ছোটবেলার ট্রেন স্টেশন ছেড়েছে অনেকদিন। রিটার্ন টিকিট নেই। স্মৃতির গায়ে তবু ফেরার ডাক। সেইসব জমানো চিঠিতেই শোনো-র ডাকঘর। পড়ে-শুনে নিন।
প্রিয় বন্ধু,
যদি সত্যিই এই চিঠি তোর হাতে পৌঁছয়, তবে তুই নির্ঘাত এই সম্বোধন দেখে মিটিমিটি হাসছিস, আর ভাবছিস সব বাক্সপ্যাঁটরা গুছিয়ে ‘বন্ধু দেখা হবে’ গেয়ে পালিয়ে যাওয়া বেইমানটা প্রায় একযুগ পর আবার কী মতলবে! নিশ্চয়ই মনে পড়ছে যে, বন্ধুকে চিঠি লিখে এককালে পরীক্ষার খাতা ভরিয়ে ফেলতিস! কিন্তু তখন কী ভেবেছিলি, সিলেবাস আর বৃত্তি পরীক্ষার বেড়া ডিঙিয়ে একদিন তোর কাছেও এহেন চিঠি এসে পৌঁছবে, তা-ও আবার এমন কারোর কাছ থেকে, যে এই ক’-বছরে প্রাণপণে ভুলতে চেয়েছে তোর ডাকনামগুলোকে? বলা বাহুল্য, পারেনি।
যেমন ভুলতে পারেনি দরজার ফাঁক গলে দেওয়ালে দুপুর-রোদের আঁকা ট্রেনটার কথা, লুকিয়ে রাখা ম্যাগাজিনগুলোর কথা, মাঝরাতে ভুল সুরে গান গাওয়া ভবঘুরের কথা– যাদেরকে খুঁজতে বেরোনোর কথা ছিল তোর সঙ্গে। সেই মেয়েটা কিন্তু খুঁজেছিল তোকে! তার প্রতিটা নিঃশব্দ কান্নার সঙ্গে সঙ্গে তুই যখন একটু একটু করে মিলিয়ে যাচ্ছিলি, কর্পূরের মতো, তোর শেষটুকু ধরে রাখতে চেয়ে সে দুই হাত বাড়িয়ে ঝাঁপ দিয়েছিল অন্ধকূপে। স্মৃতিদের ধারাল আক্রমণ তুচ্ছ করে তোর উদ্দেশে হাঁক পাড়ার উত্তরে শুনেছিল দেওয়ালের গভীর থেকে উঠে আসা ইঁদুরের খুটখুট। নেহাতই খেয়ালবশে ছুড়ে দেওয়া নুড়িপাথরের মতো সেই ভাঙনের শব্দ, বিবর্জিতের ব্যঙ্গ হয়ে তাকে বুঝিয়েছিল যে সে তোকে এ জন্মের মতো হারিয়ে ফেলেছে। ছাপাখানার কালির মতো হাতের মুঠোয় ধুলোর দাগটুকু রেখে তাকে ফেলেই তুই বেরিয়ে পড়েছিস সেই সোজা রাস্তা ধরে, নিঝুম রাতে যার শেষমাথায় এসে দাঁড়াত বিশাল পাহাড়! কাজেই ফিসফিসিয়ে ‘আবার আমাদের দেখা হবে’ বলে পিছন ফেরা ছাড়া আর কিছুই করার ছিল না তার। প্রত্যুত্তরে উঠে এসেছিল পরিত্যক্ত চিমনি-ঘরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে খেলে যাওয়া হাওয়ার দীর্ঘশ্বাস।
নিল গেইম্যানের গল্পের সেই অনামী বালকের মতো ভাগ্য আমাদের কারোরই নয়, তাই কালের সমুদ্রে ঝাঁপ দিয়ে তোকে বলতে পারিনি যে, তোর অবর্তমানে শীতের রোদের রং হয়ে যায় শুকিয়ে যাওয়া শিউলিফুলের মতো, দলছুট পাখির ছানা কিংবা স্কুলের পশ্চিম প্রান্তের প্রায় ভুলতে বসা ক্লাসরুমের মতো নিঃসঙ্গ, অবক্ষয়ী দুপুর সেই রোদের জাল পুঁইমাচায়, চৌবাচ্চার কনকনে জলে, পুরু হয়ে ওঠা শ্যাওলার দেওয়ালে বিছিয়ে শুষে নিতে থাকে মায়ার শেষ বিন্দুটুকু, দেরাজের ন্যাপথালিন-ওষুধ মেশানো কাঠের গন্ধটুকু, ফেলে রেখে যায় শুধু হাড়হিম শৈত্যকে। গ্রীষ্ম আসতে-না-আসতে কালো হয়ে যাওয়া কুলগাছের কাঠামোটা আর সেরে ওঠে না। তুই জানতেও পারলি না যে তুই চলে যাওয়ার পর থেকে নিষিদ্ধ চিলেকোঠায় বন্দি খোক্কসগুলোর রাতবিরেতে আর চোখ জ্বলে না, তারা কেবল উঁকিঝুঁকি মেরে খুঁজে চলে একটা ছিঁচকাঁদুনেকে, সম্ভাব্য সাদা ফুলের কুঁড়িদের গুনতে গুনতে হঠাৎই যার পায়ের ছাপ অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল একদিন।
এই দেখ, লিখতে লিখতে কখন যে জানলার বাইরেটা নীলচে হতে শুরু করেছে, বুঝতেই পারিনি! নীল পাহাড়ের ওপারে কি শেষমেশ দেখা হয়েছিল রোদরঙা ট্রেনটার, আর ওই মাতাল লোকটার সঙ্গে? শিস দিতে দিতে এরা দু’জনেই প্রতিরাতে ফিরত কোথায়, তা কি জানতে পেরেছিস? সিনেমার পাতাগুলোকেই বা কোন্ পথে শেষবারের মতো ধুলো ওড়াতে দেখা গিয়েছিল? সব মন্ত্র কি তারা ভুলেই গেল এতদিনে? জানাতে ভুলিস না!
আর মনে রাখিস,আবার আমাদের দেখা হবে। হবেই!
ইতি–
তোর পলাতক বন্ধু