ছোটবেলার ট্রেন স্টেশন ছেড়েছে অনেকদিন। রিটার্ন টিকিট নেই। স্মৃতির গায়ে তবু ফেরার ডাক। সেইসব জমানো চিঠিতেই শোনো-র ডাকঘর। পড়ে-শুনে নিন।
প্রিয় ছোটবেলা,
বহুদিন তোমাকে মনে করার সময় পাইনি। শীত এখন আগের মতো কাঁপিয়ে ঝাঁপিয়ে আসে না এখানে। তবু শীতের ফুলকপি,বাঁধাকপি,পিঁয়াজকলি,মটরশুঁটি বাজারে চলে এসেছে। মনে আছে, বাবার হাত ধরে যখন বাজারে যেতাম
আমার ভীষণ সবজিওয়ালা হতে ইচ্ছে করত। ব্যপারটা খুব মজার মনে হত। দাঁড়িপাল্লায় মেপে মেপে সবজি
দেওয়া। গুনে গুনে বকফুল দেওয়া। কতবার ভেবেছি, একদিন সবজিকাকুকে বলব একদিনের জন্য আমায় ‘তুমি’ হতে
দেবে?
মায়ের সঙ্গে কোনও ছোটবেলায় কেরোসিন আনতে যেতাম। কেমন লিটারের মগে করে মেপে ঠিক দু’লিটার করে
কেরোসিন দিত মহাদেবকাকু। মহাদেবকাকুর কাজটাও খুব ভালো লাগত আমার। আমি ঘরে কুয়োতলায় বসে বালতি
থেকে মগে করে জল নিয়ে মিছিমিছি কেরোসিন দেওয়ার খেলা খেলতাম। তখন আমি হয়ে যেতাম মহাদেবকাকু।
বছরে দু’বার নারকেল গাছ পরিষ্কার করার লোক আসত। কী সুন্দর কোমরে কাটারি গুঁজে তরতর করে নারকেল
গাছে উঠে বাকোল পরিষ্কার করে ডাব পেড়ে নিয়ে নিচে নেমে আসত। আমার মনে হত, এই অদ্ভুত খেলাটা শিখতেই
হবে।
ছোটবেলা, মনে আছে দীপাদের বাড়ির পাশের পানাপুকুরটা! কত কচুরিপানা ফুল ফুটত! অদ্ভুত সেই বেগুনিরং
এখনও চোখে লেগে আছে।কত রকমের ফড়িং উড়ে বেড়াত। কাঠফড়িং,বাঘফড়িং,গঙ্গাফড়িং,সবুজ রঙের ফড়িং
এর কী নাম ছিল মনে পড়ছে না। তবে সব থেকে বোকা ফড়িং ছিল কাঠফড়িং। কী সহজে ধরা দিত। কিন্তু আমার
লাল রঙের গঙ্গাফড়িং হওয়ার খুব শখ ছিল। কিছুতেই ধরা দিত না। কুটুস করে কামড়ে পালাত।
বাবার সঙ্গে মর্নিংওয়াকে গেলে বাবা কতসব অজানা জায়গায় নিয়ে যেত। অচেনা মাঠ, জঙ্গল পেরিয়ে একদিন
একটা পুরনো চার্চ আবিস্কার করেছিলাম। দরজা বন্ধ ছিল। কিন্তু বাগান খোলা ছিল। সেখানে কত রঙের
পাখি। ইচ্ছে হলেই উড়ে কখনও বসছে কৃষ্ণচূড়ায় তো কখনও কামিনী গাছের ডালে। সেদিন ভেবেছিলাম পাখি হলে
কী ভালোই না হত! বাসে-ট্রেনে না চড়েই কত দূর দেশে যেতে পারতাম।
ছোটবেলা, তোমার সেই ‘জিনসেন’ কন্যা বইটার কথা মনে আছে? যে তার বন্ধুর জন্য ওষুধ আনতে কত বিপদ বাধা
পেরিয়ে পৌঁছে যায় বৈদ্যর কাছে। আমার তখন জিনসেন কন্যা হবার খুব ইচ্ছে হয়েছিল। রুশদেশের উপকথার ব্যাঙ
রাজকুমারী ভাসিলিসা কী ভালো মেয়ে! আমি তখন স্বপ্নে রাজকুমারী ভাসিলিসা হয়ে ঘোড়া ছোটাতাম।
পুজোর সময় ঢাকিকাকুর সঙ্গে তার ছোট ছেলে আসত। সে কাঁসর বাজাত। আর রাতে আমাদের বাড়ির বারান্দায়
ঘুমাত। আমি তার গ্রামের কথা শুনতাম। নদীর পারে কাশফুলের জঙ্গলের কথা শুনতাম। সেখানে নাকি লুকোচুরি
খেলা যায়। সারা গ্রামে একটাই দুর্গাপুজো। খুব আনন্দ হয়। আগে দেখতে পেত কিন্তু এখন পেটের টানে
শহরে চলে আসতে হয়। আমার সেই অজানা গ্রামের দুর্গাপুজো দেখার ভীষণ ইচ্ছে হয়েছিল। একদিন তার কাঁসরটা
নিয়ে আমি বাজাতে শুরু করলে, সে এসে বকা দেয়। ‘হচ্ছে না’ বলে কেড়ে নেয়। আমি কাঁদো-কাঁদো ভাবে বলেছিলাম, ‘তুই আমায় তোদের গ্রামে নিয়ে যাবি? কাঁসর বাজানো শিখিয়ে দিবি? তার বদলে আমার ডল-পুতুল দেব। চোখ বন্ধ
করে, চোখ খোলে। হাত পা নাড়ানো যায়। মুখের চুসি কেড়ে নিলে কাঁদে। পুতুলটা আমায় দাদু দিয়েছিল। সে নেড়েচেড়ে
দেখেও ছিল পুতুলটা।’ কিন্তু রাজি হয়নি। তার বোন নাকি জ্যান্ত পুতুল। তবে সে আমায় কাঁসর বাজানো
শিখিয়েছিল। কিন্তু গ্রামে নিয়ে যেতে রাজি হয়নি।
দাদু পুকুরে জাল ফেলে মাছ ধরত। কী মজা যে লাগত! কতবার বলেছিলাম কৌশলটা শিখিয়ে দিতে। কিন্তু শেখায়নি। দাদু বলত, ‘মাইয়া মানুষ শ্যেষে জেলে হইব?’ জেলে হলে ক্ষতি কী! কী সুন্দর রাতে নৌকোয় পাল তুলে নদীতে
নয়তো সাগরে পাড়ি দেব। ভোরবেলায় মাছ বোঝাই জাল নিয়ে ফিরব।
কিন্তু মাছ ধরা আমার শেখা হয়নি। এখন বড়বেলাকে অনুপমের সেই গান শোনাই– ‘সব পেলে নষ্ট জীবন।’
ইতি
ছদ্মবেশী বড়বেলা