মহা সমারোহে উদ্বোধন হল রাম মন্দিরের। দেশের ইতিহাসে নানা প্রেক্ষিতেই এ-এক স্মরণীয় দিন। ঠিক তার আগে কেমন ছিল অয্যোধ্যার অবস্থা? দশদিকের ছবিগুলোই বা কেমন ছিল? আর সাধারণ মানুষের মুখে মুখে ফিরল কোন আলোচনা।
দিন পাঁচেক অযোধ্যাবাসের সেই অভিজ্ঞতাই তুলে ধরলেন সুলয়া সিংহ।
ছবিতে অযোধ্যা ধরে রাখলেন, শুভ্ররূপ বন্দ্যোপাধ্যায়।
আসছেন তিনি আসছেন।…
হঠাৎ রাস্তা জুড়ে বেজায় তৎপরতা। প্রহরারত সেনার উঁচিয়ে থাকা বন্দুক। হতচকিত সাধারণ মানুষ। আসছেন কে? কে আবার স্বয়ং রামলালা! আমরা, যারা বাইরে থেকে গিয়েছি খবরের সন্ধানে, তাঁদের সকলেরই খবরেন্দ্রিয় সজাগ হয়ে উঠল। মোদ্দা কথা হল, জেড প্লাস নিরাপত্তার ঘেরাটোপে রামলালার কনভয় হনুমানগড়ি ঢুকছে। আমরা তখন হনুমানগড়ির সামনে একটা মিষ্টির দোকানে দাঁড়িয়ে। আচমকাই মোটা দড়ির ব্যারিকেড বানিয়ে পথচারীদের আটকে দেওয়া হল। সেনার বন্দুক তাক করা সাধারণের দিকে।
কেন আটকানো হয়েছে বুঝতে না পেরে এক উৎসুক পথচারী এদিক-ওদিক তাকিয়ে জিজ্ঞেস করছিলেন, কী হয়েছে? এক স্থানীয় পুলিশ আধিকারিক বললেন, “আপনারা সৌভাগ্যবান যে রামলালার হনুমানগড়িতে আসার সাক্ষী থাকছেন।” আসলে রামের আগমনকে ঘিরে গোটা অযোধ্যাকেই সৌভাগ্যের চাদরে মুড়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল। অবশ্য চাদরের নিচে কি সবার ঠাঁই হয়েছে? সে প্রশ্ন সরযূর তীরে হাওয়ায় হাওয়ায় মিলিয়ে গেল।
আসলে রাম মন্দির উদ্বোধনের আগে অযোধ্যায় দিন পাঁচেক কাটানো একটা লাইফটাইম অভিজ্ঞতাই বটে। ‘মন্দির ওহি বানায়েঙ্গে’ থেকে ‘মন্দির ওহি বন গায়া’- এই বিরাট সময়পর্বের তুঙ্গ মুহূর্তের সাক্ষী থাকা। প্রেক্ষাপটে থেকে গিয়েছে বিতর্কের শ’পাঁচেক বছরের ইতিহাস। সব বিতর্কের অবসান ঘটিয়ে রামের ‘ঘর ওয়াপসিতে’ যে অযোধ্যাজুড়ে ভক্তদের উন্মাদনার পারদ চড়বে, তা অযোধ্যা না গিয়েও আন্দাজ করা যায়। কিন্তু সেই উন্মাদনা আর ভক্তি কখন যে খানিকটা পাগলামো, তেজ আর আত্মাভিমানে পরিণত হয়েছে, তা রামজন্মভূমিতে পা রাখতে তবেই টের পাওয়া গেল।
রামকে ঘিরে গোটা অযোধ্যা জুড়ে কেবলই দৃশ্যের জন্ম।
খবরের দুনিয়ার মানুষ, অতএব রামজন্মভূমিতে গিয়েই খবর খোঁজার ভার পড়ল কাঁধে। নেহাত সহজ কাজ নয়। কারণ প্রাণপ্রতিষ্ঠার অনুষ্ঠানকে ঘিরে গত কয়েকমাস ধরে রীতিমতো মহাযজ্ঞ চলছে। খবরে খবরে ছয়লাপ চতুর্দিক। ফলে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে যাবতীয় আটঘাট বেঁধেই রেখেছিলাম। কী খবর করা যায়, কোন দিকে ফোকাস করব, কার সঙ্গে যোগাযোগ করব, ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু কোথায় কী! রামলালার প্রমোশনের সব ব্যবস্থা করে রেখেছে শ্রীরাম জন্মভূমি তীর্থক্ষেত্র ট্রাস্ট। মানে খবরের অভাবে হাঁসফাঁস করার পরিস্থিতি তৈরি হবে না। আর শহরজুড়ে তো রামভক্তদের নানা কীর্তিকলাপ রয়েইছে। বাইরে থেকে আসা ভক্তরা তো আছেনই, কিন্তু আমার চোখ টানছিল স্থানীয়দের কথাবার্তা, চিন্তাধারা, আশা-আকাঙ্ক্ষার বিষয়টি। কয়েকটা উদাহরণ দিলে একটা ধারণা পাওয়া যাবে।
কাকতালীয়ই হবে বোধহয়, নইলে এমন সমাপতন হয় কী করে! অযোধ্যায় আমাদের গাড়ির চালকের নামও রাম। রামজি তিওয়ারি। আমাদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে মাঝেসাঝেই গেয়ে উঠেছেন, ‘এক হি নাড়া, এক হি নাম। জয় শ্রীরাম, জয় শ্রীরাম।’ তারপর মনে মনে কীসব মন্ত্র পড়ছেন। আবার সরযূর ঘাটের এক মন্দিরে এক স্কুল পড়ুয়ার সঙ্গে এটা-ওটা কথা হচ্ছিল, হঠাৎই রীতিমতো জোর গলায় নিয়ে বলে উঠল, “যারা রামের অস্তিত্ব অস্বীকার করে, রাম ছিলেন বলে মানে না, তাদের পরিচয় নিয়ে সন্দেহ আছে।”
রাম ফেরার আনুষ্ঠানিক আয়োজন তো পাকা। তা রামের দৌলতে লক্ষ্মীলাভের বন্দোবস্ত কতখানি পাকা হল? উদর-দেবতাও মাঝেমধ্যেই নিজের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে। মন্দির চত্বরের কাছাকাছি ভালো কচুরির সন্ধান পেয়ে তাই এগিয়ে গেলাম। জানতে চাইলাম, রামলালা আসায় নিশ্চয়ই ব্যবসা ফুলে-ফেঁপে উঠেছে? একরাশ হতাশা নিয়ে বললেন, “মন্দির তৈরির জন্য অনেকদিন ধরেই অনেক রাস্তাঘাট বন্ধ। ফলে এদিকটায় খুব বেশি লোক আসছে না। আগে তো ১২টা বাজলে সব খাবার শেষ হয়ে যেত। এখন আপনারা আড়াইটে-তে এসেও কচুরি পেলেন। তবে রামলালা যেমনটা চাইবেন। আশা করি মন্দির খুললে আবার অনেক লোক আসবে।”
রামের কৃপা, রাম যা চাইবেন তাই হবে। রামের জন্য এতটুকু করাই যায়। রামনামের এমনই ‘পারফিউম’ গায়ে লাগিয়েছে অযোধ্যা। এদেশে নাকি ক্রিকেট ধর্ম। গত বছর দেশের মাটিতে যখন ওয়ানডে বিশ্বকাপের আসর বসল, তখনও এমন উৎসবের আমেজ চোখে পড়েনি। জেন্টলম্যান্স গেমকে বলে বলে ১০ গোল দিয়েছেন পাঁচ বছরের রামলালা। এমনকী শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নারী নিরাপত্তার মতো বিষয়গুলোও ক্লিন বোল্ড। ধর্মের জন্য মানুষ নাকি মানুষের জন্য ধর্ম- সবকিছু যেন কেমন গুলিয়ে যায়। নাকি নৈপুণ্যের সঙ্গে গুলিয়ে দেওয়া হচ্ছে! প্রশ্নগুলো সহজ, আর কে না জানে, উত্তরও তো জানা।
শাস্ত্রমতে আমরা যে আচার-নিয়ম পালন করি, তা তো কারও না কারও রচনা করাই। তেমনই যেন রামরাজত্বের পুনঃস্থাপনের কাহিনিও অতি সূক্ষহাতে লিখেছেন কেউ? যে-রামায়ণে রামের নাম যদি মোদি এবং লক্ষ্মণের পরিচয় যোগী হতেই পারে। বিরোধী ‘রাবণ’ বধের প্রতিজ্ঞা নিয়ে যাঁরা অতি কৌশলে সাজানো অযোধ্যায় ভোটের প্রচারটাও সেরে ফেললেন। হ্যাঁ, ছোটখাটো, রুখাসুখা অযোধ্যা যে ভোলবদলে গ্ল্যামারাস মডেল হয়ে উঠেছে, তা অস্বীকারের জায়গা নেই। তবে এই মডেলে তো সকলের মন মজছে না। মন্দির, বিমানবন্দর তৈরির স্বার্থে ভিটে-মাটিহারারা গলা নামিয়ে কথা বলছে। বলছে, রাম তো আমাদের কথা ভাবল না। আমাদের তো বেঁচে থাকার লড়াই আরও কঠিন হল। সৌভাগ্যের চাদর আমাদের মাথায় কই!
কিছু প্রশ্ন থেকেই যায়। অযোধ্যা জুড়ে অজস্র মানুষ। হরেক কিসিমের মানুষ। নানা আয়োজনের ঘটা। তবে, এসবের মধ্যেই চুপিসারে কেউ একজন যেন ঘুরে বেড়াচ্ছে। যাকে সহজে দেখা যায় না, তবে তার অস্তিত্ব টের পাওয়া যায়।
হয়তো আগামী দিনে সেই অদৃশ্য-ই দৃশ্যমান হয়ে উঠবে। আমরা তাকে চিনব নির্বাচন নামে।