ছোটবেলার ট্রেন স্টেশন ছেড়েছে অনেকদিন। রিটার্ন টিকিট নেই। স্মৃতির গায়ে তবু ফেরার ডাক। সেইসব জমানো চিঠিতেই শোনো-র ডাকঘর। পড়ে-শুনে নিন।
প্রিয় কিশোরীবেলা,
ভালো আছ? আমায় চিনতে পারলে না বুঝি? আমি কিন্তু এখনও শিউলিগাছের কাছে গেলে শুধু তোমাকেই দেখতে পাই। সেই যে ফুলছাপ ফ্রক পরা তুমি আশ্বিনের ভোরে সাজি হাতে দৌড়তে চৌধুরীদের বাগানে, পাছে অন্য কেউ তোমার আগে গিয়ে সব ফুল কুড়িয়ে নেয়। ভোরের শিশিরে গা ভিজে যেত, পা ভিজে যেত- তবু গাছ ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে ফুল তোলা চাই-ই চাই। তারপর সেই ফুল দিয়ে মালা গেঁথে একছুটে দুর্গামণ্ডপে গিয়ে জমা করে তবে না শান্তি– মনে পড়ে!
মনে আছে, স্কুল ছুটির পর দল বেঁধে হারুণদার আলুকাবলি, হজমি গুলি, তেঁতুলের আচার খাওয়ার কথা? কিংবা শীতের দিনে ছাদে মাদুর বিছিয়ে রোদ পোহানো, পড়ার বইয়ের মধ্যে গল্পের বই রেখে পড়া বা চাদরের আড়াল থেকে লুকিয়ে পাশের বাড়ির রাজুদার ঘুড়ি ওড়ানোর মারপ্যাঁচ দেখার কথা?
প্রতিবার ডিসেম্বর মাসে বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হলেই বাবা আমাদের রেখে আসতেন মামার বাড়ি। তখন তো এত ট্রলিব্যাগ বা স্যুটকেশের চল ছিল না। একটা ঢাউস ট্রাঙ্কে মা সব জিনিসপত্র গোছাতেন। সেসব নিয়ে ট্রেনে করে যাওয়া হত, তখন ছিল কয়লার ইঞ্জিন। চোখ করকর করত, মা আঁচল দিয়ে আড়াল করতেন যাতে কয়লার গুঁড়ো আমাদের চোখে না ঢোকে। আবার যেদিন সেখান থেকে ফিরতাম, মামাবড়ির আত্মীয়স্বজন ছাড়াও পাড়াতুতো কত মাসি-পিসিরা দল বেঁধে আমাদের বিদায় জানাতে আসতেন। প্রত্যেকেই কিছু না কিছু আনতেন আমাদের জন্য– তিলের খাজা, নারকেলের নাড়ু, মুড়কির মোয়া, ঘরের গরুর দুধ থেকে তৈরি খাঁটি ঘি… আরও কত কী! সবাই কাঁদতেন, মা-ও।
নববর্ষের সময়ে বাড়ির আঙিনায় মা-জেঠিমা-কাকিমার শাড়ি দিয়ে মঞ্চ সাজিয়ে সব ভাইবোনেরা মিলে ‘কাবুলিওয়ালা’ নাটক… সে কথা ভুলে গেলে নাকি? একবার পার্ট ভুলে কী কেলেঙ্কারি কাণ্ডটাই না ঘটিয়েছিলে তুমি! কিংবা ঝুলনের দিনে রাধাকৃষ্ণের মূর্তি দিয়ে মিছিমিছি খেলাঘর সাজানো, কালীপুজোয় মাটি-খড়-রং দিয়ে ‘দেওয়ালিঘর’ বানানো… কত মজাই না হত বলো!
তোমার মনে আছে, গরমকালে আমাদের সকালে স্কুল হত। দুপুরবেলা বাড়ির বড়রা ঘুমিয়ে পড়লে লুকিয়ে কাঠি আইসক্রিম কিনতাম, তারপর আয়নায় দেখা কার জিভ কতটা রঙিন হল- মজার এক খেলা ছিল আমাদের, তাই না! ওই আইসক্রিম খেয়ে একবার তোমার ধুম জ্বর এল, গলা ফুলে ঢোল, ব্যথায় কিছু খেতেই পারোনি কতদিন। শেষে ডাক্তারকাকার ওষুধ খেয়ে ঠিক হলে।
প্রতিবছর রথের দিন সকালে ছোটদাদু তাঁর ভাঁড় ভাঙতেন। উঠোনে আমরা ভাইবোনেরা তাঁকে ঘিরে গোল হয়ে দাঁড়াতাম। তিনি সবাইকে সমান ভাগ করে দিতেন- আট আনা, চার আনা, কুড়ি পয়সা, দশ পয়সা। তা নিয়েই একছুটে মেলায় যেতাম। ওতেই যে তখন কত কিছু কেনা যেত– খেলনা, মাটির হাঁড়িকুঁড়ি, পাঁপড় ভাজা, কাঠি গজা।
মনে পড়ে ইতুপুজোর দিন রাসমেলায় গিয়ে ফুচকা খেয়ে এসে মায়ের কাছে কী মারই না খেয়েছিলে? গালে পাঁচ আঙুলের স্পষ্ট ছাপ পড়ে গেছল। একটুও কাঁদোনি সেদিন, বরং রাগে না খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলে। গভীর রাতে মা যখন ঘুম থেকে তুলে সস্নেহে ওষুধ লাগিয়ে নিজের হাতে খাইয়ে দিয়েছিল, তুমি অঝোরে কেঁদেছিলে ব্যথায় নয়, অভিমানে।
মনে হচ্ছে এই তো সেদিনের কথা, আজও চোখ বুজলেই সব স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি! অথচ চোখ খুললেই ভোজবাজির মতো সব ভোঁ ভাঁ! তুমি কোথায় হারিয়ে গেলে কিশোরীবেলা? বড্ড ইচ্ছা করে তোমার কাছে ফিরতে, একবার যদি ছুঁতে পারতাম তোমায়!
কিন্তু ঠিকানা না রেখেই চলে গেছ তুমি। তাই তো আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখছি আজ। এ চিঠির নেই উত্তর দেওয়ার দায়। তোমার জন্য পাঠালাম একবুক ভালোবাসা।
ভালো থেকো। আজ যাই।