বোকো না, ওর কোনও দোষ নেই’। তবু যখন সে বাড়িতে মার খেল খুব, তখনই তুমি আস্তে আস্তে দূরে সরতে শুরু করেছ। যখন বুঝল, ‘কাউকে বলিস না’ বলে তিন সত্যি করালেও, একজন অন্যজনকে সব গোপন কথা বলে দেয়… যখন দেখল তার জামাগুলো ক্লাসের বাকি বন্ধুদের মতো কায়দার নয় এটা একটা দোষ… যখন কেঁদে ফেললে আরও মার খেতে হল… যখন সত্যি কথা বললেও কেউ বিশ্বাস করল না… যখন নতুন কেনা পেনসিল বক্স চুরি করে নিল কেউ… যখন পুরস্কার পেলে বন্ধুর চোখে ঈর্ষা দেখতে পেল… কই তোমাকে তো আর খুঁজে পেল না! তখন তো ঠিক বড়দের মতো মনখারাপ গিলতে শিখে গেল সে। শিখে গেল, কোনও রাজ্য নেই তার। বড়দের শেখানো কোনও উপদেশ সত্যি হয় না। মিথ্যে বলতে হয়, বিশ্বাস করতে নেই, ডায়রিতে একান্তে লেখা কথাও জানাজানি হয়ে যায়, প্রতিযোগিতাই একমাত্র সত্য। সে মেয়ে তখন দ্রুত, অতি দ্রুত চুপ হয়ে যাচ্ছে আর একটা বাক্সে বন্দি করে ফেলছে তোমাকে। একগুচ্ছ গ্রিটিংস কার্ড, রাখি আর চিঠির সঙ্গে। ওই বাক্স দেরাজে আজও আছে- কিন্তু ভুলেও আর হাত দেয় না তাতে। তোমার সঙ্গে দেখা হয়ে গেলে মনখারাপ হবে। ছোটবেলার সঙ্গে ছোটবেলা ফুরিয়ে যাওয়ার মুহূর্তটাও সেঁটে থাকে, শুকনো ঠোঁটের চামড়ার মতো। আলাদা করতে গেলে রক্ত বেরিয়ে যায়।
এখন ভীষণরকম বড় একজন মহিলা আনমনে ভাবে, তোমার সঙ্গে আর কখনও দেখা হবে না। শিমুলতুলোয় তার অ্যালার্জি, পাতার কষে জামায় দাগ হয়ে যায়, খালি পায়ে হাঁটলে হোঁচট খায় চোখে বড্ড পাওয়ার বলে। গান গায় নিচু স্বরে, যাতে কেউ না শুনে ফেলে। মাটি নেই যেখানে, সেখানে তার সাততলার ঘর। জোনাকি, সুচ ফড়িং দেখেনি বহুকাল। বৃষ্টিতেও ভেজেনি অনেকদিন হল। সমস্ত খেলা থেকে মুখ ঘুরিয়ে থাকে।
শুধু মাঝে মাঝে, অসাবধানে, জানো… তোমার গায়ে হাত লেগে যায়। যখন ছোটবেলার গাছগুলো বড়বেলায় মানুষ হয়ে তার ক্লাসরুমে বসে থাকে। এখন মেয়েটা কাউকে বেত মারে না। শুধু কারও ক্ষত দেখলে, পরম মমতায় মাটি লেপে দেয়। আজও সে অভ্যাস ছাড়তে পারল না।
অন্য কোনও জন্মে দেখা হোক। তখন এত তাড়াতাড়ি ছেড়ে চলে যেও না, কেমন?