ছোটবেলার ট্রেন স্টেশন ছেড়েছে অনেকদিন। রিটার্ন টিকিট নেই। স্মৃতির গায়ে তবু ফেরার ডাক। সেইসব জমানো চিঠিতেই শোনো-র ডাকঘর। পড়ে-শুনে নিন।
স্মৃতির ছেলেবেলা,
আশা করি ভালো আছিস। প্রায় ৩৬ বছর কেটে গেল। ২০০৫ সালে তোর সেই মফস্বল ছেড়ে চলে আসার পর আর যেতে পারলাম না। প্রথমে অনেকটা ভালো লেগেছিল এই নাগরিক জীবন, কিন্তু এখন অনেকটা হাঁপিয়ে উঠেছি। তখন যখন তোর বয়সে ছিলাম, তখন বারবার কেমন যেন মনে হত, যদি বড় হয়ে যেতে পারি তাড়াতাড়ি। তাহলে কত নিজের ইচ্ছায় কাজ করতে পারব। একটু দেরি থেকে ঘুম থেকে উঠলে মা বকবে না। স্কুলের ক্লাস ইলেভেনের দাদাদের মতো স্যাররা আমাদের খুব একটা বকাবকি করবে না। সূর্য ডুবে গেলেও বিকেলে অনেকক্ষণ ধরে মাঠে ব্যাট নিয়ে প্র্যাকটিস করব, কেউ বকবে না। কতটা মজা হবে।
ছেলেবেলা, হ্যাঁ রে ওই দিনগুলো কি আর আগের মতোই আছে? আর উঠোনের নারকেল গাছটা কি আরও অনেক বড় হয়েছে? আগের মতো নারকেল, ডাব আর হয়? এখন তো স্মার্ট ফোন আছে, একটা ছবি তুলে পাঠাস না চৈতি মাসির ফোনে আমি দেখতে পেয়ে যাব। আর একটা দারুণ খবর আছে জানিস। আমি সামনে মাসে একটা স্কুটি কিনছি। প্রকাশনার বইপত্র নিয়ে যেতে-নিয়ে আসতে ভালো অনেকটা সুবিধা হবে।
তোর মনে আছে সেই প্রবাল স্যারের কথা। নতুন সাইকেলটা কেড়ে নিয়েছিল, বাবা টানা একটা বছর মাইনে দিতে পারেনি বলে। আসলে কি জানিস তো আমি স্যারকে বলতে পারিনি আমাদের সংসারের অভাবের কথা। কোথাও যেন কষ্ট হত, যদি কিছু ভাবে। যদি খারাপ ভাবেন। বাজে ভাবেন। আমার এখানের সেই বান্ধবীর কথা তোকে সেবার জানালাম না, মৌ নামে। ওকে সেদিন এই ঘটনার কথা বলছিলাম। ও বলল, তোমার পারিবারিক অসুবিধা ছিল তাই এক বছরের জায়গায় দু’বছর মাইনে দিতে পারোনি, তো তার মানে এই নয় যে তোমরা না দিয়ে পালিয়েছ! বাড়িতে বিষয়সম্পত্তি নিয়ে দীর্ঘদিনের ঝামেলা, দোকান-পাট, বাজার সব জায়গায় তোমাদের ধারদেনা পড়ে রয়েছে এত বছর ধরে। আর তুমি যে সাইকেলটা কিনেছিলে, সেটা তোমারই এক বন্ধুর বাবার দোকান থেকে কিছু টাকা জমা দিয়ে মাসে মাসে কিস্তিতে। সেই টাকাও তো তখন মেটেনি। আমি যখন ওর কাছে থাকি, তখন এই কথাগুলো প্রায়ই হয়। জানিস তো মেয়েটা খুব ভালো। আমাকে খুব বোঝে। ঠিক তোর মতো। তুই যেমন এত দূরে চলে গিয়েও ঠিক যেমন আমাকে এতো আগলে রাখতে পারিস, স্মৃতি -ভালোবাসা আর পুরোনো ঘটনা দিয়ে,সেই সব ঘটনার কথা শুনলে খুব মন খারাপ করে বলে, একদিন ছোটবেলার সব কিছু তোমার ফিরে আসবে, দেখো।
জানি না রে, সেই সব দিন আদৌ আসবে কি-না। আর এলেও হয়তো খুব কষ্ট পাব। খুব মিস করব সব কিছু। আজ অনেকটা বড় হয়ে গেছি তো, কত কাজ, কত দায়িত্বের মাঝে এই ঘটনাগুলো, স্মৃতিগুলো কত আবছা হয়ে চোখে ভাসে। আর কোনায় জল এসে জমে।
যাক ভালো থাকিস। চিঠির উত্তর দিস।
ইতি
তোর বড়বেলা