ছোটবেলার ট্রেন স্টেশন ছেড়েছে অনেকদিন। রিটার্ন টিকিট নেই। স্মৃতির গায়ে তবু ফেরার ডাক। সেইসব জমানো চিঠিতেই শোনো-র ডাকঘর। পড়ে-শুনে নিন।
প্রিয় ছেলেবেলা
কেমন আছ?
চিনতে পারলে না? আরে আমি ফুল। মালার দিদি! তোমার চায়নাকে মনে আছে? ওর নামটা কিন্তু ভীষণ আনকমন ছিল। তোমার মনে নেই? আমাদের সাথে ব্যায়াম ক্লাবে যেত। আমাদের পাড়ার শেষে ওদের বাড়ি ছিল। তোমার সত্যি বয়স হয়েছে। কিছু মনে রাখতে পারো না আজকাল। ভাবছ হঠাৎ ওর কথা কেন বলছি? আসলে আজ হঠাৎ পথের পাশে একটা বেগুনি কাঞ্চন ফুলের গাছ দেখতেই ওর নাম আর একটা গোপন লজ্জা, একসাথে মনে পড়ে গেল।
তুমি তো জানো, আমাদের ছোট পাড়াটাতে মসজিদতলা থেকে গঙ্গার ঘাট অব্দি সকল বাড়িগুলো প্রায় আমাদের চেনা ছিল। তবে সকলে যে আমাদের চিনতে চাইতেন, তা-ও নয়। সে যাই হোক, অরুণ জেঠুদের বাড়ির পিছনের বাড়িটাতে একটা ফলসা গাছ ছিল, শুভাশিসদা গোলাপি পদ্মফুলের গাছটাকে ভোর থেকে পাহারা দিতেন। গ্যারেজ বাড়ির দাদু সারাদুপুর পেয়ারা গাছের তলায় বসে পেপার পড়তেন! এইসবের সঙ্গে চায়নাদের বাড়িতে প্রথম দেখি বেগুনি কাঞ্চন ফুলের গাছটা। তখন পাড়াতে সকল বাড়িতে সাদা কাঞ্চন। ওদের ছোট্ট বাড়িতে ওই গাছটা ছিল, আমাদের সাদা কালো জগতের রঙিন হাতছানি! মৌমাছির প্রত্যাশায় ফুলগুলো প্রায় মুখ বাড়িয়ে থাকত বাতাসে।
মালা আর আমি কতবার ওর কাছে একটা বীজ চেয়েছি। মুখে হুঁ দেব বললেও, ওর একটা অনিচ্ছুক ভাব আমাদের চোখ এড়ায়নি। তবে আমরাও নাছোড়! একদিন ব্যায়াম ক্লাবে দেখি সোমাকে চুপিচুপি কাঞ্চনের বীজ দিচ্ছে। যাহ্ বাবা, আমরা কি বন্ধু নই? মনটা খারাপ হয়ে গেল। কিছুক্ষণ পরে মালা বলল, দিদি পেট ব্যথা করছে, বাড়ি যাচ্ছি। ছোটবেলায় পেটব্যথা ব্যপারটা তেমন বিশ্বাসযোগ্য ছিল না। যে বলত আর যে শুনত সকলের কাছেই!
আমি একটু পরে ফিরে দেখি, বারান্দার পাশে বাগানে মালা কী একটা করছে। আমি জিজ্ঞেস করতেই বলে, কিছু না।
এর মধ্যেই চায়না আর সোমা হাজির হল, আমি প্রশ্ন করার আগেই ঝাঁঝিয়ে উঠে ‘মালা কোথায়’ জিজ্ঞেস করল। সঙ্গে আরও যোগ করল, মালা কাঞ্চন গাছের বীজ পেয়েছে কি না? আমি তো অবাক, বীজ চুরির অপবাদ!
লজ্জায়, রাগে মালার দিকে তাকাতেই, ওর চোখে- বেশ করেছি ভাব!
তবু মিনমিন করে বললাম, কই না তো।
তারপর ব্যায়াম ক্লাবে চায়না আর তেমন নিয়মিত ছিল না। আর হুম, বীজটাও লজ্জার মাথা খেয়ে অঙ্কুরোদ্গম ঘটিয়েছিল আপন নিয়মে। গাছটা আমাদের ছাতের কার্নিশ ছুঁয়ে আকাশে হাত বাড়িয়ে থাকত। মালার পোষা বিড়ালটা লোডশেডিং-এর রাতগুলোতে ছাত থেকে গাছ বেয়ে নেমে এসে, জানালা দিয়ে খাটে এসে শুয়ে থাকত। তার বছর তিন-চার পরে, আমাদের বাড়ির পাশে কী একটা কাজে এসে, আমাদের বাড়িতে ফুলেল বেগুনি শামিয়ানা দেখে হতবাক চায়নার চোখে আমি বিদ্যুৎ দেখেছিলাম। ভাগ্যিস গাছের আড়াল থেকে ও আমায় দেখতে পায়নি!
আজ এই অবধিই। ভালো থেকো ছেলেবেলা, ছুঁয়ে থেকো প্লিজ।