ছোটবেলার ট্রেন স্টেশন ছেড়েছে অনেকদিন। রিটার্ন টিকিট নেই। স্মৃতির গায়ে তবু ফেরার ডাক। সেইসব জমানো চিঠিতেই শোনো-র ডাকঘর। পড়ে-শুনে নিন।
স্নেহের নিন্নিবুড়ি,
তোমাকে দেখি না আজ অনেক বছর। তবু খুঁজে চলি। আমার আকাশ জড়ানো, নদীর জল মাখানো ছোটবেলাটা যে পাওয়াই হতো না তুমি না থাকলে। আমাদের তিস্তার পার, চিকচিকে সাদা বালি, কালো মেঘের সারি, কুয়াশার ধূসর ভারী পর্দা– এইসব লেগে আছে তোমার হৃদয়ের আনাচে কানাচে। শহর ছেড়ে চলে যাওয়া তিস্তাবুড়ির মতোই তুমিও কোথায় চলে গেলে নিন্নিবুড়ি?
সেই যে পাকা-পাকা কথা বলা, কিছুতেই হার না-মানা, ৪৫ রোল নম্বরের পাকা বাচ্চাটা, যাকে কিনা ক্লাসের কোনও সহপাঠীই নিজের সঙ্গে বসতে দিত না! যে কথায় কথায় তর্ক করে প্রায়ই শাস্তি পেয়ে দাঁড়াত ক্লাসের বাইরে অথচ এইসবে তার নবীন হৃদয়ে কয়েকটা আলতো মোচড় ছাড়া আর কিছুই অনুভব হত না! সে বাড়ি এসে এই সব ভুলে ঢুকে যেত কল্পনার পাহাড়ে। সেইখানে ঘাসফুল তুলে ছু্ড়ে ছুড়ে ফেলত পথে, কোনও অজানা রাজপুত্তুরের অপেক্ষায়! যে রাজপুত্তুর টিভির শাহরুখ খানের চেয়েও অনেক স্মার্ট। যার আলিঙ্গনে ভাঙাবাড়িটা জুড়ে যাবে নিন্নিবুড়ির! শুধু কী তাই!
নিন্নিবুড়ি প্রায়ই স্বপ্নে দেখত একটা ঝরনার দেশ। সেখানে চকোলেটের নদী, রামধনুর বাড়ি, বিগ-বাবলের গাছ। সেই বাড়ির গোল খাটে ‘ওম শান্তি ওম’ সিনেমার ওমের মতোই তার পুনর্জন্ম হবে। ঘুম ভেঙেই দেওয়াল থেকে কিছুটা রামধনু তুলে গায়ে মেখে নেবে সে। তারপর মৃগয়া করতে বের হবে চকোলেট রাজ্যে। খরগোশের পিঠে চেপে বহুদূর যাবে। মৌমাছিদের সঙ্গে যুদ্ধ করে মৌচাকের ভিতরে ঢুকবে, দেখবে রানি মৌমাছির অবাধ বিচরণ। রানি মৌমাছিই নিন্নিকে শেখাবে, কেতাদুরস্ত চলাফেরার নিয়মকানুন আর আভিজাত্যবোধ। ফিরে এসে চকোলেটের ঝরনা থেকে বেশ খানিকটা চকোলেট খেয়ে জেমসের মুকুট হাতে আবার অপেক্ষা করবে সে রাজপুত্তুরের।
এরই মধ্যে বিকেল হয়ে আসবে। বিকেল মানেই মায়ের বাড়ি ফেরার সময়। এবার করলার তীরে বাবুঘাটে গিয়ে দাঁড়াতে হবে। সংকীর্ণ নদীর ওপারেই মায়ের অফিস। নিন্নির মা-টা আবার চিরকালই ভোলাভালা, তালজ্ঞান নাই। তাই নিন্নি নিজেই দায়িত্ব নিয়েছে মাকে রক্ষা করার। রবি ঠাকুরের কবিতার বীরপুরুষের মতো তরোয়াল হাতে নিন্নি দাঁড়িয়ে থাকে আর বিপদ বুঝলেই এগিয়ে যায় মায়ের অফিসের দিকে। পাহারা দিয়ে, শক্ত করে মায়ের হাত ধরে বাড়ি ফিরিয়ে আনে। কেন যেন ওর মনে হত, মা আসলে বাড়ি ফিরতে চায় না। বাড়ির এই অন্ধকারমাখা ঘরগুলোয় মা যেন বড়ো বেমানান। তাই বীরপুরুষের অভিনয় করে রোজ ফিরিয়ে আনতে হয় মাকে। মাকে ছাড়া এই বাড়িতে নিন্নি থাকতে পারবে না যে।
আর এই বাড়ি ছেড়ে চলে গেলে টিভি দেখবে কী করে? ডিসকভারি চ্যানেলে লুকিয়ে লুকিয়ে ‘আ বেবি স্টোরি’ আর দেখা হবে না। জানা হবে না কী করে মায়ের পেটের ভিতর থেকে সাপ-ব্যাঙ-কুকুর-মানুষের বাচ্চারা বাইরে বেরিয়ে আসে। ‘টম অ্যান্ড জেরি’-টাও মন্দ নয়। ‘থমাস দ্য ট্রেন’-টা বোরিং। ট্রেনেরা যে শুধু কু-কু করে আওয়াজ দিয়ে দৌঁড়ায় আর কারশেডে ধুলো মেখে দাঁড়িয়ে থাকে, আসলে কেউ কারুরু সঙ্গে মোটেই কোনো কথা বলে না, একথা নিন্নি ব্যাঙ্গালোর যাওয়ার সময় প্রথম জেনেছে।
বাবাকে চিকিৎসা করাতে সেই তিন বছর বয়সে থেকে ব্যাঙ্গালোর যায় নিন্নি। কিন্তু বাবা কিছুতেই সুস্থ হয় না। রোজ বাবার দেহের ভার নিজের হাত দুটোয় অনুভব করে ও। বাবাকে দেখলেই মনে হয় একটা ভীষণ ভারী, কালো কুচকুচে মেঘ ড্রয়িংরুমে বসে আছে। এই বুঝি ফেটে সারা বাড়িটাকে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। কিন্তু মেঘটা ফাটে না, বাবাও কথা বলে না। শুধু বসে থাকে আর ঘুমায়। খৈনি ডলে। ইশ! কী বাজে ওই খৈনির গন্ধটা! কী তেল-চিটচিটে বাবার লুঙ্গিটা! বাবাকে দেখলেই নিন্নির মনে বন্যার আশঙ্কা তৈরি হয়। শুধু যখন জ্বর আসে তখন ভাল লাগে বাবাকে। জ্বর এলে বাবা তখন শরৎচন্দ্রের মহেশের গল্প শোনায়। ‘লেডি উইথ দ্য ল্যাম্প” পড়ায়৷ বলে, ‘মাইলস টু গো বিফোর ইউ স্লিপ’। ওমনি নিন্নি ভাবে অনেক বড় হবে সে। দূরে যাবে অনেক। তারপর এসে গল্প বলবে বাবাকে এক দুর্ধর্ষ যাত্রার। কত ছবি, কত রং নিয়ে এগোয় বাবার দিকে। গিয়ে দেখে, বাবা আবার ঘুমায়। নয়তো দূর-দূর করে তাড়িয়ে দেয় ঘর থেকে। নিন্নি দরজা আগলে রাখে। ভাবে, যদি বাবা আর বাইরে না বের হয়! ভয়ে রাত জাগে একা। ভয়ে ভয়ে টিউশনে যায়। অঙ্কের টিউশন। সেখানে আরও ভয়! নিন্নিবুড়ি অঙ্কটা তোমার আর শেখা হল না। অঙ্কে তুমি বড়ই বেহিসাবি।
সে বেহিসাবের ছাপ পড়েছে বড়বেলায়। পড়েছে তোমার সমস্ত শরীরে। সে বেহিসাব বাকি জীবন ‘অনন্যা’ হয়ে তাড়া করে বেড়ায়। ছোটবেলা আর বড়বেলার মাঝের অদৃশ্য সেতুটাকে বহুবার খুঁজেও পাওয়া যায়নি। তবুও নিন্নি আর অনন্যা মাঝেমধ্যেই সেই সেতুটাতে পাশাপাশি এসে দাঁড়ায়। সেতুটা দেখতে হয়তো অনেকটা যাদবপুরের আর্টস ফ্যাকাল্টির ঝিলের সেতুটার মতোই। ধোঁয়ার নাভিশ্বাসে ভাঙাচোরা, খানাখন্দে ঝুপ করে জলে পড়ে যাওয়ার ভয়। তবু ওই সেতুটা টানে আমাদের। ওর মাঝে দাঁড়িয়ে হয়তো কিছুটা ফিরে পাওয়া যায় সেই সব, যা কিছু ভাসিয়ে দিয়েছি আমরা শীর্ণতোয়া করলার জলে, যা কিছু মিশিয়ে দিয়েছি বর্ষার ঘনঘোর তিস্তায়। সেই সব জল বৃষ্টি হয়ে মিশেছে অন্য সব জলে। জলের কাছে গেলে আমি নিন্নিকে দেখতে পাই।
কলকাতার থই থই ভিড়ে উবর বাইকের প্রিভিলেজে বাসে চড়তেই পারি না। আসলে বাসে চড়লে নিন্নিকে মনে পড়ে যায়। একা দাঁড়িয়ে থাকা চারফুট উচ্চতার নিন্নি বাসের অতো উঁচু হ্যান্ডেলে কী করে হাত পায়! উঁচু উঁচু মাথার ভিড়ে বাইরেটা একটুও দেখা যায় না। সেখানেই অনন্যা নিন্নির ভিতরে হারিয়ে যায়। যত বড় হই তত গ্রাস করে নিন্নি আমায়। যত বড় হই তত নিন্নির সব ভয় ফিরে ফিরে পাই। নিন্নিবুড়ি, তুমি কি আমার প্রেতাত্মা হলে? পুরানো ভয়ে জড়িয়ে, আগলে ধরে রাখো কেন আমায়? কেন তুমি বড় হতে দাও না? কেন তোমার বুকপকেটটুকুই আমার আকাশ হবে? আর যদি তাই হয় তোমার সিদ্ধান্ত, তবে তোমার ওই বাখারির তলোয়ারটাও আমাকে দাও। জটায়ুর মতো ডানা দিয়ে যেভাবে আগলে রাখতে তুমি আমায় সেই ছোটোবেলায়, সেই ডানাদুটোও আমায় দাও। এসো আমরা একসঙ্গে পার করি লোকালয়ের এই অকরুণ কারাগার। এসো আবার আমরা দুজনে মিলে প্রবল বরষায় রামধনু খুঁজে বেড়াই।