হাজার রকম ব্যস্ততায় গল্প পড়ার সময় মিলছে না কিছুতেই! অবসর পেলে তাই গল্প শুনতে ইচ্ছে করে? আপনার জন্য হপ্তাশেষের গল্প নিয়ে হাজির ‘সংবাদ প্রতিদিন শোনো’।
ছেলের হাত থেকে ফোনটা নিয়ে সুলতা বলেছিল, কত দাম রে?
আগে বলো কার সঙ্গে কথা বলবে? -বলাই হাসছিল।
তোর সঙ্গে। এই তো চলে যাবি কোথায় কে জানে! -সুলতার গলা ধরে উঠেছিল।
তোমার কাজের বাড়িতে দিও না নম্বর। খুব জ্বালাবে দেখবে।
আজ সেই ফোনই হাতে নিয়ে বসে সুলতা। অবিনাশ কাল রাতে এসে খবর দিয়েছে বলাইদের সোনার কারখানায় আগুন ধরে গেছে। ভেতরে কুড়িজন ছিল। কে কে ছিল, এখনও জানা যায়নি।
সুলতা ভাত মুখে তুলছিল তখন সবে। বুকের ভেতরটায় যেন হা হা করে বাতাস ঢুকে গেল।
-ছেলে কোনও ফোন করেছে বউদি?
না তো। দু-তিন দিন অন্তর করে। রবিবার করেছিল। আজ মঙ্গল। তখুনি ফোনটা বার করে নাম্বারটা ধরার চেষ্টা করল। বাজছে না। বাজেনি সারারাত। সুইচড অফ শুনে শুনেও ক্লান্তি আসেনি সুলতার। একবার ওই যন্ত্রের আওয়াজের পরেও কথা বলতে শুরু করেছিল কী সব।
সকাল হতে শোভা এক কাপ চা দিয়ে বলল, খেয়ে কাজে যা। খারাপ কিছু নিশ্চয়ই হয়নি। হয়তো ফোনটা খারাপ হয়ে গেছে। মাথা ঠান্ডা রাখ।
সুলতা ভাবছিল কোথায় সেই মঙ্গলকোট জায়গাটা? সে একাই চলে যাবে? অবিনাশকে বলবে সঙ্গে যেতে? ওরই চেনাজানা একজন পঞ্চাশ হাজার টাকা নিয়ে কাজটা দিয়েছিল।
একবার ফোনটা বেজে উঠল। বলাই নয়। লোন দিতে চায় ব্যাংক।
কাজে গেল না সুলতা। বউদি খুব রাগ করবে। ওদের মেয়ে আজ বিদেশে চলে যাবে। আজই কামাই দিল। কিন্তু মন যে নড়ছে না। মনে হচ্ছে এই বুঝি ও কাজে বেরোলেই বলাইটা ফোন করবে। মাকে পাবে না। অবশ্য ফোন নিয়েই যেতে পারে।
কত ভাড়া মঙ্গলকোটের? আগাম মাইনে চাইবে?
ভাবতে ভাবতে বেলা বেড়ে যায়। সুলতা অপেক্ষায় বসেই থাকে। আরও দুবার অমনি ফোন এল। অচেনা নাম্বার। সুলতা আর ধরেনি। ব্যাংকের লোন সে কবে চেয়েছে?
গলিটায় গাড়ি ঢোকে না এ আক্ষেপ বহু বছর ধরে করে চলেছে অমৃতা। কিন্তু আজ কোনও আক্ষেপ নেই। বরং গলিটা সরু বলেই যেন অমৃতার মাটিতে পা পড়ছে না। ইউনিভার্সিটি অফ শিকাগোয় যাচ্ছে আজ মিতুল, অমৃতার মেয়ে। কংক্রিট ঢালা গলিটার বুকে ঘর্ঘর শব্দ তুলে ওদের সঙ্গে যাচ্ছে তিনটে স্যুটকেস। দুটো চেক ইন, একটা কেবিন। অমৃতা একটু জোরে বলল, মিতু, এয়ারপোর্টে তো জল নিয়ে ঢুকতে দেবে না, না?
মিতুল হাসল। সিকিওরিটি চেকিং-এ আটকাবে মা। জল দরকার নেই। তেষ্টা পেলে ভেতরে খেয়ে নেব কিনে।
কিনে খাবে সে কথা অমৃতাও জানে। তবু বলল একটু গলা তুলে। গলির সকলেই জানে মিতুল শিকাগো যাচ্ছে, কিন্তু বারান্দা বা জানলায় কেউ নেই এখন। তাই একটু গলা চড়িয়ে বলা। লোকে দেখুক একবার এসে, এই আর কি। তপন একবার বলল, আজকাল এ দেশ থেকে বহু ছেলেমেয়েই বিদেশে পড়তে যায়। অমৃতা ঠান্ডা গলায় বলেছে, এ দেশ থেকে যেতে পারে, কিন্তু এই গলি থেকে মিতুই আমার প্রথম।
তপন আর কিছু বলে না। মনটা তার এমনিতেই বিষাদগ্রস্ত। একটামাত্র মেয়ে, বাড়ি মাতিয়ে রাখত। অমৃতার মতো অত কড়া ধাত নয় তার। বাথরুমে গিয়ে চোখ মুছে আসছে কাল থেকেই। অমৃতার সামনে চোখ থেকে জল পড়লে আর রক্ষা নেই।
ট্যাক্সিতে ওঠার সময় অমৃতা বলল, ঘুরে ওঠ মিতু। বাঁ পা আগে দিবি গাড়িতে।
মিতুল হেসে ফেলে। বলে, ওঠার আবার ডান বাঁ কী?
যা বলছি শোন, বলতে বলতে অমৃতা ড্রাইভারকেও ধমকায়, আরে ডিকিটা খুলবেন তো নাকি সুটকেস কোলে নিয়ে বসব আমরা?
তপন সামনে বসে ঘুরে ঘুরে তাকায়। কতদূরে যাচ্ছে মেয়েটা। পারবে তো ঠিক সব সামলে থাকতে? কদিন আগে অমৃতা এই কথা শুনে বকুনি দিয়েছে। ওই বয়সে অমৃতা নিজে তো শ্বশুরবাড়ি চলে এসেছিল, নাকি?
তপনও তর্ক করেছিল বটে। শ্বশুরবাড়িতে আরও কটা মানুষ ছিল তো, একা তো ছিলে না?
শুনে অমৃতা হেসে ফেলেছিল। ওখানে হোস্টেলেও মানুষ থাকবে। ভূত প্রেতের সঙ্গে থাকতে যাচ্ছে না তো! বন্ধুও হয়ে যাবে, যা শ্বশুরবাড়িতে তার কোনও কালেই জোটেনি।
এর ওপর আর কথা চলে?
গাড়িতে বসে অমৃতা বলল, এয়ারপোর্টে ঢুকেই হোয়াটস্অ্যাপের লাস্ট সিন অন করবি। ব্লু টিকটাও।
মিতুল ভুরু তুলল, একদম না।
একদম হ্যাঁ। বিদেশ বিভুঁইয়ে একা থাকবে। ওটুকু দেখলে অন্তত শান্তি পাব যে ঠিক আছ। বলতে বলতে গলা ধরে আসে অমৃতার। অবাক হয় বাপ বেটি দুজনেই। চার মাস ধরে অমৃতা শুধু মিতুর স্যুটকেসে কী কী যাবে গুছিয়েছে, রেসিপির খাতা বানিয়েছে মেয়ের জন্য, বিভিন্ন লোকজনকে জিজ্ঞাসা করে করে নতুন শহরে ভারতীয় দোকান বাজার সম্বন্ধে খবর জোগাড় করেছে আর দিনরাত যখন সময় পেয়েছে আত্মীয় বন্ধু, বন্ধুর বন্ধু সবাইকে সাতকাহন করে মেয়ের সাকসেস স্টোরি শুনিয়েছে। আজ এই যাওয়ার বেলায় সে মানুষটার গলা বুজে আসছে দেখে মিতুলের চোখে জল এসে গেল। ভারী হাওয়া কেটে মাকে জড়িয়ে ধরে বলল, অ্যাদ্দিন তো এমন ভাব করছিলে যেন আমি গেলেই শান্তি পাও তুমি। তাড়াতে পারলে বাঁচো।
অমৃতা জানলা দিয়ে বাইরে তাকায়। হুহু করে রাস্তা পেরোচ্ছে।
বাড়ি ফিরে খেতে ইচ্ছেই করল না। অমৃতা আকাশের দিকে তাকিয়ে বসে রইল ব্যালকনিতে। এয়ারপোর্টের কাছেই বাড়ি ওদের। কিন্তু আগে কখনও ভাবেনি, রোজ যে এত ফ্লাইট যায় সবগুলোর ভেতরেই কারও না কারও সন্তান একা চলে যাচ্ছে কতদূর।
রান্নাঘরে খানিক বাসন পড়ে আছে। আজ সুলতা কাজে এল না। বেয়াক্কেলে হয় এরা বড্ড। নইলে জানে আজ মেয়েটা চলে যাচ্ছে, আজই কামাই! কাল আসবে কি না কে জানে। মেয়েটা কতদূর পৌঁছল! শিকাগো খুব ঠান্ডা জায়গা। এই শীতে গেল। ওখানে ট্যাক্সি পাওয়া মুশকিল শুনেছে। ওখানে গিয়ে ফোন না নিলে তো অ্যাপ ক্যাব করতেও পারবে না। ঠিকঠাক যেতে পারবে তো? বড্ড মাইগ্রেনে ভোগে মিতু। বারবার মাথায় আইসপ্যাক লাগাতে হয় টানা দুদিন। এসব কে করে দেবে! মিতুকে ভালোভাবে মানুষ করার গর্বটা যেন ধূসর হয়ে আসে মনের মধ্যে। একসময় অমৃতাও বিছানায় গিয়ে শোয়। স্বামী স্ত্রীর মাঝে শুয়ে থাকে একরাশ উৎকণ্ঠা।
সকালে সুলতা এল যেন অর্ধেক মৃত একটা মানুষ। অমৃতা ঝাঁঝিয়ে উঠেছে। – কী আক্কেল তোমার! কালই ডুব দিলে। -বলেই মুখের দিকে তাকিয়ে থমকে গেল।
– কী হয়েছে সুলতা?
হাউহাউ করে কাঁদে সুলতা। বলে সব। অমৃতার বুকের মধ্যে একটা যন্ত্রণা আর ভয় পাকিয়ে ওঠে। জড়িয়ে ধরে সুলতাকে।
– এসো, ঘরে বোসো। কাজ করতে হবে না। ছেলের নাম্বার আছে কোনও? দাও ফোন করে দেখি আমিও।
নিজের ফোনটা এগিয়ে দেয় সুলতা।
অবাক হয় অমৃতা। – তোমার ফোন আছে? আচ্ছা দাও।
ফোনটা সেই সময় বেজে ওঠে। অচেনা নাম্বার।
অবিনাশ চেঁচাচ্ছে ওদিক থেকে, ফোন ধরছ না কেন? খবর পেয়েছি।
সুলতার গলা বন্ধ হয়ে আসে। – খারাপ খবর, না?
– না না, খুব খারাপ নয়। পুড়েছে। কিন্তু মারাত্মক নয়। হাসপাতালে আছে। ওখান থেকে খবর এসেছে। চিন্তা কোরো না। কাল ছেড়ে দেবে। ফোনটা ভেতরে রয়ে গেছে তাই জানাতে পারেনি।
ফোন রেখে সুলতা কান্নায় ভেঙে পড়ে। অমৃতা মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। তার মেয়েটা এখনও উড়ে উড়ে যাচ্ছে এক অজানা আস্তানায়।
সন্তানকে ভবিষ্যতের আকাশে উড়িয়ে দেওয়ার উৎকণ্ঠায় ভেসে যায় দুই মায়ের চোখ। দুজনেই অজানা এক শক্তির কথা ভেবে হাত জোড় করে মনে মনে বলে, ভালো রাখো, ওকে ভালো রাখো ঠাকুর।
পাঠ চৈতালী বক্সী, শঙ্খ বিশ্বাস
শব্দগ্রহণ ও আবহ অঙ্কুর নন্দী
অলংকরণ অর্ঘ্য চৌধুরী