ছোটবেলার ট্রেন স্টেশন ছেড়েছে অনেকদিন। রিটার্ন টিকিট নেই। স্মৃতির গায়ে তবু ফেরার ডাক। সেইসব জমানো চিঠিতেই শোনো-র ডাকঘর। পড়ে-শুনে নিন।
ছোটবেলা,
সেই যে তুমি ছেড়ে চলে গেলে আমায়, বড় হওয়ার একঘেয়ে বিপজ্জনক পথে ফেলে রেখে, আর তো এলে না কই? বড় হতে হতে কবে যে বুড়িয়ে গেছি, খেয়ালের ফুরসত পাইনি। এখন স্মৃতি-আতুরতার স্বপ্নিল ঘোরে ফিরে এসে আমাকে খিন্ন করে যাও, নিশিডাকের ঢঙে ফিরিয়ে নিয়ে যাও সেই প্রগাঢ় পিতামহরূপী অশথের ডালে, যেখানে পা ঝুলিয়ে বসে থাকতাম। সময়-হিসেবের চাবুক পড়ত না পিঠ জুড়ে।
গরমের দুপুরে আমবাগানের মাচায় গা এলিয়ে ঝিনুক-ছুরি আর আমকুষির পেলব সংঘাত, বর্ষার লাগাতার ধারাপাত অগ্রাহ্য করে চাকলার বিলে দাদার সঙ্গে কোঁচ হাতে কাঠমাদের দেহ ফুঁড়ে দেওয়া, শীতের খেজুর ঠিলিতে বসা হরিয়াল পাখিকে গুলতির আঘাত আবার সাঁঝ ঘোরে সেই ঠিলিতেই পাটকাঠির নল গুঁজে চোঁ-চাঁ জিরেনকাটের রসপান, পৌষল্লা বা আইরিক্ষেতের বনভোজন, ধপধপে চটাপুঁটির বাটিচচ্চড়ি, পরের জমিতে ছোলাশাক তুলতে গিযে তাড়া খাওয়া, বাড়ির ছাদরোদে মেলে দেওয়া আমসত্ত্ব চুরি করে খাওয়া, মোটা আউসভাতের গাঢ় ফ্যান, চাদর-কোঁচড়ে নাড়ু-মুড়কির বিজয়া, ইজের প্যান্টের দিনকাল, গোধূলি ছায়ায় জিতেন হাতির কাঁধে চেপে খেজুর গাছ ঝোড়া দেখতে যাওয়া আবার সেই খেজুর গাছের মাখি খাওয়া… সবই ফিরে ফিরে আসে রাতঘুমের ঘোরে; শুধু তুমি আর আসো না।
মনে পড়ে সেই চিনেমাটির ভ্যাটাখেলা বা ধুলোকাদার চু-কিত-কিত? আর মাঠপুকুরের টলটলে জল… কতই না আঁজলা ভরে খেয়েছি। পেটখারাপ? না না, সেসব তুমি হতে দাওনি কখনও। দুপুরের বাঁশঝাড়, বিষণ্ণ ঘুঘুর ডাক আর ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দের ভুতুড়ে হাজিরা। শুনশান তেঁতুলতলার পথ মাড়াতাম না এক একা। তুমি তো আমাকে ফ্লোরাইড দাওনি কখনও, দাঁত মাজার জন্য। দিয়েছিলে জামালকোটা, পিটুলির ডাল, নয়তো নিদেনপক্ষে পুকুরের বালি। বিল- পুকুরের জলে দাড়কিনি মাছের পিড়িং পিড়িং চলন কী নজরশীতল দৃশ্যই না ছিল! দুখু ঘোষের কথা মনে আছে তোমার? সাঁঝঢালে দুধের পাওলি হাতে এসে মিঠে সুরে বলেছিল, ‘তুমাদের বাড়ির সেই বকনার পেথম দুধ জ্যেঠাবাবা, অ্যাক্ষুণি দুইয়ি আনলাম। খেয়ো, সোয়াদ নাগবে।’ বেহুদ্দো, গাইঁয়া মানুষটির কী প্রাণ নিংড়ানো আবেদনা!
বর্ষার টানা টিপটিপানির দিনে বাইরের খামার বেয়ে কানকো ঠেলে ঠেলে কইমাছের উঠে আসা- ভুলে গেছ কি তুমি? আর ওই যে স্কুলে যখন দিন ফোটানো বি.সি.জি ভ্যাকসিন দিতে আসত, বাপরে বাপ, পাশের বাঁশঝাড়ে লুকিযে যেতাম। অশত্থতলায় শিবপুজোর সময় সন্ন্যাসীদলের সঙ্গে পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে ‘শিব সাজলে’ গান নেচে নেচে গেয়ে চাল-ডাল-আনাজ জোগাড় করতাম, মনে আছে? আর পুজোকালে ঘাস-বিছানায় আদুল গায়ে শুয়ে পড়ে যখন ঘরে ফিরতাম, ছ্যা ছ্যা ছ্যা, গা ভর্তি গোবর, দেখে মা তো এই মারে আর সেই মারে! বাঁচিয়ে দিত ঠাকুরদা। আরও একবার। পাড়াতুতো কাকুর কাছে বিড়ি খাওয়া শিখে এসে মায়ের পাশে কী কুক্ষণেই যে বসেছিলাম! আমার হিস্টিরিয়াপীড়িত মা মারতে মারতে পাশের পুকুরে নিয়ে গিয়েছিল, জলে চুবিয়ে মারবে বলে। সেবারেও উদ্ধারকর্তা দিল ঠাকুরদাই। তারপর আর ভুল করতাম না- বিড়ি কিংবা কাকুর খাওয়া পোড়া নাম্বার টেনের শেষাংশ খেয়ে লেবুপাতা চিবিয়ে কটুগন্ধ মেরে দিতাম। তুমি তো সেই ক্লাস ফোরেই আমাকে ধূমপায়ী করে তুলেছিলে। আর একটা ব্যাপারে তোমার বিরুদ্ধে আমার অভিযোগ দিল দুর্গামণ্ডপে যখন ঠাকুরের ভুঁড় বাঁধা একমনে দেখতাম, তখনই মাস্টারমশাই চোয়াল বাজিয়ে কান নাচাতে নাচাতে পড়াতে আসতেন। কী যে রাগ হত তখন!
ছোটবেলা, জানি সম্ভব নয়, তবুও আর একটিবার যদি ফিরে আসো, ক্ষমা চেয়ে নিতে পারি আমাদের রাখাল হাফিজকাকার কাছে। যার দুপুর খাবারের থালা থাকত গোয়ালের চালায় গোঁজা, যে থালায় আলগোছে, ছোঁয়া বাচিয়ে মা খেতে দিত। এই অপরাধমোচনের সুযোগ কি পাব, ছোটোবেলা?