ছোটবেলার ট্রেন স্টেশন ছেড়েছে অনেকদিন। রিটার্ন টিকিট নেই। স্মৃতির গায়ে তবু ফেরার ডাক। সেইসব জমানো চিঠিতেই শোনো-র ডাকঘর। পড়ে-শুনে নিন।
ডিয়ার বাবুসোনা,
কেমন আছ? তোমার এই ডাকনামটা অনেকেই জানে না। কিন্তু একটা সময় ছিল, বাড়ির সব লোক তোমায় এ-নামে সম্বোধন করত। বড়দের স্নেহ মিশে থাকত নামটার সঙ্গে। মা তোমায় কী নামে ডাকত? না, মা তোমায় আগাগোড়া বাবু বলে ডেকেছে। আর বাবা? বাবা কতটুকু তোমাকে আর ডাকখোঁজ করেছে!
মনে পড়ে যাচ্ছে অনেক কথা? সেই বাবা অনেকদিন বাড়ি আসে না, সেই দিনগুলোর কথা?
একদিন ঠাকুমার বাড়ি গেলে তুমি আর মা, বাবার খোঁজ করতে। ঠাকুমা প্রায় গরু তাড়াবার মতো তাড়িয়ে দিয়েছিল তোমাদের। মাকে বলেছিল, ‘আমার খোকার জীবনটা তোমরা নষ্ট করেছ। বেরোবে এখান থেকে নাকি ঝাঁটা আনব?’ পথে ফিরতে ফিরতে মা বলল, ‘ফুচকা খাবি?’ তখন দু-টাকায় অনেকগুলো ফুচকা দিত। তুমি তৃপ্তি করে খেলে আর মায়ের দিকে তাকালে যখন, দেখলে কী যেন পড়েছে মায়ের চোখে, যার জন্য চোখটা মায়ের লাল আর জল গড়াচ্ছে ক্রমাগত।
এমন জল খুব বেশি অবশ্য মায়ের চোখে দেখোনি তুমি। আরেকবার সেই স্কুলে কী একটা কাজে যখন বাবাকে আনতে বলেছিল আর মা বলেছিল, ‘উনি বাইরে থাকেন’, সেবারও মায়ের চোখে কিছু একটা পড়ে থাকবে। নাহলে সেদিনও ওইরকম জল কেন ছিল মায়ের চোখে?
তারপর বাবার কথা তুমি যেন আস্তে আস্তে ভুলেই গেলে। সবাই জেনে গিয়েছিল একটা কথা– ‘বাবুসোনার বাবা নেই!’ কী হয়েছে বাবার? মারা গেছেন? না, একটা স্পষ্ট উত্তর থাকত, ‘বাবা দেখে না।’ বাবা, বাবা আর বাবা। বাবার প্রসঙ্গ উঠলেই, উত্তর রেডি থাকত, ‘বাবা নেই। বাবা দেখে না।’ এমনিতে অসুবিধা হত না, কিন্তু সেই ক্লাস সিক্সে অভিজিতের বাড়ি গিয়েছিলে তুমি। দুই বন্ধু মিলে ওদের বাড়ি ঢুকলে যখন অভিজিৎ খাটে শুয়ে খবরের কাগজ পড়া ওর বাবার দিকে ‘বাবাআআআআ!’ বলে ছুটে গিয়ে বাবার গালে চুমুর পর চুমু দিয়ে ভরিয়ে তুলল… কী আশ্চর্য, তখন তোমার বুকের ভেতরটা যন্ত্রণা করছিল। খুব যন্ত্রণা।
যখন স্কুলের ফাংশনে প্রাইজ পেতে তুমি, আর দেখতে অন্য ছেলেমেয়েরা কিছুই পায়নি কিন্তু স্কুল থেকে তাদের নিতে এসেছে তাদের বাবারা, তখন ওই বুকের যন্ত্রণাটা আবার হত। ওই সময়গুলো তোমার বাবুসোনা নামটাকে তুমি খুব ঘেন্না করতে, না? তোমার মনে হত তুমি বাবুও নও, সোনাও নও। তোমার কোনও মূল্য এ-পৃথিবীতে নেই যতই তোমার নাম বাবুসোনা হোক না কেন। দাম যদি কিছু থাকত তাহলে কি তোমার বাবা হাতে করে নিয়ে ঘুরত না তোমায়? স্কুলে ছাড়তে যেত না বা নিতে আসত না? পুজোয় ঠাকুর দেখাত না? ব্যাট-বল কিনে দিত না কিংবা একটা সাইকেল? তুমি সত্যিকারের বাবুসোনা হলে তোমার বাবা কি তোমার পুরো ছোটবেলাটা জুড়ে এমন অদৃশ্য হয়ে থাকত?
কিন্তু বাবাকে যে তুমি ভুলে যাচ্ছিলে, আসলে কি ভুলছিলে নাকি ভুলে থাকার ভান করছিলে? ওইটুকু বয়সেই কেমন অভিনয়ে পটু হয়ে যাচ্ছিলে তুমি! মায়ের চোখ যদি আবার লাল হয় এ-কারণে তুমি যে সত্যি বাবাকে কত মিস করো সেটা কোনওদিন খোলসা করোনি। বাবার প্রসঙ্গই তুলতে না কখনও মায়ের কাছে। শুধু একবার ওই জেঠুদের বাড়ি কী একটা নেমন্তন্নে গিয়েছিলে একা আর বাবার সঙ্গে দেখা হয়েছিল আর বাবার সঙ্গে একজন মহিলা ছিল আর জেঠিমা চোখ মেরে বলছিল, ‘তোর নতুন মা!’, সেদিন তুমি বাড়ি এসে নিজেকে আর শক্ত রাখতে পারলে না। মাকে জড়িয়ে হাউহাউ করে সে কী কান্না! তখন বোধহয় তুমি ক্লাস সেভেনে পড়ো।
তবে সময় তো সব ভুলিয়ে দেয় গো। সব ব্যথার ওপরেই সময়ের পলি জমে আর সেই যন্ত্রণা থাকে না। বড়ো হয়ে বাবার সঙ্গে তোমার যোগাযোগ হয়েছে। তুমি বাবাকে ক্ষমা করে দিয়েছ। কারণ, বাবুসোনার ছোটবেলাটা তো আর ফিরে পাওয়া যাবে না। আর কোনওদিন অভিজিতের মতো বাবাকে জড়িয়ে চুমু দিয়ে দিয়ে ভরাতে পারবে না তুমি। বাবুসোনা নামের মতো তোমার ছোটবেলাটা কোথাও হারিয়ে গিয়েছে!